বিশ্বে ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্য কমছে

১৭৮৫ সালের কথা। মার্কিন কংগ্রেস যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মুদ্রা প্রবর্তন করে, যার নাম ডলার। এই ‘ডলার’ শব্দটি স্প্যানিশ ও ডাচ ভাষা থেকে আগত। ১৭৯৪ সালের প্রথমদিকে ডলারকে রৌপ্য মুদ্রা হিসেবে তৈরি করা হতো; যার ওজন ছিল ২৭ গ্রাম। এর তিন বছর পর কাগজের নোট জারি করা শুরু করা হয়। এটি ‘গ্রিনবাক’ নামে পরিচিত। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে ডলার উত্থান মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। ওই সময় থেকে বিশ্ব মুদ্রা বাজারে ডলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ‘হার্ড কারেন্সি’ হিসেবে পরিগণিত হয়। আর এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে মুদ্রা হিসেবে ডলারের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। লেনদেন থেকে রিজার্ভ সব ক্ষেত্রেই ডলারের প্রচলন। বিশ্ববাণিজ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ ডলারে লেনদেন হয়। 

ডলারের এই আধিপত্য কমানোর চেষ্টা নতুন নয়। বিশ্বরাজনীতির মেরুকরণ এখন ভিন্ন রূপ নিয়েছে। রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে পশ্চিমাদের উত্তেজনা বেড়েছে। চীন ও রাশিয়ার ওপর একের পর এক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পর ডলারকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা আরও প্রকট হয়েছে। ডি-ডলারাইজেশন বা ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর যে উদ্যোগ চীন-রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক বাজারে আধিপত্য হারাচ্ছে পরাক্রমশালী মুদ্রাটি। ২০২৩ সালেও এ ধারা অব্যাহত ছিল।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে ডলারের পরিমাণ কমছে। ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে ডলারের ব্যবহার কমে ৫৯.২ শতাংশে নেমে এসেছে। আইএমএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারে ২০০০ সালের পর গ্রিনবাকের অংশীদারত্ব ৭০ শতাংশ কমেছে। রিজার্ভ কারেন্সির দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে ডলার। 

এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইউরো। ইউরোর অংশীদারত্ব ১৯.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে রিজার্ভে জাপানি ইয়েনের অনুপাত গত প্রান্তিকে ৫.৩ থেকে বেড়ে ৫.৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তবে চাইনিজ ইউয়ান, ব্রিটিশ পাউন্ড, কানাডিয়ান ডলার ও সুইস ফ্রাঁর অনুপাতে খুব বেশি পরিবর্তন দেখা যায়নি।

গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল মেসেজিং পরিষেবা সুইফটের তথ্যানুযায়ী, নভেম্বরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের লেনদেনে ইউয়ানের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বৈশ্বিক পর্যায়ে বেশি ব্যবহৃত মুদ্রা হিসেবে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে এ চীনা মুদ্রা। আন্তঃসীমান্ত পর্যায়ে ঋণগ্রহণেও ইউয়ানের ব্যবহার বেড়েছে। এ ছাড়া সৌদি আরব, আর্জেন্টিনাসহ বিদেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ৩০টির বেশি দ্বিপক্ষীয় মুদ্রা অদলবদল করছে পিপলস ব্যাংক অব চায়না। আন্তঃসীমান্ত লেনদেনে ইউয়ানের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার ডলার থেকে চীনের দূরে সরে আসার বিষয়টিকে প্রতিফলিত করে। 

গত ৪০ বছরে চীনের ব্যাপক উত্থান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফল ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণসীমা নিয়ে সম্প্রতি যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হলো, তাতে মার্কিন ডলারের আধিপত্য নতুন করে নজরদারিতে এসেছে। এ বাস্তবতায় রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ভিটিবির প্রধান নির্বাহী আঁদ্রেই কোস্তিন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মার্কিন ডলারের আধিপত্যের দিন শেষ হয়ে আসছে। কারণ চীনা মুদ্রা ইউয়ানের উত্থান ও রাশিয়াকে বাগে আনার পশ্চিমাদের ব্যর্থ চেষ্টা। সেই সঙ্গে বিশ্ববাসী পশ্চিমের এই ব্যর্থ চেষ্টার ঝুঁকির মুখেও পড়ে গেছে। অনেক দেশ এখন ডলারের বিকল্প হিসেবে অন্যান্য মুদ্রায় বাণিজ্য করছে এবং চীনা মুদ্রার ওপর নিষেধাজ্ঞার নীতি থেকে সরে আসছে। রাশিয়া এখন তৃতীয় দেশের সঙ্গেও চীনা মুদ্রায় লেনদেনের বিষয়ে আলোচনা করছে।’

ইউক্রেন সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে পশ্চিমা আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এ ছাড়া দেশটির বৈদেশিক রিজার্ভও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এর পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাণিজ্যিক লেনদেনে ডলারের পরিবর্তে দেশগুলো নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের প্রতি ঝুঁকছে। ইউরোপীয় ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ইবিআরডি) এক সতর্কবার্তায় জানায়, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাণিজ্যিক লেনদেনে রাশিয়া যেভাবে ইউয়ানের ব্যবহার বাড়াচ্ছে, তা অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ডলারের আধিপত্যকে আরও প্রভাবিত করবে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাব দিয়েই ডলার দুনিয়ার প্রধান মুদ্রা হয়ে ওঠেনি। যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি, সবচেয়ে বড় ক্রেতা, তারা বিশাল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি বজায় রাখে, তাদের আর্থিক বাজার অত্যন্ত খোলামেলা এবং সেখানে আইনের শাসনে বিনিয়োগের নিরাপত্তা আছে- এসব বিষয় ডলারকে রিজার্ভ, বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান মুদ্রায় পরিণত করেছে গত সাত দশকে।

এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অন্য কোনো মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে সমপর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের কিংবা ঋণের মূল্য পরিশোধ তাদের মুদ্রায় সম্পন্ন হওয়াই যথেষ্ট নয়। তাকে বেশকিছু অর্থনৈতিক সংস্কার করতে হবে- মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে দিতে হবে; সেই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; বিনিময় মূল্য স্থিতিশীল রাখা; সুদহার ও মুদ্রানীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার কঠিন চ্যালেঞ্জ কাঁধে নিতে হবে। যা কার্যত কোনো একক মুদ্রার জন্য এখনই নেওয়া সম্ভব নয়।

আইএমএফের পরিসংখ্যান অনুসারে, ব্রিকসের পাঁচটি দেশ বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে ৩২.৫ শতাংশ অবদান রাখে। আর সেখানে জি-সেভেনের হার ২৯.৯ শতাংশ। আর্জেন্টিনা যোগ দেওয়ার আগেই বেরিয়ে গেলেও ইরান, সৌদি আরব, মিশর, ইথিওপিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ব্রিকসে পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ পাচ্ছে। অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছে আরও অনেক দেশ। এর ফলে আগামী দিনে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক নতুন মেরুকরণ হবে।

ডলারের শোষণ-শাসন থেকে মুক্তির জন্য এর আগে বিক্ষিপ্তভাবে ইরাক, লিবিয়াসহ বেশ কিছু দেশ চেষ্টা করেছিল, পরিণতিতে ওই দেশগুলোর অর্থনীতি-রাজনীতি ধসে পড়েছে। তবে এবারের ডি-ডলারাইজেশনের প্রচেষ্টা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে জোরালো এবং এতে পরাক্রমশালী অর্থনীতির দেশগুলো জড়িত। পশ্চিমা আধিপত্যের বিপরীতে গ্লোবাল সাউথে রয়েছে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া ও ওশেনিয়ার অনেক দেশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলারের আধিপত্য খর্ব করতে একটি পরিষ্কার বিকল্প থাকতে হবে। আর এ বিকল্প খুঁজতে গিয়ে দ্বিধাবিভক্তি স্পষ্ট হয়ে পড়ে। যদি ডলারের বিকল্প হয় রুবল অথবা ইউয়ান অথবা রুপি, তাহলে কালের বিবর্তনে ডলারের মতো এই মুদ্রাগুলো বিশ্বকে শোষণ করতে থাকবে।

ব্রিকস বা অন্য কোনো জোটের জন্য স্বতন্ত্র মুদ্রা চালু করাও প্রায় অসম্ভব। অভিন্ন মুদ্রা চালু হলে সেখানে কোনো কোনো বড় অর্থনীতির দেশ আধিপত্য বিস্তার করবে। আর সেখানে সব দেশের অর্থনীতি এক রকম নয়। চীনের মতো নিয়ন্ত্রণশীল অর্থনীতির সঙ্গে তার বন্ধুস্থানীয় অনেক দেশই একমত নয়। ফলে অন্য দেশগুলো তাদের আর্থিক নীতি এর সঙ্গে মেলাতে চাইবে না।

আরেকটি বিকল্প হতে পারে- যার যার মুদ্রা সে সে ব্যবহার করবে, কোনো আন্তর্জাতিক মুদ্রা থাকবে না, দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে লেনদেন হবে। ডলারের বিকল্প হিসেবে ব্রিকসের দেশগুলো বড় পরিসরে নিজেদের মুদ্রায় লেনদেন শুরু করতে পারে। চীন-রাশিয়ার মধ্যে ৮০ শতাংশ বাণিজ্য রুশ বা চীনা মুদ্রায় হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া অন্য দেশগুলোর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। ডলারের আধিপত্যের বিরুদ্ধে অভিন্ন জোটগত মুদ্রা চালুর চেয়ে এটা কার্যকর কৌশল বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এই বিকল্পটি বর্তমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে খুবই বৈষম্যপূর্ণ বিশ্বে বাস্তবসম্মত নয়। অনেকের মতে, ক্রিপ্টোকারেন্সিও একটি বিকল্প হতে পারে, যেখানে মুদ্রার ওপর কোনো দেশের একক নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে এ মুদ্রাকে স্বীকৃতিও দিয়েছে। আবার অনেকের মতে, বিকল্প হতে পারে ফিয়াট কারেন্সির পরিবর্তে কমোডিটি কারেন্সির প্রচলন আবার শুরু করা। অর্থাৎ স্বর্ণ বা অন্য কোনো বস্তুর ব্যবহার। ১৯৭০-র দশকে পেট্রোডলার ব্যবস্থার আগে যেমনটা ছিল। তবে বিকল্প যেটাই হোক অথবা কোনো একক বিকল্প শিগগিরই না এলেও ডলারের আধিপত্যের রূপ আগের মতোই থাকছে না; আবার রাতারাতি তা উবেও যাচ্ছে না। চীন-রাশিয়ার যৌথতা ও নতুন বিশ্ব বাস্তবতায় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, মুদ্রানীতি পরিবর্তিত হচ্ছে। সে পরিবর্তনের গতিপথে ডলারের আধিপত্য আগামী কয়েক বছরে আরও খর্ব হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //