বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট নিরসনের কোনও সুখবর নেই

করোনা মহামারির কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকোচনের পর বৈশ্বিক অর্থনীতি যখন মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল, তখনই শুরু হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। এর মাঝেও বেশ কিছু দেশ ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। এবার গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নতুন করে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, অর্থনৈতিক সংকট অচিরেই কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। বরং তা আরও গভীর ও দীর্ঘ হচ্ছে। অর্থনীতির অনেকগুলো সূচকই আরও দুর্বল হয়েছে। জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খাদ্য সংকট এ অবস্থাকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগ্রাসীভাবে চলতি বছরেই ছয়বার নীতি সুদের হার বাড়িয়েছে। তারপরও মূল্যস্ফীতি তেমন কমছে না। বরং এর ফলে বিশ্বমন্দার আশঙ্কা আরও বাড়ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, খারাপ সময় আসা এখনো আরও বাকি। বিশ্বে সামনে প্রবৃদ্ধি আরও কমবে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে। অর্থাৎ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আগামী বছর ভালো কিছু দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেওয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ নতুন চাপ তৈরি করতে পারে বলে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি চলমান পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, করোনা মহামারির প্রভাবে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর অর্থনীতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব দেখেছে বিশ্ব। বেড়েছে খাদ্য পণ্যের দাম, মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদ হার বাড়িয়েছে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এসব পদক্ষেপের সুফল পুরোপুরি ঘরে তোলার আগেই শুরু হয় গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন। অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য নতুন চাপ তৈরি করতে পারে এই সংঘাত। কারণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক জ্বালানি তেলের মূল্য। 

রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল-গ্যাস উৎপাদক। সে তুলনায় ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল কোনো পক্ষই তেল রপ্তানিকারক নয়। তারপরও যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে এরই মধ্যে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। কারণ বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জ্বালানি তেলের জোগানদাতা মধ্যপ্রাচ্য। এছাড়াও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংযোগপথের কারণে মধ্যপ্রাচ্য বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। 

চলতি বছরের জুন মাসের পর তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছিল। এক পর্যায়ে তা ব্যারেলপ্রতি ৯৫ ডলারে উঠে যায়। তবে এরপর তেলের দাম আবার কমতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে ব্যারেলপ্রতি ৮৪ ডলারে নেমে আসে। গত ৯ অক্টোবর ব্রেন্ট ক্রুডের বৈশ্বিক মূল্যসূচক ৪.২ শতাংশ বেড়ে প্রতি ব্যারেলের দর পৌঁছায় ৮৮ ডলার ১৫ সেন্টে। একই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের প্রধান মূল্যসূচক ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ৪.৩ শতাংশ বেড়ে ব্যারেলপ্রতি দর ৮৬ ডলার ৩৮ সেন্ট হয়। এরই মধ্যে কিছু আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনস ফ্লাইট বাতিল করেছে। এই পরিস্থিতিতে চলমান সংঘাতের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা।

বৈশ্বিক অর্থনীতি আগামী কয়েক বছরে শ্লথগতির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির অর্ধবার্ষিক গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছর বৈশ্বিক প্রকৃত জিডিপি ২.১ শতাংশ বাড়বে। জানুয়ারিতে ২০২৪ সালের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন ২.৭ শতাংশ করলেও নতুন প্রাক্কলনে কিছুটা কমিয়ে ২.৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক বাস্তবতা ২০২৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধে এবং ২০২৪ সালের মধ্যে প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন আরও কমিয়ে আনতে পারে এমনটাও আশঙ্কা রয়েছে। তবে ২০২৫ সালের প্রাক্কলনে প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করা হচ্ছে ৩ শতাংশ।

প্রায় ২০ মাস আগে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশ্ব যখন ভুগছে, তখন ফিলিস্তিনে নতুন করে যুদ্ধ বেধে যাওয়া পুরো বিশ্বকেই বেকায়দায় ফেলে দিতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন করে পদক্ষেপ নিতে হতে পারে। তবে পুরো বিষয় নির্ভর করছে যুদ্ধ কতটা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং কতটা ছড়িয়ে পড়ে তার ওপর। এ বিষয়ে ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টসের জিএম অগাস্টিন কারস্টেনস বলেন, ‘আকস্মিক এ যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের বাজার ও শেয়ারবাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। তবে এর প্রভাব কতটা বিস্তৃত হবে তা এত তাড়াতাড়ি বলা কঠিন।’

গবেষণা প্রতিষ্ঠান নর্দান ট্রাস্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ কার্ল টানেনবাম বলেন, ‘অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব ঘটে, ঝুঁকির পরিমাণ বাড়ে এবং বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো সংঘাত জ্বালানি তেলের বাজারকে প্রভাবিত করে। ফলে তেলের দাম কোন দিকে যায় সেটিও দেখার বিষয়। কয়েক দশক ধরে অস্থিতিশীলতায় থাকা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে এ সংঘাত ভিন্নমাত্রা যোগ করবে। পরিস্থিতি যেদিকে যাবে বাজারও সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখাবে।’

ভূ-রাজনৈতিক টানাপড়েনের কারণে যখন অনিশ্চয়তা বাড়ছে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে- এমন এক বাস্তবতায় মরক্কোর মারাকেশে ১২ ও ১৩ অক্টোবর দুই দিনব্যাপী বৈঠক করেছেন জি-২০ সদস্য দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা। সেখানে যুদ্ধ ও সংঘাতে নিপীড়িত মানুষের অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। পাশাপাশি বৈঠককে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জি-২০ জোট আন্তর্জাতিক আইন, আঞ্চলিক সীমা ও সার্বভৌমত্বের ওপর জোর দেয়। সর্বশেষ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জি-২০ সদস্যরা একমত হয়েছিল। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিভাজন তৈরি হয় সংস্থাটিতে। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সুস্পষ্ট বিভাজন ছিল চীন ও রাশিয়ার। এজন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রায়ই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে সম্প্রতি বৈঠকে দীর্ঘদিন পর একমত হয় সদস্যদেশগুলো।

জাপানের অর্থমন্ত্রী শুনিচি সুজুকি মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখনো অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এটি ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় আরও তীব্র হবে। জি-২০-এর বিবৃতিতে বলা হয়, ‘প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য মুদ্রা, আর্থিক নীতি ও সুসংহত নীতিমালায় জোর দেওয়া হয়েছে। বৈষম্য কমিয়ে এনে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’ চীনের শ্লথতার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কিছুটা উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে এনেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। জি-২০ সদস্যদেশগুলোর মধ্যেও রয়েছে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সংকট।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অঞ্চলে সৌদি আরব, ইরান ও কাতারের মতো শীর্ষ জ্বালানি উৎপাদক দেশগুলোই শুধু অবস্থান করছে না, সেই সঙ্গে সুয়েজ খালের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথও রয়েছে। ফলে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরবে। থ্রি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ কারিম বাস্তা বলেন, ‘এই যুদ্ধের ফলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে পারে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ঝুঁকি ও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //