আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার সংঘাত এবং আন্তর্জাতিক নিষ্ক্রিয়তা

বিতর্কিত নাগার্নো-কারাবাখ ভূখণ্ড ঘিরে আবারও আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। সপ্তাহ খানিকের বেশি সময় আগে কারাবাখে আর্মেনিয়ার সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাস নির্মূল’ নামে সামরিক অভিযান শুরু করে আজারবাইজানের বাহিনী। কিন্তু রাশিয়ার হস্তক্ষেপের ২৪ ঘণ্টার মাথায় আত্মসমর্পণ করে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। চুক্তি অনুযায়ী অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেয় তারা। এরপরই জাতিগত আর্মেনিয়ানরা আতঙ্কে অঞ্চলটি ছাড়তে শুরু করেছে। নতুন করে উত্তেজনার আগে দেড় লাখের বেশি জনসংখ্যা ছিল এখানে। গত কয়েক দিনে নারী ও শিশুসহ আর্মেনিয়ার মূল ভূখণ্ডে প্রবেশের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১ লাখের বেশি।

এ নিয়ে ৩০ বছরে তৃতীয়বার ও তিন বছরে দ্বিতীয়বার নাগার্নো-কারাবাখ অঞ্চল ঘিরে আজারবাইজান ও জাতিগত আর্মেনিয়ার মধ্যে সংঘাতের ঘটনা তৈরি হলো। এই সংঘাত ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এক রকম ব্যর্থতারই পরিচয় দিয়েছে। এবারের সংঘাত মাত্র কয়েক দিন স্থায়ী হয়েছে। কিন্তু এই সংঘাত অনেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। গণবাস্তুচ্যুতি এবং বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে অস্থিরতা উসকে দিতে পারে। বলা চলে, আরেকটি বড় মানবিক বিপর্যয় দৃশ্যপটে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ বলেছেন, এই লোকদের তিনি আজারবাইজানের সমাজের সঙ্গে একীভূত করতে ইচ্ছুক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কয়েক দশকের সংঘাত ও নৃশংসতার পর দুই পক্ষের মধ্যে বিশ্বাসের জায়গাটা শূন্য এবং শত্রুতার মাত্রাটা অনেক বেশি। এই গভীর সংকটের পেছনে আন্তর্জাতিক মহলের নিষ্ক্রিয়তা একটা ভূমিকা রেখে আসছে। একদিকে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ আর্মেনিয়ার ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলেছেন। অথচ তার দেশের সামরিক বাহিনী নাগার্নো-কারাবাখের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দখলে নিচ্ছে। এছাড়া আজারবাইজান তাদের ছিটমহল নাখছিভানের জন্য ‘স্থল করিডর’ তৈরির পথ খুঁজছে। ধারণা করা যাচ্ছে, এটি দুই দেশের মধ্যে জটিলতা আরও বাড়াবে।

কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (সিএসটিও) আওতায় আর্মেনিয়ার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করার কথা রাশিয়ার। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর চুক্তিটি সম্পাদিত হয়। এ কারণেই নাগার্নো-কারাবাখে আর্মেনিয়ানদের স্বার্থরক্ষায় তাদের অনেক কিছু করা উচিত। কিন্তু প্রতিবার সংঘাতের পর সিনেমার কায়দায় যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা ছাড়া আর কিছুই করে না মস্কো। 

রাশিয়া কখনোই আজারবাইজানের শত্রু হতে চায় না। সে কারণে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উত্তেজনায় হস্তক্ষেপ করতে তারা উৎসাহী নয়। এ কারণেই রাশিয়া আর্মেনিয়ার ভূখণ্ডে ঢুকে আজারবাইজানের হামলা বন্ধে আর্মেনিয়ার অনুরোধ কানে তোলে না। এমনকি সর্বশেষ হামলায় রাশিয়ার পাঁচজন শান্তিরক্ষী মারা যাওয়ার পরও তারা নিশ্চুপ। ওই অঞ্চলের সংঘাত নিয়ে রাশিয়া একমাত্র চোখ বন্ধ করে রেখেছে, তা নয়; সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী করার অঙ্গীকার দেওয়া সত্ত্বেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র তিন দশক ধরে চলা রক্তপাত বন্ধে এবং সেখানে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখায়নি। ১৯৯৪ সালে প্রথম নাগার্নো-কারাবাখ যুদ্ধে আর্মেনিয়ান বাহিনী ছিটমহলের চারপাশের আজেরি (আজারবাইজানে যে জাতিগোষ্ঠী) সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সে সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আজারবাইজানের সঙ্গে আলোচনায় বসার এবং দুই পক্ষের জন্য একটি টেকসই শান্তিচুক্তি করতে আর্মেনিয়াকে কোনো চাপ দেয়নি। অবশ্য এবার সংকট শুরু হওয়ার পর সেখানে জাতিসংঘের একটি পর্যবেক্ষণ দল পৌঁছেছে। কিন্তু এখনকার নখদন্তহীন জাতিসংঘ সেখানকার শান্তি প্রতিষ্ঠায় কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে, সেটা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন থেকে যায়। 

আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যবর্তী এই দ্বন্দ্ব শতাব্দীপ্রাচীন। ১৯০৫-১৯০৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ককেশাস অঞ্চলে মুসলিম (তখন ‘ককেশিয়ান তাতার’ নামে পরিচিত ছিল) এবং আর্মেনীয়দের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ১৯১৮ সালে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া রাশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে একটি প্রলম্বিত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯১৮-১৯২০ সালে সংঘটিত প্রথম আর্মেনীয়-আজারবাইজানি যুদ্ধের ফলে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার একাংশ সোভিয়েত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং আর্মেনিয়ার বাকি অংশ তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তৎকালীন সোভিয়েত সরকার জাতিগত আর্মেনীয়-অধু্যুষিত নাগার্নো-কারাবাখ অঞ্চলকে আজারবাইজানি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করে, কিন্তু একই সঙ্গে নাগার্নো-কারাবাখকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। আর্মেনিয়া ও নাগার্নো-কারাবাখের আর্মেনীয়রা এই সমাধানে সন্তুষ্ট ছিল না এবং ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত সরকারের দুর্বলতার পরিপ্রেক্ষিতে নাগার্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

১৯৮৮-১৯৯৪ সালে দ্বিতীয় আর্মেনীয়-আজারবাইজানি যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে নাগার্নো-কারাবাখের আর্মেনীয়রা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ‘আর্তসাখ প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করে। এই যুদ্ধে আর্মেনিয়া ও আর্তসাখ আজারবাইজানকে পরাজিত করে এবং যুদ্ধের ফলে সাবেক নাগার্নো-কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশসহ এর পার্শ্ববর্তী সাতটি আজারবাইজানি জেলার সম্পূর্ণ/আংশিক ভূখণ্ড আর্তসাখের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আর্মেনিয়া আর্তসাখকে সর্বতোভাবে সহায়তা করে, কিন্তু এখন পর্যন্ত আর্মেনিয়া বা জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্র আর্তসাখকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। অর্থাৎ আর্তসাখ-নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আজারবাইজানের ভূখণ্ড।

এই মুহূর্তে আজারবাইজানের নাগার্নো-কারাবাখ বিজয় আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের জনসমর্থন কমাবে। ২০১৮ সালে গণতন্ত্রপন্থিদের অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসা পাশিনিয়ানের গ্রহণযোগ্যতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে সামরিক অভিজাতেরা আবার ক্ষমতায় ফিরতে পারে এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করে ফেলতে পারে।

এই সময়ে এসে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ আর্মেনিয়ার ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলেছেন। অথচ তার বাহিনী নাগার্নো-কারাবাখের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দখলে নিচ্ছে। এ ছাড়া আজারবাইজান তাদের ছিটমহল নাখছিভানের জন্য ‘স্থল করিডর’ তৈরির পথ খুঁজছে। এই উদ্যোগ দুই দেশের মধ্যে জটিলতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা এবং ক্রমবর্ধমান দুই দেশের জাতিগত বৈরিতার কারণে এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সুদূরপরাহত বিষয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //