নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটে পাকিস্তান

অর্থনৈতিক সংকটে পাকিস্তানের জনগণ ঈদে খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন। খুচরা বিক্রেতাদের মতে, এবারের রমজান মাসে বিগত কয়েক বছরের তুলনায় কেনাকাটায় তীব্র মন্দা দেখা গেছে। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে পাকিস্তান। তবে এমন ভয়াবহ সংকট সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যায়নি। কার্যত এ থেকে উত্তরণের কোনো পথ সামনে নেই পাকিস্তান সরকারের। যে কারণে ঋণ নিয়ে ঋণের বোঝা কমাতে চাইছে তারা। 

সংকটে জর্জরিত পাকিস্তানে চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ২৯.৫ শতাংশে উঠতে পারে বলে বিশ্বব্যাংকের এক সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের দুর্গতি আরও বাড়বে। মূলত জ্বালানি ও খাদ্যের উচ্চমূল্য এবং মুদ্রার দুর্বলতার কারণে মূল্যস্ফীতি এতটা বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

চলতি অর্থবছরে দেশটির অর্থনীতি ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছিল। তবে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আরও কমে যাবে। তাদের পূর্বাভাস, প্রবৃদ্ধি হতে পারে ০.৪ শতাংশ। এ ছাড়া গত বছরের প্রলয়ংকরী বন্যার পর গত ২০ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম পাকিস্তানের কৃষি উৎপাদন কমতে পারে। 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়া, মানুষের আত্মবিশ্বাসে চির ধরা, উচ্চ সুদহার ও উচ্চ জ্বালানি মূল্যের কারণে পাকিস্তানে শিল্পোৎপাদন কমতে পারে। শিল্পোৎপাদন হ্রাস পাওয়ার অর্থ হলো, যোগাযোগ খাত ও খুচরা বাজারেও তার প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ সেবা খাত সংকুচিত হবে। সেই সঙ্গে দারিদ্র্যের হার বাড়বে। এক দিকে দুর্বল শ্রমবাজার, আরেক দিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আইএমএফের ঋণ পেতে বিলম্ব ও নীতিগত অনিশ্চয়তা পাকিস্তানের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। ফলে বাড়তে পারে দারিদ্র্য।

পাকিস্তানের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে দেশটি এক মাসও চলতে পারবে না। সম্প্রতি ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না (আইসিবিসি) পাকিস্তানকে ৩০ কোটি ডলারের এই বাণিজ্যিক ঋণ দিয়েছে। আইসিবিসি পাকিস্তানের জন্য মোট ১.৩ বিলিয়ন বা ১৩০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে। ১৪ এপ্রিল শেষ হওয়া সপ্তাহে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে (এসবিপি) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন বা ৪৪৩ কোটি ডলার।

অব্যাহত আর্থিক সংকট ও আইএমএফের ঋণের কিস্তি পেতে বিলম্ব হওয়ার কারণে পাকিস্তানের অর্থনীতি সীমিত হয়ে আসছে। ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে পাকিস্তানের জরুরি তহবিলের দরকার। দেশটির অর্থনীতি, তথা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ৩৫০ বিলিয়ন বা ৩৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০১৯ সালে তাদের এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটির (ইএফএফ) আওতায় পাকিস্তানকে ৬৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছিল। এর মধ্যে ১১০ কোটি ডলার গত বছরের নভেম্বরে ছাড়ের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এই বেলআউট প্যাকেজের শর্তের সঙ্গে পাকিস্তানের আর্থিক নীতির অসঙ্গতির কারণে এই সাহায্য পেতে দেরি হচ্ছে। পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, আইএমএফ জনসমক্ষে বলছে গরিববান্ধব নীতি করতে; কিন্তু আদতে তারা যা বলছে, তাতে গরিব মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে যাবে।

আইএমএফ এখন চাইছে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া অন্য যেসব বিষয়ে তাদের অগ্রাধিকার পরিবর্তন হয়েছে, সেগুলো হলো মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারিত না রাখা, যুদ্ধবিধ্বস্ত ও নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত আফগানিস্তানে অর্থ পাচার বন্ধ করতে ব্যবস্থা নেওয়া, বন্ধুরাষ্ট্রগুলো পাকিস্তানকে সহায়তা করবে-এই মর্মে লিখিত নিশ্চয়তা ও বিদ্যুতে সারচার্জের বিধান অব্যাহত রাখা।

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য ডন জানিয়েছে, আইএমএফ ধনীদের ওপর করারোপের কথা বললেও এখন বিক্রয় কর বৃদ্ধির জন্য চাপাচাপি করছে। এতে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়বে। কিন্তু ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের বিদেশি মুদ্রা লেনদেনে করারোপের প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে তারা। আবার বন্যার ক্ষয়ক্ষতি পোষাতে উচ্চ আয়ের মানুষের ওপর লেভি আরোপেরও বিরোধিতা করছে আইএমএফ।

প্রসঙ্গত, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় পাকিস্তান গত ৭৫ বছরে ২৩ বার আইএমএফের বেইল আউট প্যাকেজ নিয়েছে। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর মুর্তজা সাঈদ জিও নিউজকে বলেন, ‘বাস্তবতা হলো, আমরাই হলাম আইএমএফের সবচেয়ে নিয়মিত গ্রাহক।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে একই সময় স্বাধীনতা অর্জন করা ভারত মাত্র সাতবার আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে। ১৯৯১ সালে মনমোহন সিংহের যুগান্তকারী সংস্কারের পর থেকে তারা একবারও আইএমএফের কাছে যায়নি। অথচ পাকিস্তানের দুর্দশার যেন শেষ নেই।’

এদিকে রুপির রেকর্ড দরপতন হয়েছে। ২৮৭ রুপির বিনিময়ে পাওয়া যাচ্ছে এক ডলার। ফলে আমদানি সীমিত করতে হয়েছে তাদের। পাকিস্তানে ভোক্তা মূদ্রাস্ফীতি এক বছরের আগের তুলনায় মার্চ মাসে রেকর্ড ৩৫.৩৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চেইন স্টোর অ্যাসোসিয়েশন পাকিস্তানের (সিএপি) চেয়ারম্যান এবং রয়্যাল ট্যাগের সিইও তারিক মেহবুব জানান, নারী ও মেয়েদের পোশাক ছাড়া সব বিভাগে তাদের বিক্রি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। নারীদের পোশাকের ব্র্যান্ড ক্রস স্টিচের মালিক আসাদ শফি বলেন, ‘পাকিস্তানিরা গত দুই বছরে তাদের সম্পদের ৫০ শতাংশেরও বেশি অবমূল্যায়ন আকারে হারিয়েছেন। তাই আপনার কাছে এখন ৫০ শতাংশ কম অর্থ আছে, যেখানে খরচ ১০০ শতাংশ বেড়েছে। পোশাক খাতে খুচরা বিক্রেতাদের প্রত্যাশা এতই কম যে, বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম বিক্রয় করাও তাদের কাছে এখন গ্রহণযোগ্য।’

প্রসঙ্গত দেশটিতে টমেটো, আলু এবং গমের আটার দাম বেড়ে যাওয়ায় খাদ্য সংকট তীব্র হয়েছে। সাধারণ মানুষ তাদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারছে না। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে পাকিস্তানের জনগণের বাস্তবতা উঠে এসেছে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, শ’খানেক মানুষ আটা বহনকারী একটি ট্রাকের পেছনে দৌড়াচ্ছেন। তারা একে অপরকে ঠেলে আটার জন্য ট্রাকে উঠছিল। এই সময় অন্তত ১৬ জন মারা যান। ট্রাকটি বিতরণ কেন্দ্রে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয়রা লুঠ করেন।

পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশই চীন থেকে নেওয়া। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না (আইসিবিসি) পাকিস্তানকে আরও ১.৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে। এই ঋণ গ্রহণের ফলে পাকিস্তানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়বে আরও ২ বিলিয়ন ডলার। 

চীনা ঋণে বরাবরই অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঋণ সংস্থার তুলনায় অনেক বেশি সুদ ধার্য থাকে। তাই ঋণ পরিশোধ অব্যাহত রাখা গ্রহীতা দেশগুলোর জন্য বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া চীন যে ঋণ দেয় তা কখনোই লাভজনক হয় না। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দর। ২০১৭ সালে ৯৯ বছরের জন্য চীন এই বন্দর ইজারা পেলেও ঋণ পরিশোধ না হলে আরও ৯৯ বছর তারা দখলে রাখার শর্ত রেখেছে চুক্তিতে।

ইতোমধ্যে চীনের কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছে তা শোধ দেয়ার সামর্থ্য এই মুহূর্তে পাকিস্তানের নেই। এই ঋণের পরিবর্তে ভবিষ্যতে হয়তো শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দরের মতো তাদেরও কিছু একটা চীনকে লিখে দিতে হতে পারে। ইতোমধ্যে পাকিস্তান তাদের দখলে থাকা লাদাখ অঞ্চলের একাংশ চীনের হাতে তুলে দিয়েছে। বিতর্কিত এই অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব চীনের হাতে তুলে দেওয়ার কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারত।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে নানাবিধ সংকটে বিপর্যস্ত পাকিস্তান। একদিকে ভঙ্গুর অর্থনীতির কারণে মুদ্রার মূল্যমানের রেকর্ড পতন, জ্বালানি তেলের আকাশছোঁয়া দাম আর নিত্যপণ্যের অস্থির বাজারে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ইস্যুতে দিন দিন আরও উত্তপ্ত হচ্ছে পাকিস্তানের রাজনীতির মাঠ। 

পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি কৃষিপণ্য আর প্রবাসী আয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধান এই দুই খাতের বাইরে পরির্বতনশীল পৃথিবীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজের অর্থনীতিকে বহুমুখী করতে পারেনি দেশটি। করোনা মহামারিতে দীর্ঘদিন লকডাউনসহ নানা নিষেধাজ্ঞা আর এরপর ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার পরও জিডিপির একটা বড় অংশই সেনাবাহিনীর পেছনে খরচ করেছে পাকিস্তান। ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছরই প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়েছে দেশটি, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। এ ছাড়া ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যাও ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলেছে পাকিস্তানকে।

দেশটির প্রশাসন এখন অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে গত বছরের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের দূতাবাসের সম্পত্তি নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। তবে ঋণ নিয়ে সংকট সামাল দেওয়ার কৌশল কোনো কাজে দেবে না বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের। আদতে এর পরিণতি যে ধ্বংসাত্মকই হবে, তা বলাই বাহুল্য।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //