কাফকার সাহিত্যের উৎসভূমি

কাফকা প্রাক্তন অস্ট্রি-হাঙ্গেরি সীমান্তবর্তী ‘বোহেমিয়ান ক্রাউন’-এ জন্মগ্রহণ করেন। স্থানটি বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগ-এর অন্তর্ভুক্ত। সময়টা ছিল ১৮৮৩ সাল। প্রাগ স্থানটি তৎকালীন সময়ে দ্বি-জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্যে ঋদ্ধ ছিল। এখানকার অধিকাংশ মানুষ চেক-জার্মান অথবা উভয় ভাষাতেই কথা বলত। তাছাড়া সেই সময়ে এই জায়গার রাজনৈতিক পরিস্থিতিও যথেষ্ট সংকটে পড়েছিল। একই সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং এন্টি- সেমিটিজম এই দুইয়ের প্রভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত এখানকার বাসিন্দাদের বেড়ে ওঠা ও চিন্তাভাবনার বিকাশও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে উঠেছিল। সেই পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতার ছোঁয়া যে বালক কাফকার সংবেদনশীল সত্ত্বাটিকে স্পর্শ করেনি, সেটা চিন্তা করে নেওয়া বেমানান হতে বাধ্য।

বাল্যকালে কাফকা মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবেশেই বেড়ে উঠছিলেন। তাঁদের পরিবারের নিজস্ব ব্যবসা ছিল। তাঁর পিতা হারম্যান কাফকা পুত্রের মানসিকতা সম্পর্কে মোটামুটি ওয়াকিবহাল ছিলেন, বলা চলে। তবে কাফকা নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। সর্বক্ষেত্রে তিনি নিজেকে বঞ্চিত ও অকর্মণ্য ভাবা শুরু করেন। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত বই ‘লেটার টু হিজ ফাদার’-এ তিনি নিজের পিতাকে তাঁর প্রতি রূঢ় আচরণের জন্য দোষারোপ করেছেন। তাই পরবর্তীকালে কাফকার সাহিত্যকর্মগুলো যে নেতিবাচক ও আত্ম-ধ্বংসাত্মক মূলভাব প্রদর্শন করেছে, সেটির শিকড় হয়তো প্রাগে, তাঁর শৈশবেই প্রোথিত।

প্রাগ শহরে পা রাখলে কাফকার স্মৃতিচিহ্নগুলো খুব বেশি অর্থবহ মনে না-ও হতে পারে। এমনিতে ইউরোপীয়রা নিজেদের অতীত-ঐতিহ্য সংরক্ষণে যথেষ্ট সচেতন হলেও এখানে কিছুটা ব্যতিক্রম। যে বাড়িতে কাফকা জন্মগ্রহণ করেন, সেটির কোনো অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। ১৮৯৭ সালে বাড়িটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ২০০০ সালে এখানে ফ্রানৎস কাফকা স্কয়ার স্থাপিত হয়। এ ছাড়াও ওল্ড টাউনে দুসনি ও ভেজেনস্কয়া সড়ক দুইটি যেখানে মিলিত হয়েছে, সেখানে ফ্রানৎস কাফকা সৌধ গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে এলে চোখে পড়বে ব্রোঞ্জনির্মিত ১২ ফুট লম্বা একটি ভাস্কর্য; কাফকার আদলে তৈরি। ঢোলা কোটের ভিতরে ছোটখাটো রুগ্ন একজন মানুষের অবয়ব। এটিরই একটি ১২ ইঞ্চি সংস্করণ কাফকা সোসাইটির বার্ষিক পুরস্কার হিসেবে প্রদান করা হয়ে থাকে।

মেটামরফোসিস- উপন্যাস নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তৈরি হলেও এটি যে স্থানে বসে লেখা, সেটি সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ঠিকানাটি হচ্ছে ৩০ নম্বর, পারিজস্কা । কাফকা স্কয়ার থেকে জায়গাটি তেমন দূরে নয়। এই স্থানটিও ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ধ্বংস করা হয়। বর্তমানে এখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঝাঁ-চকচকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল। পাঠকরা মনে করতে পারবেন, মেটামরফোসিস-এর মূল চরিত্র গ্রেগর সামসার বয়ানে প্রায় সম্পূর্ণ গল্প আবর্তিত হয়েছে একটি অ্যাপার্টমেন্টকে ঘিরে। অনেকে মনে করেন, গল্পের সেই অ্যাপার্টমেন্টটির মডেল হিসেবে কাফকা এখানকার তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টটিকেই ব্যবহার করেছেন। সর্বশেষ যে স্থানের তথ্য দিয়ে শেষ করতে চাই, সেটি কাফকার যৌনজীবন সম্পর্কিত; এবং স্বাভাবিকভাবেই বিতর্কিত। ওল্ড টাউন স্কয়ারের কেবলই বাইরে ৬ নম্বর, কামজিকোভাতে একটি প্রায় অদৃশ্য গলি রয়েছে। এখানে রাশিয়ান পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে একটি রেস্টুরেন্ট খোলা হয়েছে।

এটির নাম-য়ূ কারভেনেভো পাভা। এই নামের বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘লাল ময়ূরের ডেরা’। তবে পূর্বে এই জায়গায় একটি উঁচুদরের পতিতালয় চালু ছিল। এখানে মোটামুটি বিত্তবানদেরই আনাগোনা ছিল। কাফকা এই পতিতালয়ে প্রায় নিয়মিতই আসতেন। তবে গবেষকরা এই ব্যাপারে নিশ্চিত নন যে কাফকা এখানে রতিক্রিয়া কখনো সম্পন্ন করেছেন কিনা। অনেকেরই ধারণা, এখানে কাফকা পতিতা, দালাল, দোকানদার বা অন্যান্য খদ্দেরদের সঙ্গে কথা বলেই সময় পার করতেন। কাফকার লেখার মূলে রয়েছে মানুষ ও মানুষের মননরীতি। নিজের লেখার প্রয়োজনেই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে তাঁকে মিশতে হয়েছে, কথা বলতে হয়েছে।

নিঃসন্দেহে ফ্রানৎস কাফকার ব্যক্তিগত জীবন তাঁর সৃষ্টিগুলোকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে, বিভিন্ন উপাদানে ঋদ্ধ করেছে। তাই তাঁর জন্মস্থান প্রাগ সম্পর্কে তথ্যাদি লেখক, গবেষক কিংবা পাঠকদের কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় বলে পরিগণিত হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। তাই এই প্রভাবশালী এবং মর্ষকামী কথাসাহিত্যিকের জীবনের স্তরে স্তরে নিরুত্তাপ অথচ ঘটনাবহুল প্রাগ শহরের ভূমিকা দারুণভাবেই রয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //