ঋণের জালে হোঁচট খাচ্ছে থাইল্যান্ডের অর্থনীতি

থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে থাকেন ক্রিডসাদা আহজেদ। সূর্য থেকে বাঁচতে রাস্তার কোণে এক দোকানের ছায়ায় বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এখন সেই দিনটির কথা মনে করে ভারাক্রান্ত যেদিন ৪০ বছর বয়সী ট্যাক্সিচালক ক্রিডসাদা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন। এখন তার প্রতিদিনের উপার্জনের বেশিরভাগ অংশই ঋণ শোধ করতে চলে যায়।

ব্যাংক অব থাইল্যান্ডের মতে, দেশটিতে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঋণ গত বছর মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৮৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। এই ক্ষেত্রের ১.৫ বিলিয়ন ডলারই উচ্চ সুদের অনানুষ্ঠানিক ঋণ। ক্রিডসাদা একা নন, যিনি এই ঋণে জড়িয়ে আছেন। ক্রিডসাদার ব্যক্তিগত সংকট এক বিস্তৃত অস্বস্তির অংশ, যা থাইল্যান্ডের অর্থনীতিকে আঁকড়ে ধরেছে। গত কয়েক দশক ধরে সুদৃঢ় প্রবৃদ্ধির পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ার সব বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করছে থাইল্যান্ড। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশটিতে কম উৎপাদনশীলতা ও দুর্বল শিক্ষার সংমিশ্রণ রয়েছে। সেখানে স্বল্প বেতনের অদক্ষ বা কম দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা অনেক বেশি। 

থামাসাট বিজনেস স্কুলের আন্তর্জাতিক ব্যবসার অধ্যাপক পাভিদা প্যানানন্দ বলেন, ‘থাইল্যান্ড যে শুধু বৈশ্বিক রপ্তানি বাজার হারাচ্ছে তা-ই নয়, বিশ্বায়নের পরিবর্তিত বাস্তবতা ও প্রতিযোগিতার আঘাতও সহ্য করছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অগ্রগতির জন্য স্থানীয় পর্যায়ে দক্ষ জনশক্তি এবং সক্ষমতা প্রয়োজন। এ জন্য যেমন ক্রমাগত শ্রমশক্তির উৎকর্ষ প্রয়োজন; তেমনি স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থার বদলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠন করা দরকার। 

ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ থাইল্যান্ডের পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো করোনা মহামারির আঘাত থেকে দ্রুত ফিরে এসেছে। তবে থাইল্যান্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনামের ৫ শতাংশ বা তার বেশি প্রবৃদ্ধির তুলনায় থাইল্যান্ডের অর্থনীতি গত বছর মাত্র ১.৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি প্রতিবেশী মালয়েশিয়া প্রবৃদ্ধির কম পূর্বাভাসসহ ৩.৭ শতাংশ সম্প্রসারণ নিশ্চিত করেছে।

থাইল্যান্ডের মূল উপার্জনক্ষম খাত পর্যটন, যা মূল প্রবৃদ্ধির এক-পঞ্চমাংশ। এ খাত করোনাকালের ধাক্কা সামলে নেওয়ার পরও ২০২৪ সালে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, থাই অর্থনীতি চলতি বছর ২.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পাবে বলে তারা আশা করছে, যা ব্যাংককের নিজস্ব পূর্বাভাস থেকে কিছুটা ভালো। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম এবং মালয়েশিয়া ৪.৩ থেকে ৫.৮ শতাংশের মধ্যে প্রবৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রায় এক দশক সামরিক শাসনের পর গত বছর আগস্টে ক্ষমতায় আসা থাই প্রধানমন্ত্রী স্রেথা থাভিসিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে ‘সঙ্কটপূর্ণ’ ঘোষণা করেছেন। সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা স্রেথা নিজেকে গর্বিতভাবে থাইল্যান্ডের ‘সেলসম্যান’ বলে উল্লেখ করেন। সংস্কারবাদী মুভ ফরওয়ার্ড পার্টিকে অবরুদ্ধ করার জন্য রাজতন্ত্রের সঙ্গে একটি সমঝোতার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে ৬২ বছর বয়সী এ রাজনীতিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সন্ধান করতে এবং দেশটিকে বিশ্বব্যাপী উৎপাদন সরবরাহ চেইনের ভিত্তি হিসেবে প্রচার করতে বিশ্বভ্রমণ করেছেন। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যাংকক মৌলিক অর্থনৈতিক সংস্কার থেকে সরে এসেছে। আর এখন বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, থাই অর্থনীতি দ্রুত সমাধানের সুযোগ নেই।

সমালোচকরা বলছেন, থাইল্যান্ডের সামরিক নেতারা বছরের পর বছর ধরে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। তারা চীনের অর্থনৈতিক উত্থানের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল। সেই সঙ্গে ডিজিটাল যুগের উপযোগী একটি দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করতে যে শিক্ষা ব্যবস্থা দরকার, সেখানে অর্থায়নে অবহেলা দেখা গেছে। এতে গোটা একটা প্রজন্মের সম্ভাবনা নষ্ট হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক গত মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দুই-তৃতীয়াংশ থাই যুবক এবং প্রাপ্তবয়স্করা প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের নিচে এবং তিন-চতুর্থাংশের দুর্বল ডিজিটাল দক্ষতা রয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশনসের (আসিয়ান) মধ্যে থাইল্যান্ডের ইংরেজি ভাষার দক্ষতা সবচেয়ে কম।

অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে স্রেথা ১৬ বছরের বেশি বয়সী সব থাই কিশোরকে নগদ ১০ হাজার বাথ (২৮০ ডলার) প্রদানের প্রস্তাব করেছেন। সেই সঙ্গে আরও বেশি দেশকে ভিসামুক্ত সুবিধা করতে দেওয়া এবং ক্যাসিনোকে বৈধতা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এটিকে অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা অপচয়মূলক বলে মন্তব্য করেছেন। তবে সাধারণ থাই জনগণের ওপর এসব কোনো নীতির ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না। ব্যাংককের ৬১ বছর বয়সী লটারির টিকিট বিক্রেতা হু সেংবাই বলেন, মানুষ খরচ কমানোর কারণে গত কয়েক বছরে তার মাসিক আয় অর্ধেকেরও বেশি কমে হয়েছে। এখন তার আয় ১১০ ডলার। তিনি বলেন, ‘আমি এই সরকার বা কোনো সরকার সম্পর্কেই নিশ্চিত নই যে, তারা কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে। আমি কাজ করে উপার্জন করলে খাই, তা না হলে না খেয়ে থাকি। এখানে এভাবেই দিন কাটছে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //