যেভাবে সোমালীয় জলদস্যুদের উত্থান

ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশি পণ্যবাহী একটি জাহাজ এবং ২৩ নাবিক ও ক্রুকে আটক করেছে সোমালিয়ান জলদস্যুরা। এদিকে সোমলীয় জলদস্যুরা ফের ব্যাপক বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মাঝখানে বেশ কয়েক বছর কিছুটা নীরব ছিল বিশ্বের কুখ্যাত এই দস্যুবাহিনীটি। লোহিত সাগরে হুথিদের নিয়ে আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলো বেশি ব্যস্ত থাকার সুযোগে ভারত মহাসাগরের গালফ অফ এডেনে তারা ফের মাথাচাড়া দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

মঙ্গলবার (১২ মার্চ) এই দস্যুরা ‘এমভি আবদুল্লাহ’ নামে বাংলাদেশি একটি জাহাজ ২৩ জন নাবিকসহ জিম্মি করেছে। জাহাজটি ইতোমধ্যে তারা সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে কর্মরতরা অডিওবার্তায় জানিয়েছে। ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণও চেয়ে বসেছে ভয়াবহ এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠিটি। ব্যর্থতায় নাবিকদের একে একে সাবাইকে মেরে ফেরার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।

যেভাবে উত্থান এই জলদস্যুদের
ইতালিয়ান ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে ১৯৬০ সালে সোমালিয়ার জন্ম। পরের দুই দশকের বেশি সময় যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত সোমলিয়াতে কার্যকর কোন সরকার ছিল না। এই সময়টায় আফ্রিকার মধ্যে দীর্ঘতম উপকূল সমৃদ্ধ দেশটির জলসীমার নিরাপত্তায় কোনো কোস্টগার্ড বা বাহিনী ছিল না। এতে এই অঞ্চলে বিদেশি মাছ ধরা নৌযানের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়তে থাকে। স্থানীয় জেলেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। ফলে, তারা দস্যুবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইন্ডিয়ান ওশান কমিশনের সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতেও ওই সময়ের দস্যুতার নেপথ্যে এই কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে।

তাছাড়া, মৎস্য শিকারের চেয়ে দস্যুতায় আয়ের পরিমাণও অনেকগুণ বেশি। তবে, কয়েক বছর তাদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ওই রুটে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়। এর ফলে ২০১২ সাল নাগাদ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে দস্যুবৃত্তি। ইউরোপিয়ান নৌবাহিনীর অপারেশন কমান্ডার রিয়ার অ্যাডমিরাল ডানকান পটস তখন বিবিসিকে বলেছিলেন, সামুদ্রিক দস্যুতার ‘বিজনেস মডেল’ কার্যকরভাবে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছেন তারা।

সাম্প্রতিক হামলা
গত কয়েক মাসে সোমালি জলদস্যুদের তৎপরতা বেড়েছে। পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে সামুদ্রিক নিরাপত্তা বিধানে কাজ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী বা ইইউন্যাভ ফর আটালান্টা। তাদের মতে, গত বছরের নভেম্বরে থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে সোমালি উপকূলে অন্তত ১৪ টি জাহাজ হাইজ্যাক করা হয়েছে। এর মধ্যে ইরানের পতাকাবাহী একটি মাছ ধরার নৌকা এবং লাইবেরিয়ান-পতাকাবাহী সেন্ট্রাল পার্ক নামের একটি জাহাজের জেলে ও নাবিকদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়। সেন্ট্রাল পার্কের উদ্ধার তৎপরতায় মার্কিন নৌবাহিনী জড়িত ছিল। পরে তারা জানায়, এটা স্পষ্টতই দস্যুতা এবং আক্রমণকারীরা সম্ভবত সোমালিই ছিল।

ডিসেম্বরে এমভি রুয়েন নামে মাল্টার পতাকাবাহী একটি জাহাজ হাইজ্যাক করা হয়। এখনও জাহাজের নিয়ন্ত্রণ হামলাকারীদের হাতে। জিম্মি আছেন ১৭ জন ক্রু। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরো- আইএমবি’র মতে, এটি ছিল ছয় বছরের মধ্যে সোমালিয়ায় প্রথম সফল হাইজ্যাকিং। আইএমবি একটি প্রভাবশালী অলাভজনক সংস্থা যা সামুদ্রিক অপরাধ মোকাবেলা করার লক্ষ্যে কাজ করে।

ভারতীয় নৌবাহিনীর ব্যাপক অভিযান
জানুয়ারিতে এক সপ্তাহে তিনটি অভিযানে ১৯ জন জিম্মিকে মুক্ত করতে সমর্থ হয় তারা। তাদের মধ্যে ১১ জন ইরানি নাগরিক বাকিরা পাকিস্তানি। ভারতীয় বাহিনীর তরফে জানানো হয়, ‘এদের সবাই সোমালি দস্যুদের হাতে বন্দী ছিলেন।’

বিবিসি’র রিয়েলিটি চেক টিমের প্রতিবেদন বলছে, শুধু ২০১৮ সালেই পূর্ব আফ্রিকান জলসীমায় ১১২ টি নৌ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। যার সর্বশেষ শিকার বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে যাওয়ার পথে মঙ্গলবার ২৩ জন ক্রু সহ জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয় জলদস্যুরা।

দস্যুদের উদ্দেশ্য কী? আয় কেমন?
২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত সময়কালে হর্ন অফ আফ্রিকার দস্যুরা কী পরিমাণ অর্থ আদায় করেছে তার একটি আনুমানিক হিসাব করেছে বিশ্বব্যাংক। সেই হিসাব অনুযায়ী জলদস্যুরা ক্রুদের জিম্মি করে সাড়ে তিনশো থেকে সোয়া চারশো মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ আদায় করেছে।

এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে নাইজেরিয়ার ফেডারেল ইউনিভার্সিটির লেকচারার স্যামুয়েল ওয়েওল বলেন, ছিনতাইয়ের পেছনে মূল লক্ষ্য মুক্তিপণ আদায় বলেই ধারণা করা যায়। অন্তত সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর নেপথ্য এটিই মূল কারণ। ২০১১ সালে একটি তেলের ট্যাংকার জব্দ করে দস্যুরা। দুশো মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের জ্বালানি ছিল নৌযানটিতে। আটক দুই ফিলিপিনো ক্রুকে হত্যা করা হয়।- বিবিসি বাংলা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //