ভুটানকে নিয়ে চিন্তিত ভারত

এপ্রিলের শুরুতেই ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক ভারত সফরে যান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের পর দুই দেশের পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতিতে বেশকিছু ক্ষেত্রে সহযোগিতার ঘোষণা দেওয়া হয়; যার মাঝে রয়েছে লাইন অব ক্রেডিটের মাধ্যমে ঋণের ব্যবস্থা। ভুটানের সানকোস ও পুনাতসাংছু পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পে ভারতের অংশগ্রহণের ব্যাপারে আশ্বাস দেওয়া হয়। 

১৯৮০-এর দশকে ভারতের ঋণে তৈরি ভুটানের ৩৩৬ মেগাওয়াটের ছুখা পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবও ভারত সরকার চিন্তা করবে বলে জানান হয়। এছাড়াও ৬৪ মেগাওয়াটের বাসোছু পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ভারত বিদ্যুৎ আমদানিতে রাজি হয়েছে। 

ভারতের কোকরাঝর থেকে ভুটানের গেলেফু পর্যন্ত সাড়ে ৫৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে রেললাইন নির্মাণ, দুই দেশের মাঝে সড়কপথের বাণিজ্যের জন্যে জয়গাঁও-এ নতুন চেকপয়েন্ট নির্মাণ এবং তৃতীয় দেশের অতিথিদের জন্যে চেকপয়েন্ট নির্মাণ প্রকল্পে ভারতের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে ভুটানকে মহাকাশ গবেষণা, শিক্ষা, ইন্টারনেট ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতার আশ্বাসও ভারতের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। এই প্রকল্পগুলোকে ভুটানের রাজার ‘ট্রান্সফর্ম ইনিশিয়েটিভ’-এর অংশ বলা হচ্ছে। 

ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ভুটানে যখন যুবসমাজের মাঝে বেকারত্বের হার ২১ শতাংশে পৌঁছেছে, তখন ভারতের নিঃসন্দেহে সেখানে কিছু করার রয়েছে। একসময় ভুটানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ভারতে শিক্ষা নিত। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসার কারণে ভুটানের নীতি-নির্ধারণ ও সরকারি সিদ্ধান্তের উপর ভারতের প্রভাব কমতে বসেছে। এক্ষেত্রে ভুটানে ভারত সরকারের নতুন প্রকল্পগুলো দিল্লির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফল বয়ে নিয়ে আসতে পারে। 

কিন্তু ভুটান ও ভারতের এত কাছের সম্পর্কের মাঝেও সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংয়ের মন্তব্য ভারতীয়দের বিচলিত করেছে। গত ২৫ মার্চ বেলজিয়ামের সংবাদপত্র লা লিব্রে বেলজিকে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তার সরকার শিগগিরই চীনের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যার সমাধান করবে। ভুটানের ভেতর চীনা গ্রাম তৈরির ভারতীয় দাবির কোনো ভিত্তি নেই। 

ভারতীয়রা চিন্তিত যে, ভুটানের সঙ্গে চীন যখন সীমান্ত সমস্যা সমাধানের কথা বলছে, তখন তারা ডোকলাম নিয়েও কথা বলছে। ২০১৭ সালে ডোকলাম সীমান্তে ভারতের সঙ্গে চীনের সামরিক দ্বন্দ্ব হয়েছিল। এই এলাকাটা তিন দেশের সীমান্তের সংযোগ এবং ভারতের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডোর বা ‘চিকেন নেক’-এর খুবই কাছে। এই করিডোরের মাধ্যমেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটা রাজ্যের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের স্থলযোগাযোগ রক্ষা করা হয়। সরু এই চিকেন নেকের উত্তরে ভুটান ও চীন এবং দক্ষিণে বাংলাদেশ। 

যদিও ভুটানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ডোকলামের ব্যাপারে যে কোনো সমঝোতাতে তিন দেশের স্বার্থকেই দেখা হবে, তথাপি ভারতীয়রা এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ডোকলাম ইস্যু সমাধানে তিন দেশেরই ‘সমান অধিকার’ রয়েছে। ‘হিন্দুস্থান টাইমস’ বলছে, ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য তাদের নীতির পরিবর্তন। কারণ এর আগে ভুটানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তিন দেশের সীমান্তে সবারই যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। 

ভারত সরকার বলছে, চীন ডোকলামে তিন দেশের সীমান্তকে ‘বাটাং লা’ এলাকার ৭ কিলোমিটার দক্ষিণে ‘মাউন্ট গিপমোচি’ নামক এলাকায় নিয়ে আসতে চায়। এতে পুরো ডোকলাম মালভ‚মি আইনগতভাবে চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। দিল্লি চীনের এই পরিকল্পনার ঘোর বিরোধী। ভারত বলছে, চীন বেআইনিভাবে ডোকলাম দখল করে রেখেছে। ডোকলামের নিয়ন্ত্রণ চীনের কাছে চলে যাওয়ার অর্থ হলো চীন ‘শিলিগুড়ি করিডোর’ বা ‘চিকেন নেক’-এর আরও কাছে চলে আসবে। তবে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ‘দ্য ভুটানিজ’ পত্রিকাকে বলেছেন, বেলজিয়ামের পত্রিকায় তার মন্তব্য নতুন কিছু নয়। কারণ সীমান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে ভুটানের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। 

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা বলেছেন, ভারতের স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত যে কোনো ব্যাপারেই তারা খবর রাখে এবং প্রয়োজনমতো ভারত তার নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে যে কোনো পদক্ষেপ নেবে। ভুটানের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক নিরাপত্তা সহযোগিতা রয়েছে। এ কারণেই উভয় দেশ তাদের দ্বিপাক্ষিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সর্বদাই আলোচনা করে থাকে। তবে ভারতীয়দের মাঝে কেউ কেউ ভুটানের সঙ্গে এক্ষেত্রে ধীরে চলার নীতিতে বিশ্বাসী। ‘হিন্দু’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ভারতে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা যদি ভুটানের উপর বেশি চাপ প্রয়োগ করতে চায়, তাহলে ভুটান দিল্লির হাত থেকে ছুটে যেতে পারে। 

ভারতীয় কলামিস্ট এবং বিবিসির সাবেক সাংবাদিক আদিল ব্রার এক লেখায় বলেছেন, সীমান্ত আলোচনা নিয়ে ভুটানের উপর চাপ সৃষ্টি করছে চীন এবং সেটা বিভিন্ন চীনা মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি চীনা বিশ্লেষকদের বক্তব্য তুলে ধরেন, যেখানে বলা হচ্ছে, ভুটানের নিরাপত্তা ও অর্থনীতির উপর ভারতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে ভুটানের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতির উপর ভারতের আধিপত্য রয়েছে। সেক্ষেত্রে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য চীনের বিজয় এবং ভারতের জন্য পরাজয়। একই সঙ্গে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, চীনের সঙ্গে সীমান্ত আলোচনায় ভারত চাইছে ভুটানের হয়ে কথা বলতে। 

অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার দিক থেকে ভুটানের উপরে পুরোপুরি আধিপত্য থাকার পরেও দেশটিকে নিয়ে ভারত চিন্তিত। আকারের দিক থেকে শক্তিশালী না হলেও ভুটান তার ভৌগোলিক অবস্থানকে ভূ-রাজনৈতিক দরকষাকষির মাঝে নিয়ে এসেছে। ডোকলাম ইস্যুতে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর তিন দেশের সমান অধিকারের পক্ষে বিবৃতি দিল্লির চোখে ভারতের চিকেন নেকের জন্য প্রচ্ছন্ন হুমকির সৃষ্টি করেছে। 

হিন্দু পত্রিকার সম্পাদকীয়তে যখন বলা হচ্ছে, ভুটানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ভারতে পড়াশোনা না করার ফলে দেশটির উপরে ভারতের প্রভাব কমছে, তখন হয়তো প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং এবং তার কাছের লোকদের কথাই বলা হয়েছে, যারা অনেকেই বাংলাদেশে মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেছেন এবং বাংলায় কথা বলেন। দক্ষিণ এশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ যে এখন ভারতের একার হাতে নেই, সেটা এখন পরিষ্কার। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //