বিশ্বকে বদলে দিচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ

গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে যে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে রাশিয়া। বহু পক্ষ এ যুদ্ধে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়েছে। অনেকে এ যুদ্ধের মধ্যে বিশ্বযুদ্ধের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। এটিকে বিশ্বযুদ্ধ বলা যায় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই যে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতোই ইউক্রেন যুদ্ধও বিশ্বকে বদলে দিচ্ছে।

১৬ জানুয়ারি পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাভিয়েৎস্কি মার্কিন- নেতৃত্বাধীন ন্যাটো দেশগুলোকে সতর্ক করে বলেছেন রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে ইউক্রেনের পরাজয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর কারণ হতে পারে। মোরাভিয়েৎস্কি দাবি করেছেন, ইউক্রেনের পরাজয় ঠেকাতে পশ্চিমারা যেন ইউক্রেনকে অবিরত অস্ত্র সরবরাহ করে যায়। বিশিষ্ট ফরাসি ঐতিহাসিক ও নৃতত্ত্ববিদ ইমানুয়েল টড ২০২২ সালে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে’ শীর্ষক একটি বইও লিখেছেন।

এক সাক্ষাৎকারে টড বলেন, ‘আমরা এখনো অস্ত্র সরবরাহ করে চলেছি। আমরা নিজেদের সামনে না আনলেও, আমরা রুশদের হত্যা করছি। এটাই সত্য যে সর্বোপরি ইউরোপীয়রা আর্থিকভাবে জড়িয়ে পড়েছে। বাস্তবিকভাবে যুদ্ধে আমাদের প্রবেশকে আমরা অনুভব করছি মুদ্রাস্ফীতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অভাবের মধ্য দিয়ে।’

এদিকে ইউক্রেনকে যুদ্ধ চালানোর খরচ জোগানো ও রাশিয়ার জ্বালানির উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে মুদ্রাস্ফীতিসহ বিভিন্ন আর্থিক সংকটে পড়ে আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলো। 

ফলে ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলোর ইউক্রেন যুদ্ধে পরোক্ষে জড়িয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতারা মুখ খুলেছেন। হচ্ছে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশও। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এক ফেসবুক পোস্টে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞার কড়া সমালোচনা করেন এবং দাবি করেছেন, ব্রাসেলস জ্বালানি খাতে যে বিধিনিষেধ লাগু করেছে তার ফলে মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলায় সমস্যা হচ্ছে। 

তিনি বলেন, ‘রোগের নাম মুদ্রাস্ফীতি, এবং ভাইরাসটির নাম ব্রাসেলসের নিষেধাজ্ঞা।’ অরবান এই নিষেধাজ্ঞাগুলো ‘ব্রাসেলসের যুদ্ধনীতির অস্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং তিনি বলেন, ইইউ রাশিয়াকে লক্ষ করে এই অস্ত্রটি ব্যবহার করতে গিয়ে উল্টো নিজেরই ক্ষতি করেছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স ব্রিটেন নেতৃত্বাধীন জোট জয়ী হলেও, তারা ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। উৎপাদন-বাণিজ্যের বদলে অনেক বেশি যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে তারা আটকে যায়। এই সুযোগে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ফরাসি, ব্রিটিশ, জার্মান, জাপান সাম্রাজ্যের শুধু পতন নয়, প্রত্যক্ষভাবে উপনিবেশ রাখার ব্যাপারটাই উঠে যায়। জন্ম হয় একাধিক সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্রের। 

তখন পরাশক্তিদের নীতি হয়ে যায়, বাইরে থেকেই বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে বা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোকে আর্থিক এবং রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সুযোগে ফ্রান্স-ব্রিটেনের চেয়ে মার্কিন অর্থনীতি শক্তিশালী হলেও, ব্রিটিশরাই ছিল বিশ্বের এক বিরাট অংশের স্বঘোষিত অধীশ্বর! উপনিবেশগুলোর বেশিরভাগই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পদতলে। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৩৮ সালে বিশ্ব জিডিপির ৪৫ শতাংশ উৎপাদন করত যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ১১ শতাংশ এবং ব্রিটেন ৯ শতাংশ।

যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রিটেন ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি এবং সোভিয়েতের উত্থানের আতঙ্কে মার্কিনিদের আধিপত্য মেনে নিতে বাধ্য হয়। ১৯৪৪ সালের বেটন-উডস চুক্তির মধ্য দিয়ে মহাশক্তিধর দেশগুলোর অধিকর্তা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা পায় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন ডলার হয়ে যায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা। ১৯৭১ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে বিধ্বস্ত মার্কিন অর্থনীতি ডলারের সঙ্গে সোনার সংযোগ ছিন্ন করে। মার্কিন কারেন্সিও পরিণত হয় ফিয়াট কারেন্সিতে। যা নিক্সন শক নামে পরিচিত। তবুও মার্কিন ডলার তার আধিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়।

তবে সম্প্রতি চীনের উত্থানে মার্কিন ডলার ও দেশটির অর্থনীতি সবচেয়ে বড় সংকটের মধ্যে পড়ে। এ বছরের ৪ জানুয়ারি ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটিশ কনসালটেন্সি সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) পূর্বাভাস দিয়েছে-চীনের জিডিপি ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ৫.৭ শতাংশ এবং তারপর ২০৩০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ৪.৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। এর পূর্বাভাস বলছে যে চীন, এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাবও কমে আসছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার সরবরাহ করা জীবাশ্ম জ্বালানির উপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা জারি করার ফলে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে জ্বালানির দাম বেড়ে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ফোন করেন মার্কিন সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে। কিন্তু সৌদি ও আমিরাতের দুই যুবরাজ বাইডেনের ফোন ধরেননি। অথচ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যুবরাজদের ফোনালাপের কথা বিবৃতি আকারে প্রকাশ করা হয়। আরব শাসকেরা আরও জানায়, তারা শুধু ডলারে নয়, এবার চীনা মুদ্রা ইউয়ানেও তেল বিক্রি করবে। মধ্যপ্রাচ্যে চীন-রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধিরই ফলাফল দেখা গেল সৌদি-ইরান সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। 

চীনের সঙ্গে সীমানা বিরোধের কারণে ভারত-মার্কিন ঘনিষ্ঠ হলেও, মার্কিন চাপ উপেক্ষা করে রাশিয়ার থেকে জ্বালানি ও সামরিক সরঞ্জাম আমদানি অব্যাহত রেখে ভারত বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের একান্ত অনুগত নয়। জাতিসংঘে ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে চীন ও ভারত একই সঙ্গে ভোট দানে বিরত থেকেছে। চীন, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশ ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষতার নীতি ঘোষণা করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে এই দেশগুলোর নিরপেক্ষতাই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের কাছে অবাধ্যতা। তাই ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে পশ্চিমারা সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছে, ‘নিরপেক্ষতা’ তারা পছন্দ করছে না। 

এদিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নতুন মেরুকরণ আরও স্পষ্ট হয় বাইডেনের উদ্যোগে ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’-এর মধ্য দিয়ে। এবার দ্বিতীয়বারের মতো দুই দিনব্যাপী ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয় ২৯ ও ৩০ মার্চ। সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে বাইডেন বলেছেন, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। সশরীর ও ভার্চুয়াল মাধ্যমের সংমিশ্রণে আয়োজিত এবারের এই সম্মেলনে ১২০টি দেশ যুক্ত রয়েছে। 

এবারের সম্মেলনে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র শক্তিশালী করার কার্যক্রমে ৬৯ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ের ঘোষণা দিয়েছেন বাইডেন। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আজ আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, বিশ্বের গণতন্ত্র দুর্বল নয় বরং শক্তিশালী হচ্ছে। বিশ্বে একনায়কতন্ত্র দুর্বল হচ্ছে, শক্তিশালী হচ্ছে না। আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যয় নিয়ে সবার একত্রিত হওয়ার একটি প্রত্যক্ষ ফল এটি।’ 

২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাইডেনের ডাকা প্রথম গণতন্ত্র সম্মেলনে ১১০টি দেশ আমন্ত্রণ পেয়েছিল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীন এই সম্মেলনের সমালোচনা করেছে। তারা গণতন্ত্রের উন্নয়নের নামে বিভিন্ন দেশের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে’ ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। একদলীয় শাসনব্যবস্থায় থাকা বেইজিংকে এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। 

বাইডেন এ সম্মেলনকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বলে উল্লেখ করলেও এটি মূলত বিশ্বের বিভক্তির চিত্রকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। এর মধ্য দিয়ে শত্রু-মিত্র নির্ধারণ ও মেরুকরণের রাজনীতিই মুখ্য হয়ে উঠছে। এর বিপরীতে চীনের উদ্যোগে সৌদি-ইরান শান্তি চুক্তি, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে চীনের রূপরেখাও চীন-রাশিয়া বলয়ের শক্তিশালী হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। লাতিন অঞ্চল, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ এবং এশিয়ায় রাশিয়া ও চীনের অবস্থান ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠছে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেমন বিশ্বব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন হয়েছিল; ইউক্রেন যুদ্ধকে বিশ্বযুদ্ধ বলে স্বীকার না করলেও নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, এটি বিশ্বব্যবস্থার আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, এমনকি ভৌগোলিক পরিবর্তন সামনে নিয়ে আসছে। আর সেটি হয়তো আগামী কয়েক বছরে আরও স্পষ্ট হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //