কবিতার ভাষা নিয়ে সামান্য

একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, যে কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত কবির ভাষা এবং স্টাইল অন্য আরেকজন নামকরা কবির থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকমের। ফলে বলা যায়- যেরকম কবিতা একবার লেখা হয়ে গেছে, একজন নতুন কবি অবশ্যই চাইবেন, সেটাকে অতিক্রম করে নিজের একটা আলাদা ভাষা গড়ে তুলতে।

সুচারু ছন্দ, অলঙ্কার ও আবেগ সর্বস্ব, অন্যদিকে- পরবর্তীকালে, ছন্দ / অলঙ্কার বিবর্জিত ও চিত্রগুণ সমৃদ্ধ অনেক সফল কবিতা যেহেতু বাংলা ভাষায় ইতিমধ্যে লেখা হয়ে গেছে- নব্বই দশকের শুরুর আগেই। ফলে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে পরের অর্থাৎ নব্বই, শূন্য বা প্রথম দশকের কবিরা কী লিখবেন?

আমার মনে হয় নানারকমের সমাধানের মধ্যে একটা পন্থা হতে পারে- কবিতাকে অ্যাবস্ট্রাকশনের দিকে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ কথা বলব, কিন্তু কথাটা যেন পূর্ণ কোনো কথা না। চিত্র দেব, কিন্তু সেসব চিত্র বোঝা যাবে, আবার যাবে না। একাধিক ভিন্ন ভিন্ন কথা, আপাত অসংলগ্ন কথা মিলেমিশে যেন তৃতীয়  আরেকটা বিষয়কে ফুটিয়ে তুলবে (সিনেমায় মন্তাজ যেরকম)।  এই যে ‘অধরা’ ভাব, খুব অল্প একটা ‘টাচ’ দিয়ে একটা বড় বিষয়কে বা বিষয়ের আত্মাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া, আবার না দেয়া, এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাঠকের মনে কোনো রকমের ‘অভিজ্ঞতা’ গড়ে তোলা- এটাই হয়তোবা আশির পরে  এসে কবিতার পুরনো গন্ডি থেকে মুক্তি পাবার একটা পন্থা হতে পারে।

এরকম একটা বিষয় নিয়ে আগে থেকেই ভাবতাম, ফলে আমার নিজের কবিতার ক্ষেত্রেও এরকমের অ্যাবস্ট্র্যাকশন পরবর্তীকালে দেখা গেছে। হয়তো ছবি প্রকাশ করে যাচ্ছি- কিন্তু সেটা কোনো নিটোল, মধুর, স্থির একটা ছবি না। ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে ছবির পরিপ্রেক্ষিত কিংবা চেহারা।

কথা বলে যাচ্ছি- কিন্তু হঠাৎ দেখা যাবে সেই কথাগুলোর একরৈখিক কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একেকজন অ্যাবস্ট্রাকশন একেকভাবে আনেন। যেমন অনেকে আছেন শব্দের টোন নিয়ে কাজ করে থাকেন। শব্দের ধ্বনি-গুণ, ধ্বনি-গুণের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছেন, সিনট্যাক্স ভেঙে নতুন ভাবে গড়ছেন। আমি নিজে ধ্বনি নিয়ে অত কাজ না করলেও- আমার কায়দা অনেকদিন যাবত এমন ছিল যে- পরিচিতের মধ্যে থেকে অপরিচিতকে বের করে আনা। সহজ কথা বলবো- কিন্তু সহজ কথাগুলো মিলে মিলে দেখা যাবে জটিল অন্যরকমের কোনো একটা ঘটনা ঘটানোর দিকে যাচ্ছে।

কবি মধুসূদনের কবিতার বড় ভক্ত আমি। উনি যেমন একটা কথা টেনে নিয়ে পরের লাইনে গিয়ে শেষ করতেন (উদাহরণ : ‘কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরুজন তুমি/পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে’- এখানে ‘পিতৃতুল্য’ শব্দে গিয়ে শেষ হওয়া)- এই কায়দাটি দারুণ লাগে।

কিন্তু আমি এই কায়দাটাই টেনে নিয়ে গিয়ে যা করলাম, কথার অ্যাবস্ট্র্যাক্ট ফ্লোগুলোকেও পরের বাক্যে নিয়ে শেষ করতে থাকলাম। একটা কথার মধ্যে নতুন একটা কথার শুরু করতে থাকলাম। যদিও মধুসূদনের মতো ছন্দের ফ্লো দিয়ে-সেটাকে মোটেই অতটা ওয়েল-ডিফাইনড করে না। এতে করে যা হলো- একটা যেন উন্মাদনার সৃষ্টি হলো। একজন কবি তো একজন উন্মাদও বটে। সব পাঠক কিংবা পাঠিকার মনেও একজন উন্মাদ বাস করে। সেই উন্মাদটিকে যেন আমি ধরতে চাই ভাষা দিয়ে।

লেখক : কবি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //