ফিরে দেখা ২০২২

অর্থনৈতিক সংকটে স্পষ্ট হয় নতুন বিশ্বব্যবস্থা

করোনা-পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গতিশীলতা শুরু হলেও ২০২২ সালজুড়ে বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বছরের শুরুতেই ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্ব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কমেছে উৎপাদন ও ক্রয়ক্ষমতা, বেড়েছে সংকট।

বৈশ্বিক ক্ষমতা কেন্দ্রও আর আগের অবস্থায় নেই। বৈশ্বিক অর্থনীতি শ্লথ হয়ে যাওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাত ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। 

ইউরোপেও যে এর আঁচ লেগেছে বেশ ভালোমতোই। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বড় অর্থনীতির দেশগুলোতে খাদ্য ও নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে মারাত্মকভাবে। ইউরোপের অর্থনৈতিক চিত্র এখন আর আগের মতো নেই।

এদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মন্থর গতি থেকে নিস্তার পায়নি চীনও। তবে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সমস্যার সম্মুখীন হলেও তা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পর্যায়ে রয়েছে দেশটি। চীনের অর্থনীতির ইতিবাচক অবস্থান ও রাশিয়ার সঙ্গে চীনের ঐক্য চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে পশ্চিমাদের কপালে।

বছরের পর বছর ধরে ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক প্রতিযোগিতা, নিষেধাজ্ঞা ও বাণিজ্যযুদ্ধ ২০২২ সালের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে যে যুদ্ধ চলছে, তাকে ‘সামরিক যুদ্ধ’ বলা হলেও এর আড়ালে রয়েছে অন্য বাস্তবতা। 

এখন পর্যন্ত সংঘর্ষে উভয় পক্ষের সেনা এবং ইউক্রেনের জনগণের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগের বিষয়কে বাদ দিলে এই যুদ্ধকে অর্থনীতির ক্ষেত্রে ‘একটি সীমিত ও গৌণ’ বিষয় বলেই দেখতে হবে। এর মূলে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বনাম রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব। উভয় পক্ষের নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে গোটা বিশ্বে সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিসহ বৈশ্বিক খাদ্য ও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে।

বিশ্ববাজার হয়ে ওঠে অস্থির। দেশে দেশে বাজারব্যবস্থায় ঘটেছে ব্যাপক পরিবর্তন। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন মহল। উদ্বেগের সবচেয়ে বড় বিষয় হলো বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি, যা এতটাই বেড়েছে যে, বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন- ২০২৩ সাল থেকে অর্থনৈতিক মহামন্দা শুরু হতে যাচ্ছে।

তবে এ অর্থনৈতিক সংকট একদিনেই তৈরি হয়নি। বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমাগতভাবে বৈষম্য বাড়িয়েছে। সম্পদের ঊর্ধ্বমুখিতা ও আয়ের পুনর্বণ্টন প্রক্রিয়ার এ বৈষম্যে ভারসাম্যহীনতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণি। এর ফলে অনিবার্যভাবেই আসছে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ।

২০২২ সালজুড়ে বিশ্বের বহু দেশে এ অসন্তোষ ছিল চোখে পড়ার মতো। ন্যূনতম জীবনমানের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাওয়া মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন তারা রাস্তায় নেমে আসে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দুটি দেশেই আর্থিক দুর্নীতি ও ভঙ্গুর অর্থনীতির জন্য আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাসীনদের পদচ্যূত হতে হয়।

কিন্তু যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারাও এ সংকট উত্তরণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। কারণ অর্থনীতির বাস্তব চিত্র তো রাতারাতি বদলাচ্ছে না। মূলত নিজস্ব উৎপাদনের ওপর নির্ভর না করে বিদেশ-নির্ভর উৎপাদন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণেই এ সংকট কাটানো এসব দেশের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

শ্রমিকের রাস্তায় নেমে পড়া, সংঘবদ্ধ আন্দোলন, ধর্মঘট এ সবই ছিল বছর জুড়ে বড় সংবাদ। বৈশ্বিক পুঁজিবাদ যে গভীরতর বৈষম্য, অস্থিতিশীলতা ও অন্যায়-অন্যায্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, তা থেকে উত্তরণে কথিত বাম ও ডান- উভয়পক্ষের সরকার ও দলগুলো শেষ পর্যন্ত পর্যাপ্ত উদ্যোগ গ্রহণ না করায় শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তেই থাকে। এই অবস্থায় পুঁজিবাদের জাঁতাকলে পড়া ভুক্তভোগী মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, শ্রমজীবী মানুষ হাত মেলায় পুঁজিবাদের সমালোচকদের সঙ্গে। এর মধ্যে রয়েছে উগ্র-জাতীয়তাবাদী ডানপন্থিরা। যে কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডানপন্থিদের উত্থান দেখা যাচ্ছে। কার্যত এর মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, গত দুই দশক ধরেই ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ বা নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। চলমান যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউকে পাশ কাটিয়ে অন্য উদীয়মানদের নিয়ে নতুন এ ব্যবস্থার রূপরেখা বাস্তবায়নের জন্য কয়েক বছর ধরেই কাজ করে যাচ্ছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

বৈশ্বিক পুঁজিবাদ এই শতাব্দীতে ইতোমধ্যে তিন বার অত্যন্ত বাজেভাবে হোঁচট খেয়েছে- ২০০০ সালে ডটকম সংকট, ২০০৮ সালে সাবপ্রাইম মর্টগেজ সংকট ও ২০২০ সালে কোভিড-১৯ সংকট। এই অবস্থায় ২০২২ সালে নতুন বিশ্বব্যবস্থার এ প্রচেষ্টা সুস্পষ্টভাবে বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে আগে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বশ মানানো গেলেও গত কয়েক বছরে দেখা গেছে- ইরান, উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার, বেলারুশের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে এসব আর কাজে লাগছে না। কারণ তারা নতুন বিশ্বব্যবস্থার অংশ হিসেবে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত। উদীয়মান এ বিশ্বব্যবস্থা গঠনের লড়াই-সংগ্রামেরই অংশ ইউক্রেন যুদ্ধ। এটিকে শুধু রাশিয়ার আগ্রাসন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে পশ্চিমারা।

আর এর মধ্য দিয়ে মূল বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ২০২২ সাল ছিল নতুন বিশ্বব্যবস্থার এক ‘অর্থনৈতিক বাস্তবতা’। সামনে বছরগুলোতে এর প্রভাব আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এখনই প্রশমিত হচ্ছে না বলেই ধরে নেওয়া যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ক্ষমতা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। এশিয়ায় তারা অনেকখানি পিছিয়েছে। তিন দিনের সফরে ৭ ডিসেম্বর সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে যান চীনের প্রেসিডেন্ট জিনপিং। অর্থনীতি চাঙ্গা করতে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র সৌদি আরবের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করতে চাইছে চীন। দুই দেশের মধ্যে জ্বালানি ও সরাসরি বিনিয়োগে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। 

এ ছাড়া দুই দেশের নেতারা সৌদি ভিশন-২০৩০ এবং বেইজিং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের লক্ষ্য অর্জনের ঐক্যেও একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। এবারের সফর শুধু বাণিজ্যিক চুক্তিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তা নতুন ভূরাজনৈতিক সমীকরণের বার্তা দেয়।

১৯৫০-এর দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয় চীন। তবে আজকের চীন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী। সেই সঙ্গে ভূরাজনীতির ক্ষেত্রেও তার অবস্থান ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ ও আরও কিছু বিষয়ের ঘাত-প্রতিঘাতে মার্কিন-চীন দ্বন্দ্ব সুস্পষ্ট হয়েছে।

অন্যদিকে বিগত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় খুব একটা ভালো ফল করতে না পারার কারণে নব্য উদার বিশ্বায়নের নীতি থেকে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের পথ ধরেছে যুক্তরাষ্ট্র। বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বর্তমানে জো বাইডেনের শাসনকালের দিকে দৃষ্টি দিলে এর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে।

অর্থনীতির প্রশ্নে বিশ্ব আবার দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। আর এ দ্বন্দ্ব এখন যত সামনে আসছে, সংকট ততই প্রকট হচ্ছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন-ইইউ নিষেধাজ্ঞার কারণে তেল ও গ্যাসের মূল্যস্ফীতি এই দ্বন্দ্বকে আরও উসকে দিয়েছে, যা এখন এতটাই তীব্র যে, বিশ্ব অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে খাদের কিনারায়। আর এর চড়া মূল্য চুকাতে হচ্ছে ইউরোপকে।

এ বছর মাঝারি ধাক্কাতেও বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে যেতে পারে বলে উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে শিক্ষার ক্ষতি, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি, সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত এবং অন্যান্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয়, করোনা মহামারির প্রভাবগুলো দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।

২০২২ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে, যা ৫২ বছর আগে ১৯৭০ সালের মন্দার পর আর দেখা যায়নি। বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন সবচেয়ে মন্থর গতিতে রয়েছে। বিশ্বের তিনটি বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরো অঞ্চল তীব্র সংকটের মধ্যে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে ২০২৩ সাল অর্থনীতিতে মাঝারি ধাক্কাও বিশ্বকে মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে। 

বিশ্বব্যাংক বলছে, গত এক বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ সংকট আরও তীব্র হয়েছে। এক দশকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সামগ্রিক ঋণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশ হয় ঋণ সংকটে অথবা এর ঝুঁকিতে রয়েছে।

ঋণের চাপে জর্জরিত বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলো। অর্থনৈতিক সংস্কার, স্বাস্থ্য, জলবায়ুর প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মোকাবিলা করে টিকে থাকা, শিক্ষাসহ অন্যান্য মৌলিক উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট অগ্রাধিকার খাতগুলোতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে সক্ষম হবে না। ২০১০ সাল থেকে ঋণের গঠন নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, ব্যক্তিগত ঋণদাতারা ক্রমবর্ধমান বৃহত্তর ভূমিকা পালন করছে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, একদিকে পাওনাদার পুল বাড়ানোর ঝুঁকিকে বহুমুখী ও ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে; অন্যদিকে এটি ঋণ পুনর্গঠনকে আরও কঠিন করে তোলে। এটি বিশেষ করে এমন সময়ে উদ্বেগজনক অবস্থা তৈরি করেছে যখন বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়ছে, যা ‘স্ট্যাগফ্লেশন’-এর ভয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //