ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার বলি ইথিওপিয়া?

ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা জাতিসংঘের এক গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জানায়, ইথিওপিয়ার সেনারা দেশটির উত্তরের তিগ্রে অঞ্চলে সামরিক অভিযানে ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। 

যদিও সরকারি বাহিনীর দাবি, তারা হুমেরা, দানশা, শিরারো, আলামাতা এবং শিরেসহ বেশ কয়েকটি শহর নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ইথিওপিয়ার সরকারি মুখপাত্র রেদওয়ান হুসেইন জানান, সরকারি বাহিনী তিগ্রের মূল শহর মেকেল্লের অভিমুখে রয়েছে। 

ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সুদান ও এরিত্রিয়ার সীমান্তে পশ্চিমের শহর হুমেরাতে এবং দক্ষিণের শহর আলামাতাতে ব্যাপক সংঘাত হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। ইথিওপিয়ার বিমানবাহিনী বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা চালাচ্ছে। তিগ্রেতে টেলিযোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ায় ও সাংবাদিকদের যেতে বাধা দেয়ায় তথ্য সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। সংঘাতে কয়েকশ’ মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। 

৪ নভেম্বর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কমপক্ষে ৩৬ হাজার মানুষ পার্শ্ববর্তী সুদানে আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়াও তিগ্রে অঞ্চলের মাঝেই অনেকে ঘরছাড়া হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ ঘোষণা দেন যে, ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী তিগ্রের রাজধানী মেকেল্লের দিকে রওনা হয়েছে ও তারা বিদ্রোহী তিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) নেতৃবৃন্দকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। টিপিএলএফ ১১ কোটি মানুষের ইথিওপিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল হলেও এর মূল ভিত্তি তিগ্রে অঞ্চলের ৬০ লাখ তিগ্রের মাঝে। ১৯৯১ সালে বামপন্থী মেনজিসটু হাইলেমারিয়ামের সরকারকে উৎখাত করে টিপিএলএফ গেরিলারা ক্ষমতা দখল করে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত তারা ছিল ক্ষমতাসীন দল, যাদেরকে সরিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ অরোমো ও আমহারাদের নেতৃত্বে আবি আহমেদ ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। 

বিবিসি জানায়, টিপিএলএফ এর আগেও কয়েকবার ইথিওপিয়া থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিল। আগস্টে টিপিএলএফের নেতা দেব্রেতসিওন গেব্রেমাইকেল বলেন, তারা কখনোই নিজেদের কষ্টার্জিত স্বশাসনের অধিকার ছেড়ে দেবেন না। সেপ্টেম্বরে করোনাভাইরাস মহামারির কারণ দেখিয়ে ইথিওপিয়া সরকার জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার পর টিপিএলএফের তত্ত্বাবধানে তিগ্রে অঞ্চলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকেই আদ্দিস আবাবা সরকারের সাথে টিপিএলএফের সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি হয়। অক্টোবরে ইথিওপিয়ার সরকার তিগ্রে অঞ্চলের বাজেট স্থগিত করে। 

সরকারের দাবি, মেকেল্লের এক সেনা ঘাঁটিতে হামলা করে টিপিএলএফের সদস্যরা অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করার পর থেকেই এই সামরিক মিশন শুরু করা হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, দ্রুত যুদ্ধ জয়ের সম্ভাবনা নেই; কারণ তিগ্রের সেনারা খুব শিগগিরই মেকেল্লে শহরের পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চলে আশ্রয় নেবে। ওই পাহাড়ি অঞ্চল রক্ষা করা অপেক্ষাকৃত সহজ বলেই সেখানে ইথিওপিয়ার সরকারি বাহিনীর দ্রুত সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ইউনিটগুলো অন্যান্য শহর বাইপাস করে মেকেল্লে রওয়ানা হচ্ছে। মিলিশিয়া ও আধাসামরিক বাহিনীর অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইউনিটগুলো ওই শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করছে; তারাই তিগ্রেদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইথিওপিয়ার সরকারি বাহিনী যত এগোবে, তাদের সাপ্লাই লাইন গেরিলা আক্রমণের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। অর্থাৎ ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী টিপিএলএফকে ক্ষমতাচ্যুত করলেও সংঘাত হয়তো থামবে না। 

বিবিসি জানায়, ইথিওপিয়ার প্রতিবেশী এরিত্রিয়া মূলত তিগ্রেদের পছন্দ করে না। তিগ্রেরা জানায়, এরিত্রিয়ার বাহিনী ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনীকে সরাসরি সহায়তা দিচ্ছে। ১৯৯৮ সালে এরিত্রিয়ার সঙ্গে ইথিওপিয়ার সীমান্ত যুদ্ধ শুরু হয়, যা মূলত তিগ্রের সঙ্গে সীমানা নিয়েই। তিগ্রের আঞ্চলিক সরকারের অসহযোগিতার কারণে সীমান্তবর্তী শহর বাদমে নিয়ে দুই দেশের দ্বন্দ্বের সুরাহা হয়নি।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইকেল রেইনর প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ ও টিপিএলএফের নেতা দেব্রেতসিওন গেব্রেমাইকেলের সাথে কথা বলার পর উভয় পক্ষেরই সামরিক ফলাফল পাওয়ার আশাবাদ নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে বলে মতামত দেন। গার্ডিয়ান জানায়, পূর্ব আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইথিওপিয়া ও তারা এখনো আবি আহমেদ সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। 

১৯ নভেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের আফ্রিকা বিষয়ক সহকারী সচিব তিবর নাগি সাংবাদিকদের বলেন, ইথিওপিয়ার এই সংঘাত দুই দেশের মাঝে সংঘাত নয়; বরং একটা দেশের একটা অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছে। তাই এর ফলাফল হিসেবে যা তারা আশা করেছিল, সেটিই হচ্ছে।     

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এখানে বিদেশি শক্তি জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। বিশেষ করে নীল নদের ওপর ইথিওপিয়ার ‘গ্র্যান্ড রেনেসাঁস ড্যাম’ প্রকল্প ও নদীর পানির হিস্যা নিয়ে ইথিওপিয়ার সাথে মিসর ও সুদানের যখন দ্বন্দ্ব চলছে, তখন ইথিওপিয়ার অভ্যন্তরীণ কলহ আঞ্চলিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। 

দ্য ইস্ট আফ্রিকান জানায়, ২০ নভেম্বর আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সাইরিল রামাফোসা মোজাম্বিক, লাইবেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার তিনজন সাবেক প্রেসিডেন্টকে সদস্য করে একটা মিশন ইথিওপিয়াতে পাঠাবার ঘোষণা দেয়ার পরদিন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রীর অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে বলা হয় যে, ইথিওপিয়ার অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে মধ্যস্ততা করতে আফ্রিকান ইউনিয়নের মিশনের ইথিওপিয়া আসার খবরটা বানোয়াট। 

আফ্রিকা বিশ্লেষক রশিদ আবদি বিবিসিকে বলেন, ‘এই যুদ্ধ ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক। সুদান ও এরিত্রিয়া ইতিমধ্যেই অংশ নিচ্ছে বলে জানান তিনি। ইথিওপিয়াসহ হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের জন্যই কিছু দিনের মাঝেই এখানে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিরা জড়াবে।’ 

আবদি আরো বলেন, ‘ইথিওপিয়া যদি তিগ্রের কারণে সোমালিয়ার যুদ্ধ থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়, তাহলে সোমালিয়াতেও এর প্রভাব পড়বে। এছাড়াও জাতিগত কারণে ইথিওপিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমতে থাকলে জাতিরাষ্ট্র ইথিওপিয়ার অস্তিত্বই হুমকির মাঝে পড়ে যাবে।  অন্যদিকে জাতিসংঘ বলছে, ইথিওপিয়ার ৭০ লাখ মানুষ খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভরশীল, যার মাঝে তিগ্রে ছয় লাখ। এই অঞ্চল পঙ্গপালের আক্রমণেও জর্জরিত। ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে দুর্বল মানুষগুলোই সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //