ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ন্যাটোর সম্ভাবনা কতটা

যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্র গোষ্ঠী বিশ্বের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে এক অসম কিংবা কিছু ক্ষেত্রে সমকক্ষ প্রতিযোগিতার মধ্যে যখন আবর্তিত হচ্ছে তখন ইউরোপের আরেক অংশে অশান্তির আগুন জ্বলছে ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। যুদ্ধের প্রারম্ভিক ইন্ধন ছিল ইউক্রেনের ন্যাটোতে অংশ নেওয়ার ইচ্ছাকে কেন্দ্র করেই।

যদিও পুতিনের জন্য কঠিন এক যুদ্ধের পটভূমি রচনায় মন্ত্রেরও জোগানদাতার ভূমিকায় ছিল পরাশক্তিধর দেশগুলো। তবে বৃহৎ সামরিক জোট ন্যাটো তাদের শক্তির পরিধি বাড়াতে গোপনে তৎপরতা চালাচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে। আর এই বিষয়টিকে মিডল ইস্ট আইয়ের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট জোনাথন ফেনটন হার্ভে ভিন্নভাবে তার গবেষণাপত্রে বেশ তাত্ত্বিকভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনটি প্রশ্নের সমন্বয়ে তিনি খুঁজতে চেয়েছেন এর সমাধান। সেগুলোর বিশ্লেষণ থেকে আমাদের অনুসন্ধান ও প্রসঙ্গটির গভীরতা খুঁজে বের করা। 

ন্যাটো এবার ইন্দো-প্যাসিফিক বলয়কে ঘিরে সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে আসলেই কীভাবে কাজ চালাচ্ছে? সম্প্রতি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে চীনের পুনরুত্থানের পর সমীকরণ কিন্তু অনেকটাই পাল্টে গেছে মার্কিন মুল্লুক ও ন্যাটোর জন্য। তাই উত্তর খুঁজতে আরও কিছু বিষয়ের অবতারণা করা উচিত। প্রশ্ন হচ্ছে- ইন্দো-প্যাসিফিকে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর ভবিষ্যৎ বা ভাগ্য ন্যাটোর কাছে কতটা নিরাপদ, আর অভিন্ন স্বার্থরক্ষা ইস্যুতে কতটা কার্যকর থাকবে তারা। অভিন্ন এ অর্থে যে এ অঞ্চলে ন্যাটোর একটাই উদ্দেশ্য, চীনের আধিপত্য থেকে নিজেদের নিরাপদ অবস্থানে রাখা।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, এশিয়া প্যাসিফিক পার্টনারস (এপি-৪) নামে পরিচিত চার দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান ন্যাটোর বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থিত থাকছেন। যা একটি ভিন্ন ইঙ্গিত। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সম্মেলনে অংশগ্রহণের পরই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যে ন্যাটো শক্তি বিস্তারের সবুজ সংকেত পেতে যাচ্ছে তা বুঝতে কারও বাকি ছিল না। 

গত বছর দেখা গেছে, ইউক্রেন ইস্যুতে সরাসরি কিয়েভের পক্ষে অবস্থান নেয় জাপান ও অস্ট্রেলিয়া, যা ভিলনিয়াস সম্মেলনে স্পষ্ট ছিল। এ সুযোগে সাইবার নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য সহযোগিতামূলক কাজে ইন্দো-প্যসিফিক অঞ্চলে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আলাদা চুক্তিও করে ন্যাটো। এছাড়াও এ অঞ্চল তাইওয়ানের ওপর চীনের দখলদারি মনোভাবের কারণে কয়েকটি দেশ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বলেও ন্যাটোর কাছে গোপনে নালিশ করেছিল। সর্বশেষ জাপানে ন্যাটোর লিয়াজোঁ অফিস স্থাপনের প্রস্তাব যেন এই হিসাবগুলো সহজ করে দেয়। ফ্রান্সের ভেটোর মুখে আপাতত এ কার্যক্রম স্থগিত হলেও ন্যাটো প্রধান জেনারেল জেনস স্টলটেনবার্গ সম্ভাবনা একেবারেই নাকচ হয়ে যায়নি বলে জাপানকে আশ্বাস দেন। 

সকল তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এটি স্পষ্ট ইন্দো-প্যাসিফিকে এবার ন্যাটো তাদের ঘাঁটি স্থাপনে বদ্ধপরিকর। মূলত ইউরোপের সঙ্গে এ অঞ্চলের একটি সংযোগ স্থাপনের জন্যই এমন উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে বলে বিশ্লেষকদের মন্তব্য। অন্যদিকে ন্যাটো শুরুর দিকে ইউরো-আটলান্টিক অঞ্চলের নিরাপত্তার বিষয়কে মাথায় রেখেই প্রতিষ্ঠাকালীন কার্যক্রম শুরু করেছিল। কিন্তু সময়ের আবর্তে চীনা প্রভাবমুক্ত বিশ্ব কল্পনার ভাবনা থেকেই মার্কিন সরকার এ অঞ্চলের দিকে ন্যাটোকে নজর দেওয়ার বিশেষ তাগিদ দেওয়া শুরু করে। 

প্রশ্ন দাঁড়ায়-ন্যাটোর এমন উদ্যোগ চীনকে কতটা প্রভাবিত করবে? গত বছর ন্যাটোর এমন সংকেত আঁচ করতে পেরেই মস্কো ও অন্যান্য পুতিন ঘরানার বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে ভৌত অবকাঠামো খাতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগে মনোযোগ দেয় চীন। একই সঙ্গে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তারে কৌশলগতভাবেই বেশ কিছু পদক্ষেপও নেয় শি জিনপিং প্রশাসন। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ অঞ্চলে চীনের শক্তি অবশ্যই বেশি। আর এটিকে কাজে লাগিয়েই ন্যাটোর প্রতি হুমকির সীমা টেনে শি বলেছিলেন, ন্যাটোর কোনোভাবেই উচিত হবে না পূর্ব এশিয়ার দিকে নজর দেওয়া। যদি এখানে ন্যাটো তাদের শক্তি বিস্তারে দৃঢ় থাকে তবে এ অঞ্চল ঘিরে ভবিষ্যতে কোনো উত্তেজনা তৈরি হলে তার জন্য দায়ী থাকবে সংস্থাটি। অন্যদিকে ন্যাটো এমন হুমকি আমলে না নিয়ে এ অঞ্চলে তাদের কর্মপরিধি বিস্তারের সম্ভাবনাকেই বড় করে দেখছে। 

সম্প্রতি জাপানে লিয়াজোঁ অফিস প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা কিন্তু তাদের নীরব অভিলাষের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ বলে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তবে অনেকটাই নীরবে ও ধীরগতিতে এ অঞ্চলকে ঘিরে ন্যাটোর কর্মযজ্ঞ চলছে। আপাতত পরামর্শক হিসেবেই সংস্থাটি তাদের ভূমিকা বহাল রেখেছে। এদিকে এপি-৪’র ইউক্রেনের প্রতি আস্থার হিসাবকে কূটনীতিক বিশ্লেষকরা দেখছেন ন্যাটো ও এ অঞ্চলের মধ্যকার নাটক মঞ্চায়নের পর্দার আড়ালের প্রস্ততি হিসেবে। কিন্তু ন্যাটো আসলেই এই অঞ্চলে তাদের শক্তির জানান দিতে পারবে কিনা সে প্রশ্নে এখনো সন্দেহ রয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের ভাষ্য, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে জোটটির দৃশ্যমান উপস্থিতি আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর পাশপাশি মার্কিন নির্ভরতার উপস্থিতিও নিশ্চিত করা। অন্যদিকে সীমান্ত ইস্যুতে বিরোধ সত্ত্বেও চীনের সঙ্গে শক্তিশালী অর্থনৈতিক বিষয়সহ দ্বিপক্ষীয় নানা ইস্যুতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। এমন পরিস্থিতিতে ন্যাটোর সঙ্গে খুব কৌশল নিয়েই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকার নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছে, যা ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতোই। আর চিরবন্ধু রাশিয়ার প্রতিও ইউক্রেন যুদ্ধে নীরবতা পালন করায় ভারত বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় থাকার চেষ্টা চালিয়ে কুল-শ্যাম দুটিই রক্ষায় ব্যস্ত। 

এ প্রেক্ষাপটে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ন্যাটো কতটা জোরালো অবস্থান তৈরিতে সক্ষম হবে সেখানেও রয়েছে বিশ্লেষকদের নানা অভিমত। এমন বহুমাত্রিক রূপরেখা এ অঞ্চলে পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে অক্ষম বলেও বলছেন অনেকেই। দ্বিপক্ষীয় নানা চুক্তি, আঞ্চলিক সহযোগিতার পথকে প্রসারিত করা, নিরাপত্তা ইস্যু ও ইন্দো-প্যাসিফিক এবং ন্যাটোর মধ্যকার সরাসরি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে তাতে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করতে দুপক্ষের ভাবনার অস্তিত্ব এখনো দৃশ্যমান। তবে এই কর্মযজ্ঞের ফলাফল দেখতে কিছুটা সময় হয়তো লাগবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //