কপ-২৮ এবং জাপানের অনুসরণীয় উদাহরণ

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন বা কপ-২৮-এ এবার সব দেশই জলবায়ু পরিবর্তনে একটি টেকসই বৈশ্বিক চুক্তির বিষয়ে আন্তরিক ছিল। সম্মেলনের প্রথম দিনই জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিশিদা ফুমিও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাসে তার দেশের নেওয়া সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো তুলে ধরেন।

জাপানের এই পদক্ষেপগুলো এবার সারা বিশ্বকে নিঃসন্দেহে অনুপ্রাণিত করবে। জাপান সরকার দেশটিতে নতুন করে কোনো কয়লাভিত্তিক জ্বালানি কেন্দ্র স্থাপন না করার সাহসী এবং উদ্দীপক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। জাপানের নেওয়া এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন যদি দীর্ঘ মেয়াদে বজায় থাকে, তাহলে কার্বণ নিঃসরণ হ্রাসে তা একটি অনুসরণীয় উদাহরণ হিসেবে পথ দেখাতে পারে। কেননা জাপান এমন একটি দেশ, কার্বন গ্যাস নিঃসরণে ভূমিকা রাখা দেশগুলোর মধ্যে যার অবস্থান সপ্তমে। 

কার্বন গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা হ্রাসে জাপানের এই ইতিবাচক ভূমিকা নেওয়ার পেছনে নিজ দেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা অনেকটাই কাজ করছে। এ বছরও জাপানের পূর্বাঞ্চলের তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৩৯ ডিগ্রিতে পৌঁছেছিল। তারা ভালোভাবেই উপলব্ধিতে আনতে পেরেছে, যদি কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ হ্রাস না করতে পারে তাহলে তাদের দেশের তাপমাত্রা ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া সেখানকার বিশেষজ্ঞরাও শঙ্কা প্রকাশ করে আসছে, জাপানে ভূমিধস ও বন্যার ঘটনা বেড়ে চলেছে। এই মুহূর্তে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা হ্রাস না করতে পারলে এসব     প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। 

২০২১ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশেষ দূত জন কেরি জাপান সফর করেন। সেই সময়ে জাপান জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব রোধে দেশটির নেওয়া কয়েকটি জোরালো পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করে। সে সময় কেরির সঙ্গে জাপানের পরিবেশমন্ত্রী শিনজিরো কোইজুমি একটি বৈঠকে মিলিত হন এবং কার্বন নিঃসরণের মাত্রা হ্রাসে তার দেশের কয়েকটি পদক্ষেপ জানানোর পাশাপাশি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কয়েকটি যৌথ উদ্যোগে সম্মতি জানান। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-জাপান অংশীদারত্বের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান জ্বালানির পুনর্ব্যবহার, কার্বন প্রক্রিয়াকরণ, শিল্প খাতকে কার্বনমুক্তকরণ এবং জলবায়ুর কারণে কৃষির সম্প্রসারণে সহযোগিতা বৃদ্ধিসহ বেশ কয়েকটি উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য ছিল। 

দুটি দেশই ২০২১ সালের মধ্যে কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতি সরকারি নতুন এবং সরাসরি সমর্থন বন্ধে সম্মত হয়েছিল। এ ছাড়াও জলবায়ু সম্মেলনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতিটি উন্নত দেশের প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার যে অঙ্গীকার, সেখানে এই দুটি দেশ নিজেদের ভাগ সঠিকভাবে পরিচালনায় সম্মত হয়েছিল। 

এর আগে ২০২০ সালেই জাপান আগামী ১০ বছরে ৪৫/৪৬ থেকে ৫০ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর এবং ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরোতে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছিল। এর কাছাকাছি সময়ে জাপানের সরকার নতুন সবুজায়নের একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে, যার নাম দেওয়া হয়েছে-‘জিএক্স’। এই পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ডিকার্বনাইজেশনকে উৎসাহিত করার পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় এবং বিকল্প জ্বালানির স্থায়িত্ব তৈরি করার প্রত্যয় নেওয়া হয়। জাপান এই মুহূর্তে একটি নতুন ধরনের জ্বালানি পদ্ধতি চালু করেছে, যাতে কয়লার সঙ্গে অ্যামোনিয়ামের ব্যবহার করা হয়। এ কারণে জ্বালানি দহনের সময় কার্বন নিঃসরিত হয় না। এ ছাড়াও দেশটি কয়লাভিত্তিক জ্বালানি কেন্দ্রগুলোতে কার্বন গ্যাস সংক্রান্ত নতুন প্রযুক্তি সিসিইউএসের ব্যবহারের মাত্রা বাড়িয়ে চলছে। 

কয়লা খুবই অপরিষ্কার ধরনের জ্বালানি। পরমাণু, সৌর এবং বাতাসকেন্দ্রিক জ্বালানির তুলনায় কয়লার ক্ষেত্রে বেশি মাত্রায় গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়। এবারের কপ-২৮-এর অন্যতম প্রধান আলোচিত বিষয় হলো জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার হ্রাস। ২০৩০ সাল পর্যন্ত জাপানের মোট জ্বালানির ৪১ শতাংশই আসবে কয়লা থেকে আর ৩৬ থেকে ৩৮ শতাংশ হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক। এ ছাড়া ২০ থেকে ২২ শতাংশ পরিচালিত হবে পরমাণুভিত্তিক। এখন জাপান পদক্ষেপ নিচ্ছে যে কয়লাভিত্তিক জ্বালানি প্রধান থাকলেও ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ অন্তত ৪৬ শতাংশ কমিয়ে আনার। 

পৃথিবীতে যে পরিমাণ কার্বন গ্যাস নির্গত হয়, তার অর্ধেকের জন্য দায়ী এশিয়ার দেশগুলো। কিন্তু এই মহাদেশের এমন কিছু দেশ আছে, যারা ডিকার্বনাইজেশনের বিষয়ে কঠোর নিয়ম পালন করতে অনিচ্ছুক। এবার কপ-২৮-এর উদ্বোধনী সেশনে জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিশিদা ফুমিওর ডিকার্বনাইজেশনে এশিয়াকে নেতৃত্ব দেওয়ার দৃঢ়প্রত্যয় বড় ধরনের আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে। ইতোমধ্যে জাপান পরের মাসেই কার্বন নিঃসরণের মাত্রা হ্রাসের বিষয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংস্থার একটি সম্মেলনের আয়োজক দেশ হতে রাজি হয়েছে।

কপ-২৮-এর বক্তৃতায় কিশিদা বলেছেন, কার্বন গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা হ্রাসে নিজের দেশের অভিজ্ঞতাকে এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্ব করার লক্ষ্যে জাপান এশিয়া শূন্য শতাংশ কার্বন গ্যাস নিঃসরণ সম্প্রদায় (এজেডইসি) নামে একটি ধারণাপত্র তৈরি করেছে। 

যদিও আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিষয়ক গ্রুপ ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক বা কান সবসময়ই অভিযোগ করে আসছে, জাপানের এসব উদ্যোগ ও প্রযুক্তি ব্যবহার প্রকৃত কার্বন গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা হ্রাসের পথ থেকে অনেক দূরেই অবস্থান করছে। তারা জাপানকে ‘গ্রিনওয়াশিং’ এবং ‘কার্যকর উদ্যোগ থেকে অনেক দূরে’ বলে অভিযুক্ত করে আসছে। তারা বলছে, জাপানের এজেডইসি উদ্যোগ বরং এশিয়ার দেশগুলোতে কয়লার ব্যবহার দূর করার বদলে জ্বালানি হিসেবে কয়লা ও গ্যাসের ব্যবহারকে দীর্ঘায়িত করছে। কয়লার সঙ্গে অ্যামোনিয়া কিংবা হাইড্রোজেনের ব্যবহারের যে প্রযুক্তির ওপর জাপান জোর দিচ্ছে, সেটা এখনো খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং বাণিজ্যিকভাবে এই প্রযুক্তি চালু করতে আরও বহু বছর লাগতে পারে। বিতর্ক ও আপত্তি সত্ত্বেও দুবাইতে কানের পক্ষ থেকে জাপানকে নিরুৎসাহিত করার বদলে পুরস্কৃত করে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।

‘টুগেদার ফর অ্যাকশন’ শীর্ষক কপ-২৮-এর প্যাভিলিয়ন থিমে জাপানের মতো শীর্ষ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী দেশগুলোর তালিকায় থাকা একটি দেশের সাম্প্রতিক সময়ে ডিকার্বনাইজেশনের নানা উদ্যোগ কিছুটা সার্থক মাত্রা ও উৎসাহ তৈরি করছে। এখন কিশিদা ফুমিওর নেতৃত্বাধীন জাপান সরকারের নানা উদ্যোগ আর প্রযুক্তি ব্যবহারের বিভিন্ন মডেলের প্রদর্শন কপ-২৮-কে ভিন্ন মাত্রা দিচ্ছে। 

নানা বিতর্ক আর ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও কপ-২৮-এ জাপানের তৈরি করা ডিকার্বনাইজেশনের মডেল কি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় উন্নত বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মধ্যে সদিচ্ছা তৈরি করতে পারবে? সেই প্রশ্নই এবার কপ-২৮ সম্মেলনে বিভিন্ন মহলে উঁকি দিয়ে বেড়াচ্ছে।

দ্য ডিপ্লোম্যাট অবলম্বনে

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //