খাদ্য মূল্যস্ফীতির কবলে মধ্যপ্রাচ্য আফ্রিকা

বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের মূল্য গত কয়েক মাসে কিছুটা কমে এলেও তা এখনো ব্যাপক উচ্চতায় অবস্থান করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দাম কমার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের কৃষ্ণ সাগরীয় চুক্তি। এ চুক্তির ফলে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্য রপ্তানি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। তবে এর সুফল সব দেশ পাচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চল তারই অন্যতম। স্মরণকালে সবচেয়ে ভয়াবহ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কবলে পড়েছে এ অঞ্চল।

সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া ও ইয়েমেনের মতো দেশগুলোয় মারাত্মক আকার ধারণ করেছে খাদ্য সংকট পরিস্থিতি। চলতি বছর খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির বড় প্রভাব পড়বে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার অর্থনীতির (মেনা অঞ্চল) ওপর। অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে দরিদ্র করবে, আর দরিদ্রদের নিঃস্ব করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে আঞ্চলিক খাদ্যনিরাপত্তা ভেঙে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।

সম্প্রতি সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের ৫ দশমিক ৮ শতাংশের তুলনায় চলতি বছর মেনা অঞ্চলের দেশগুলোয় জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে হবে ৩ শতাংশ। এদিকে মাথাপিছু প্রকৃত জিডিপি ২০২২ সালের ৪ দশমিক ৪ শতাংশের তুলনায় চলতি বছর কমে দাঁড়াবে ১ দশমিক ৬ শতাংশে। ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন চলতি বছর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়তে পারে। এ ছাড়া পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৮০ লাখ শিশু ক্ষুধার্ত থাকবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ২০২২ সালের মার্চ-ডিসেম্বরের মধ্যে মেনা অঞ্চলে বার্ষিক গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ২৯ শতাংশ। খাদ্যের দামের এ বৃদ্ধি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করে বৈশ্বিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটি।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দুর্ভিক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা সেভাবে উল্লেখ করা না হলেও খাদ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে অর্থনীতিতে যে প্রতিক্রিয়া হবে, এর ফলে সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা জানানো হয়েছে। আর এমনটি হলে যে ভবিষ্যৎ আরও কঠিন হবে, তা বলাই বাহুল্য।

প্রসঙ্গত, যখন কোনো পরিবারের অন্তত একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি অর্থ বা সম্পদের অভাবজনিত কারণে বছরজুড়ে তার খাবারের পরিমাণ কমাতে বাধ্য হয়, অভুক্ত বা ক্ষুধার্ত থাকে, কিংবা সারাদিন না খেয়ে কাটায় তখন সে পরিবারকে মারাত্মকভাবে খাদ্যনিরাপত্তাহীন শ্রেণিতে লিপিবদ্ধ করা হয়।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মেনা অঞ্চলে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ব্যাপকতা বেশি, যা ২০০৬ সালের প্রাক্কলিত ১১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে চলতি বছর ১৭ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি) সিরিয়া ও ইয়েমেনকে সংকটপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার চ্যালেঞ্জগুলো মূলত ব্যাপক। শুধু মানবিক দিক বিবেচনা করে নয়, এ অঞ্চলের সরকারগুলো এখন অর্থনৈতিক কারণেও সক্রিয় হবে। কেননা অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুরা ভবিষ্যতের কম উৎপাদনশীল শ্রমশক্তি হিসেবে অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে উঠবে।

মেনা অঞ্চলে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফেরিদ বেলহাজ বলেন, ‘খাদ্য মূল্যস্ফীতি দরিদ্র পরিবারগুলোর ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলছে। খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দ্বারা আক্রান্ত হবে তরুণ প্রজন্ম। দুঃখজনকভাবে যা তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করবে। অক্ষমতা বা নিষ্ক্রিয়তার মানবিক ও অর্থনৈতিক মূল্য অত্যধিক। এ অঞ্চলের জন্য সাহসী নীতির প্রয়োজন, কেননা এখানকার জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি তরুণ।’ মেনা অঞ্চলে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ রবার্তা গ্যাটি বলেন, ‘খাদ্য মূল্যস্ফীতি, যদি তা সাময়িকও হয়, তবে দীর্ঘমেয়াদে অপরিবর্তনীয় ক্ষতির কারণ হতে পারে।’

বিশ্বের অনেক দেশেই এখন খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের বেশি। এমনকি উন্নত দেশের মানুষও উচ্চ খাদ্য মূল্যের কারণে হিমশিম খাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জিম্বাবুয়ে যেন এক প্রতীকী চিত্র।

বিশ্বব্যাংকের খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি ছিল আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়েতে, ৬৮ শতাংশ। 

ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম এক লাফে আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। মূল্যস্ফীতি বা বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়লে মানুষ প্রথমত খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। মূলত আমিষের পরিমাণ কমে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীরা। প্রয়োজনীয় পুষ্টি না পেলে শিশুর বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ভবিষ্যতে তাদের কর্মদক্ষতা কমে যায়। খাদ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে মেনা অঞ্চলের উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুই লাখ থেকে ২ লাখ ৮৫ হাজার শিশুর গর্ভাবস্থায় পুষ্টি বঞ্চনা কিংবা পরবর্তী সময়ে অপুষ্টির শিকার হওয়ার আশঙ্কা ১৭-২৪ শতাংশে পৌঁছতে পারে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, টানা ১২ মাস খাদ্যের দাম নিম্নমুখী হলেও তা যুদ্ধের আগের তুলনায় অনেক ঊর্ধ্বমুখীই রয়েছে। ইউরোপীয় কমিশনের দেওয়া তথ্যমতে, যুদ্ধের আগে বৈশ্বিক গম রপ্তানির ১০ শতাংশই আসত ইউক্রেন থেকে। এছাড়া ভুট্টার ক্ষেত্রেও দেশটির অবদান ছিল ১৫ শতাংশ ও যবের ক্ষেত্রে ১৩ শতাংশ। যুদ্ধের পর দেশটির শস্য রপ্তানি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। 

শুধু ইউক্রেনের রপ্তানি কমে যাওয়া নয়, বরং বিশ্বজুড়ে সার সংকটও খাদ্যপণ্যের আকাশচুম্বী দাম ও সংকটের জন্য দায়ী বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। বিশ্বের শীর্ষ সার রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া। পশ্চিমা দেশগুলোর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দেশটির সার বাণিজ্যের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্জেই লাভরভ বলেন, ‘রাশিয়ার কৃষিপণ্য রপ্তানির ওপর থেকে যদি সব ধরনের বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া না হয়, তাহলে কৃষ্ণ সাগরীয় চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে মস্কো।’ 

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) চলতি মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যসূচক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হওয়া পণ্যগুলোর ওপর ভিত্তি করে এ মূল্যসূচক তৈরি হয়। মার্চে সূচক দাঁড়িয়েছে ১২৬ দশমিক ৯ পয়েন্টে, যা আগের মাসের তুলনায় ২ দশমিক ১ শতাংশ কম। অন্যদিকে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সূচক ২০ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে।

জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় গত বছরের জুলাইয়ে কৃষ্ণ সাগরীয় চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর মধ্য দিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়া ইউক্রেনের কৃষ্ণ সাগরীয় বন্দরগুলো দিয়ে আবারও রপ্তানি চালু হয়। এর আগে টানা ছয় মাস রপ্তানি বন্ধ ছিল। চুক্তির ফলে বিভিন্ন দেশে খাদ্যসংকটের ঝুঁকি কমে আসে। তবে এ ঝুঁকি কমে এলেও খাদ্যের দাম এখনো আকাশছোঁয়া।

এফএওর প্রধান অর্থনীতিবিদ ম্যাক্সিমো টোরেরো বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যখন দাম কমছে, ঠিক তখনই স্থানীয় বাজারগুলোয় বাড়ছে। এসব বাজারে বর্তমানে দাম অনেক উঁচুতে রয়েছে। ফলে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে নিট খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোয় ঝুঁকি প্রকট হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা থাকবে। মূল্যস্ফীতিও থাকবে বাড়তি। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, তীব্র খাদ্যসংকট কাটিয়ে উঠতে বিশ্বের অন্তত ৫৩টি দেশের ২২ কোটি ২০ লাখ মানুষের জরুরি সহায়তা প্রয়োজন হবে। ফলে বিশ্বের অনেক মানুষ রাতের বেলা ক্ষুধা পেটে ঘুমাতে যাবে। বিশ্লেষকদের মতে, এবারের খাদ্যসংকট মানবজাতিকে করোনা মহামারির চেয়েও বড় পরীক্ষার মুখে ফেলতে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //