মালি অভ্যুত্থান: পশ্চিম আফ্রিকায় প্রভাব হারাচ্ছে ফ্রান্স

১৮ আগস্ট পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চলছে। ১১ সেপ্টেম্বর মালির সামরিক সরকারের নিযুক্ত ২০ সদস্যের এক বিশেষজ্ঞ কমিটি নতুন এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব করে, যার মেয়াদ হবে দুই বছর; প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করবে সেনাবাহিনী। 

আর প্রেসিডেন্ট নিজে সেনাবাহিনীর প্রস্তাব করা প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। এই প্রস্তাবে প্রেসিডেন্টকে সামরিক বা বেসামরিক ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। 

মালির বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বেসামরিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রুপের কয়েকশ’ সদস্যকে সেনাবাহিনী রাজধানী বামাকোতে তিনদিনের এক আলোচনায় ডাকে। এই আলোচনার দ্বিতীয় দিনের মাথায় এক চার্টারে বলা হয় যে, মালির সমস্যার গভীরতার কথা চিন্তা করেই দুই বছরের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। 

পশ্চিম আফ্রিকার আঞ্চলিক জোট ‘ইকোনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস’ (ইকোওয়াস) মালির সেনাবাহিনীকে ১৭ সেপ্টেম্বরের মাঝে একজন প্রেসিডেন্ট ও একজন প্রধানমন্ত্রীর নাম প্রকাশ করার জন্য সময় বেঁধে দেয়। 

আল জাজিরা জানায়, বামাকোর আলোচনায় যারা অংশ নিয়েছেন, তারা দুটি ব্যাপারে বেশ বিভক্ত। প্রথমত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে; আর দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনীর ভূমিকাই বা এ ক্ষেত্রে কি হবে। সেনাবাহিনী প্রথমে প্রস্তাব করেছিল যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ হবে তিন বছর। অর্থাৎ সেনাবাহিনী হয়তো তাদের আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে। তবে সরকারের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তারা কোনো ছাড় যে দেয়নি তা মোটামুটিভাবে পরিষ্কার; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পুরো পশ্চিম আফ্রিকার ওপর মালির রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের প্রভাব কতটুকু হবে, সেটিই হবে ভূরাজনৈতিকভাবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

মালির সেনাবাহিনীর একাংশ এমন একটা সময়ে ক্ষমতা দখল করে, যখন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম বুবাকার কেইতার বিরুদ্ধে এক মাস ধরে রাস্তায় ব্যাপক বিক্ষোভ চলছিল। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারার অভিযোগ আনা হয়েছিল। মালির উত্তরাংশে ২০১২ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে- এই সংঘাত ইতিমধ্যেই পার্শ্ববর্তী দেশ নাইজার, বুরকিনা ফাসো ও আইভোরি কোস্টে ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবে পুরো অঞ্চল অস্থির হওয়া ছাড়াও মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। মালির এই রাজনৈতিক সমস্যা অত্র অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করবে, এই যুক্তিতেই অঞ্চলিক জোট মালির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। 

মালিতে মাসব্যাপী সহিংস বিক্ষোভের মাঝেই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নটি আলোচনায় আসতে থাকে। বিরোধী ‘জুন ফাইভ মুভমেন্ট’ এই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয়। সমস্যা সমাধানে ‘ইকোওয়াস’এর একটা প্রতিনিধি দল জুলাইয়ের মাঝামাঝি মালি রওনা দেয়। 

নাইজেরিয়ার পত্রিকা প্রিমিয়াম টাইমসের এক প্রতিবেদনে ইকোওয়াসের কমিশন প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লদ কাসি ব্রু স্বাক্ষরিত এক চিঠির বরাত দিয়ে বলা হয়, নাইজেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট গুডলাক জনাথনকে এই মিশনের বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়েছে। জনাথন তার মিশনের মাধ্যমে একটা জাতীয় ঐক্যের সরকার প্রস্তাব করেন, যেখানে বিরোধী দল ও বেসামরিক ব্যক্তিত্বরাও থাকবেন। তবে জনাথনের প্রস্তাবে ‘জুন ফাইভ মুভমেন্ট’ রাজি হয়নি। জনাথনের ব্যর্থতার পর ইকোওয়াসের পাঁচটি দেশ নাইজেরিয়া, ঘানা, আইভোরি কোস্ট, নাইজার ও সেনেগালের প্রেসিডেন্টরা মালিতে গিয়ে উপস্থিত হন; কিন্তু প্রেসিডেন্ট কেইতা যেমন ক্ষমতা ছাড়তে ছিলেন নারাজ; তেমনি বিরোধী গ্রুপের নেতা ইব্রাহিম ডিকোও ছিলেন নিজের অবস্থানে অটল। ইকোওয়াসের এই প্রচেষ্টাও হয় ব্যর্থ। 

মালির সমস্যার পেছনে শক্তিশালী দেশগুলোর বড় ভূমিকা রয়েছে। মালির গৃহযুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে দেশটির সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক ফ্রান্স। মালিতে ফ্রান্সের ৫ হাজারের বেশি সেনা রয়েছে। অপরদিকে, দেশটির রাজনৈতিক সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে আঞ্চলিক সংগঠন ইকোওয়াস। এই সংস্থার ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের মাঝে আটটি দেশই ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ; যেগুলোর রাষ্ট্রীয় ভাষা ফরাসি; এগুলোকে বলা হয় ‘ফ্রাঙ্কোফোন’ দেশ। চারটি ব্রিটেনের সাবেক উপনিবেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা একটি রাষ্ট্রের অফিশিয়াল ভাষা ইংরেজি; এগুলোকে বলা হয় ‘অ্যাংলোফোন’ দেশ। বাকি দুটি দেশ পর্তুগালের সাবেক উপনিবেশ হওয়ায় তাদের অফিশিয়াল ভাষা পর্তুগিজ। তবে জনসংখ্যার দিক থেকে ইকোওয়াসের প্রায় ৩৫ কোটি জনগণের মাঝে ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলোর জনসংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি। এর মাঝে আবার এক নাইজেরিয়ার জনসংখ্যাই প্রায় ২০ কোটি। 

অর্থনীতির আকারের দিক থেকে পুরো অঞ্চলে নাইজেরিয়ার ধারে কাছেও কোনো দেশ নেই। ইকোওয়াসের মোট প্রায় ৬৭৫ বিলিয়ন ডলারের জিডিপির মাঝে নাইজেরিয়ার একার জিডিপিই প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। ইকোওয়াসের মাঝে সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ নাইজেরিয়ার অবস্থান অতি শক্তিশালী হওয়ার কারণে সংস্থার ওপর ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণ খুবই কম এবং ফ্রান্স ইকোওয়াসের ব্যাপারে সর্বদাই সন্দেহ প্রকাশ করেছে। ইকোওয়াসের মাধ্যমে পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে নাইজেরিয়ার নেতৃত্ব নেয়াকে ফ্রান্স তার সাবেক উপনিবেশগুলোর ওপর সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হিসেবেই দেখেছে।

মিডল ইস্ট মনিটরের এক লেখায় বলা হয়, পশ্চিম আফ্রিকার মূল সমস্যা হলো ফ্রান্স। যতদিন ফ্রান্স আফ্রিকার দেশগুলোর ওপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ না সরিয়ে নেবে, ততদিন আফ্রিকার সমস্যার সমাধান হবে না। এই মন্তব্যের সাথে মিল পাওয়া যাবে আফ্রিকার দেশগুলোর মুদ্রার দিকে তাকালেই। পশ্চিম আফ্রিকার আটটি ও মধ্য আফ্রিকার ছয়টি দেশের মুদ্রা ‘সিএফএ ফ্রাঙ্ক’, যা ফরাসি মুদ্রা ফ্রাঙ্কের সাথে যুক্ত। যে কারণে এই দেশগুলোর অর্থনীতি বহুলাংশেই ফ্রান্সের ওপর নির্ভরশীল। নাইজেরিয়ার নেতৃত্বে ইকোওয়াসের চাপের মুখে ২০১৯ সালের শেষের দিকে পশ্চিম আফ্রিকার আটটি ফরাসি ভাষাভাষী দেশ ২০২০ সাল থেকে ‘সিএফএ ফ্রাঙ্ক’ থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। তবে ফ্রান্স এর মাধ্যমে তার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হারানোর পরিস্থিতিই দেখছে। 

ফরাসি নেতৃত্বে দীর্ঘ আট বছর ধরে মালির যুদ্ধ চলতে থাকার ফলে অত্র অঞ্চলে ফ্রান্সের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ‘ফ্রাঙ্কোফোন’ সাবেক ফরাসি উপনিবেশ মালির রাজনৈতিক সমস্যায় ‘অ্যাংলোফোন’ সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ নাইজেরিয়ার ভূমিকা অত্র অঞ্চলের ভূরাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করছে। 

মালির অভ্যুত্থান নেতারা কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, তা নির্ধারণে ‘অ্যাংলোফোন’ নাইজেরিয়ার অবস্থানই যখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তখন পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের শক্তি খর্ব হওয়ার ইঙ্গিতও পাওয়া যায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //