গার্মেন্টস সেক্টরে অশনিসংকেত

দেশের প্রায় ৮০ ভাগ রপ্তানি আয় আসে গার্মেন্টস সেক্টর থেকে। আবার সেই সেক্টরে যখন শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ মানবিকীকরণ, বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বাস্তবতা আসে তখন বলা হয় আন্দোলন করলে ফ্যাক্টরিই বন্ধ করে দেব। 

গত দুই-তিন সপ্তাহ ধরে চলমান শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি জোরালো হলে পুলিশি হামলায় এখন পর্যন্ত দুজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে শত শত। এরই মধ্যে মালিকরা প্রায় ৩০০ কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। দ্বিতীয় পদক্ষেপ নিয়েছে ‘কাজ না করলে বেতন নেই’ নিয়ম জারি করে। তৃতীয় ব্যবস্থা হিসেবে আনতে যাচ্ছে ‘নিরাপত্তার কথা বলে সকল কারখানা বন্ধ করার মতো পদক্ষেপ’। শ্রমিক-সংক্রান্ত বিষয় তদারকির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিজিএমইএর কর্মকর্তাদের মতে, গত মঙ্গলবার গাজীপুর, চন্দ্রা, কাশিমপুর, আশুলিয়া, কালিয়াকৈর, শফীপুর ও মিরপুরের প্রায় ২৫০টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। এর সঙ্গে পরে আরও ৫০-৬০টি কারখানা যোগ দিয়েছে। 

শ্রমিক বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় কারখানা মালিকেরা ‘কাজ ছাড়া বেতন নেই’ এমন পন্থা অবলম্বন করছেন, তবে শ্রমিকরা কি কাজ না করে খাওয়ার টাকা পায়? নাকি মালিকদের কাছ থেকে দয়া-দাক্ষিণ্য চায়? একটা সভ্য সমাজে ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ কথাটা যে সেই দাসযুগের নিকৃষ্ট ব্যবস্থার আধুনিক প্রচলন এটা কি তারা জানেন না? 

বলা হচ্ছে- ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যখন আমদানি-রপ্তানির সমস্যা, বিশ্ববাজারে চাহিদা হ্রাস, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির মতন বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে, তার মধ্যেই ঘটছে শ্রমিকদের আন্দোলন। রপ্তানিকারকরা সতর্কবার্তা দিচ্ছেন, দ্রুততর সময়ের মধ্যে এর সমাধান না হলে বাংলাদেশের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পোশাক খাত, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট রপ্তানিতে প্রায় ৮৫ শতাংশ অবদান রাখে এই খাত’। বুঝতে কষ্ট হয় না এসব কথার পেছনে কে রয়েছে। যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় এর মধ্যেই বেশকিছু কারখানার সামনে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। আশুলিয়ার শ্রমিক আন্দোলনের সার্বিক চিত্র কিছুটা শান্তই ছিল। এর মধ্যে জামগরা, নিশ্চিন্তপুর ও আশপাশের এলাকায় শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ ও বিচ্ছিন্নভাবে মিছিলের চেষ্টা করলে শিল্পাঞ্চল পুলিশ দ্রুতই শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। 

এদিকে পোশাক রপ্তানিকারকরা বলেছেন, তারা শ্রম আইনের ১৩/১ ধারা অনুসরণ করবেন। যেখানে বলা হয়েছে, ‘কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো শাখা বা বিভাগে বে-আইনি ধর্মঘটের কারণে মালিক উক্ত শাখা বা প্রতিষ্ঠান আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া দিতে পারিবেন, এবং এরূপ বন্ধের ক্ষেত্রে ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকগণ মজুরি পাইবেন না।’ তার মানে, এখনও সরকার ও সংশ্লিষ্টদের প্রশ্রয়ে এই গণবিরোধী আইন বহাল তবিয়তে রয়েছে।

বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ রাজধানীর উত্তরায় তাদের সদর দপ্তরে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি সাধারণ সভা করে। সেখানে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ (কাজ না করলে মজুরি নয়) এ নিয়ম অনুসরণের ঘোষণা দেন। চলমান শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তাদের অবস্থান ও মতামত তুলে ধরতে সভায় যোগ দেন প্রায় ২০০ কারখানা মালিক। 

‘সভায় হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত এলাকা-ভিত্তিক হওয়া উচিত। যেসব এলাকায় বিক্ষোভ ও ভাঙচুর হবে, সেখানে কারখানা বন্ধ রাখতে হবে। এ সময় অনেক উদ্যোক্তা এ কে আজাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। 

সভায় বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘গত কয়েক দিনে আমরা শতাধিক শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা সবাই বলেছে, তাদের কেউই ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত নয়। তাহলে এসব করছে কারা!’ তিনি বলেন, ‘চলমান ভাঙচুর, সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে। আড়ালে থেকে যারা বিশৃঙ্খলায় উসকানি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা ইতোমধ্যেই এনএসআই, ডিজিএফআইসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।’

শিল্পাঞ্চল পুলিশের সাবেক উপ-মহাপরিদর্শক আব্দুস সালাম বলেন, ‘শ্রমিকরা যেসব দাবিদাওয়া তুলেছে, সেগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের ঘাটতি আছে। শ্রমিকরা যদি আন্দোলন করতে রাস্তায় নামে, তাহলে তাদের কারখানায় ফেরানো খুব কঠিন হবে।’

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘পাঁচ বছর পরপর মজুরি বোর্ডের সভা বসে। কিন্তু নির্বাচনের আগে হওয়ায় দেশি-বিদেশি একটি চক্র এই সময়ের সুযোগ নিতে চাইছে; অনেক ষড়যন্ত্র ভর করেছে এই খাতে।’

বাংলাদেশে ‘দেশি-বিদেশি একটি চক্র’ বাক্যটি ভীষণ জনপ্রিয়। যে কোনো সঙ্গত কারণে শ্রমিকরা দাবি-দাওয়া পেশ করলেই মালিকপক্ষ এই বাণীটি সামনে নিয়ে আসেন। এটা আনার মানে সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে উসকানি দেওয়া। 

এরই মধ্যে দেশের সকল পোশাক কারখানায় সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। গত ৯ নভেম্বর এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সদস্যদের কারখানার গেটে নিয়োগ বন্ধ নোটিশ টাঙানোর নির্দেশনা দিয়েছে বিজিএমইএ।

সমন্বয় সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয়, যেসব কারখানার শ্রমিকরা কারখানায় গিয়েও কাজ করা থেকে বিরত থাকবেন বা কারখানা ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন, মালিকরা বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারা অনুযায়ী সেসব কারখানা বন্ধ করে দেবেন। এ ছাড়া যেসকল কারখানায় আগুন দেওয়া, ভাঙচুর বা মারামারির ঘটনা ঘটেছে, সেসব ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ বিজিএমইএর সিস্টেম অ্যানালিস্টকে দিতে হবে বলেও সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে বিজিএমইএর চিঠিতে।

এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মালিকরা শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি পাশ কাটাতে যতরকম পন্থা আছে তার সবকিছু ব্যবহার করছে এবং করবে। শ্রমিকপীড়নের ‘ব্যবস্থাসমূহ’ বিধিবদ্ধ করতে, সমাজের সকলের, বিশেষ করে ক্ষমতাবানদের সমর্থন পেতে উত্তর ও দক্ষিণের সিটি মেয়রকেও বৈঠকে রাখা হয়েছে।

 বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘করোনা মহামারির কারণে দেশের মধ্যে ২০২০-২১ সালে বন্ধ হওয়া কারখানার সংখ্যা ৩১৭টি। আর করোনা-পরবর্তী সময়ে অন্যান্য কারণে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে না পারার কারণে ২৬০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। শিল্পের উত্থানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বন্ধ কারখানার সংখ্যাও বাড়ছে। কারখানা বন্ধ হয়েছে নানা সংকটে। এ পর্যন্ত প্রায় ৬৮৮৫টি পোশাক কারখানা বিজিএমইএর সদস্যপদ গ্রহণ করলেও কালের পরিক্রমায় ৩৯৬৪টি সদস্য কারখানা বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ সালে বন্ধ হওয়া কারখানার সংখ্যা ৩১৭টি এবং পরে অন্যান্য কারণে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে না পারার কারণে ২৬০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে।’

দেখা যাচ্ছে মালিক পক্ষ করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, পশ্চিমা অর্থনৈতিক মন্দা, বিশ্বে খাদ্যশস্য উৎপাদনে মন্দাসহ সকল মন্দার দায়ভার গার্মেন্টস শ্রমিকদের ওপর চাপাতে চাইছেন। তাদের হিসাবেই ৩৯৬৪টি কারখানা বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়েছে। অথচ তারা দায় চাপানোর জন্য বলছেন, ‘মজুরি ঘোষণার পর থেকে বেশ কিছু কারখানায় অজ্ঞাতনামা কিছু উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিক অযৌক্তিক দাবিতে বেআইনিভাবে কর্মবিরতি পালন করে কর্মকর্তাদের মারধর করেছে। এ পরিস্থিতিতে আশুলিয়া, কাশিমপুর, মিরপুর ও কোনাবাড়ী এলাকার প্রায় ১৩০টি পোশাক কারখানা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।’ 

নিজেদের অপরিণামদর্শিতা, লুটপাট, চুরি-ডাকাতি আর বেশুমার বিলাস-ব্যসনে শিল্প উচ্ছন্নে যেতে বসেছে। বিদেশের বাজার হারাচ্ছে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত না করা ও অমানবিকভাবে খাটানোর কারণে। অথচ তার দায়ভার চাপিয়ে দিচ্ছে সেই শ্রমিকদের ওপরেই। এভাবে এই শিল্প বাঁচবে না। এটা  সময়মতো না বুঝলে শুধু শ্রমিকরা মরবে না, সমানভাবে মালিক পক্ষও ‘মরবে’।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //