অচিরেই বদলাচ্ছে না হিজাব আইন

ইরানে নারীর ‘ইসলামি’ পোশাক পরায় আইনি বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয় ১৯৮১ সালে। দেশটির পার্লামেন্টে ১৯৮৩ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যে নারীরা জনসমাগমে চুল ঢেকে রাখবে না, তাদের ৭৪টি দোররা মেরে শাস্তি দেওয়া হবে।

পরে ৬০ দিনের হাজতবাসের শাস্তির বিধানও যোগ করা হয়। ২০০৪ সালে মাহমুদ আহমাদিনেজাদ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর গঠন করা হয় গাশত-ই-ইরশাদ বা ‘হিজাব পুলিশ’। এই নীতি পুলিশকে দেওয়া হয় অগাধ ক্ষমতা। তারা যে কোনো জায়গায় নারীকে থামিয়ে দেখতে পারবে।

কারও পোশাকে বা চালচলনে নিয়ম লঙ্ঘন হলো কি না, চুল বেশি দেখা যাচ্ছে কি না, সালোয়ার ও কোট বেশি ছোট ও চাপা কিনা অথবা অতিরিক্ত মেকআপ নিয়েছেন কিনা, তা দেখার দায়িত্বও এই বাহিনীর। 

ইরানে চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল হিজাব পুলিশ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে ধর্মবাদী ক্ষমতাসীনরা এ বাহিনী বা হিজাব আইন আদৌ বদলাবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সংশয়। ইতিমধ্যে দুই আন্দোলনকারীর মৃত্যুদণ্ড প্রকাশ্যে কার্যকর করা হয়েছে।

আর এটি যে গণ-আন্দোলন দমনের একটা নেতিবাচক কৌশল, তা বলাই বাহুল্য। বিশ্লেষকরা বলছেন, অচিরেই হিজাব আইন বদলানোর মতো ঘটনা তারা আশা করছেন না।

তবে ইসলামি বিপ্লবের পর প্রথমবারের মতো ইরানের ক্ষমতাসীনরা অভ্যন্তরীণভাবে এতটা চাপের মধ্যে পড়েছে। আর এ ক্ষেত্রে নারীদের নজিরবিহীন ভূমিকা ও সমাজের একটা বড় অংশের সমর্থনও ভবিষ্যতে কট্টরপন্থি অবস্থান বদলের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ঘটনার শুরু গত ১৪ সেপ্টেম্বর, যখন আরও অনেকের সঙ্গে ২২ বছর বয়সী কুর্দি-ইরানি তরুণী মাহসা আমিনিকেও সঠিকভাবে হিজাব পরিধান না করার অপরাধে গ্রেপ্তার করে নীতি পুলিশ।

পুলিশ কর্মকর্তারা ব্যাটন দিয়ে আমিনির মাথায় আঘাত করেছিলেন এবং তাদের গাড়ির সঙ্গে আমিনির মাথা ঠুকে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠলেও নীতি পুলিশ তা পুরোপুরি অস্বীকার করছে। দুদিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। মাহসার জানাজার ক্ষোভের আগুন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

হিজাব আইনের বিরুদ্ধে এমনিতেই নারীরা বিক্ষুব্ধ ছিলেন। মাহসার মৃত্যু এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে নারীর পোশাক নিয়ে কঠোর রক্ষণশীলতার রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়া নারীরা তাদের হিজাব পুড়িয়ে, চুল কেটেও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

বিক্ষোভ দমনে ব্যাপক অভিযান চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। তবে তা কমিয়ে আনতে পারলেও পুরোপুরি দমন করা সম্ভব হয়নি। বিক্ষোভের অভিযোগে অন্তত ১১ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এদিকে এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে ইরান।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইরানের পরিস্থিতি নিয়ে নতুন সতর্কবার্তা দিয়েছে। তারা বলছে, ইরানে এখনো অনেক বিক্ষোভকারী কারাগারে রয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকে মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইরান এখন মাহান সাদরাত নামের ২২ বছর বয়সী এক তরুণের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এক মাস ধরে তার বিচার হয়েছে। তিনি ন্যায়বিচার পাননি বলেও মন্তব্য করেছে সংগঠনটি। মাহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি ছুরি নিয়ে বিক্ষোভে গিয়েছিলেন। তবে এ অভিযোগ আদালতে অস্বীকার করেছেন তিনি।

ইরানে কয়েকজন শিল্পীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা ইরানের শিল্পীদের নিয়ে ভয়ে আছি।’

প্রায় ৪৩ বছর আগে শিয়া ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি ফ্রান্সে নির্বাসিত থাকা অবস্থায়ই ইরানে কথিত ইসলামি বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। সেই বিপ্লবে শাহের রাজত্বের পতন ঘটে, ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ইরানে। এরপরই দেশটিতে হিজাব ও পোশাক-আচারে ধর্মীয় নিয়ম লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোরতা ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৯ সালের ৭ মার্চ আয়াতুল্লাহ খোমেনি ঘোষণা করেন, সব নারীর জন্য কর্মক্ষেত্রে হিজাব বাধ্যতামূলক। পর্দা ছাড়া নারীকে ‘নগ্ন’ বলে মনে করতেন তিনি।

এরপর বিভিন্ন সময়ে ইরানের ধর্মবাদী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। তবে এবারের আন্দোলন আগের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। এখন জনগণের একটা বড় অংশই রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার প্রত্যাশা করেন। সেই সঙ্গে আর্থিক ও ভ‚রাজনৈতিক চাপের মুখে রয়েছে ইরান প্রশাসন।

দেশটির অভিজাত ইসলামি রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি, ৫০ শতাংশের বেশি মুদ্রাস্ফীতির কারণে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া, পারমাণবিক আলোচনায় অচলাবস্থা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাব তরুণদেরসহ একটি বিরাট জনগোষ্ঠীকে হতাশ করে তুলেছে।

ইরানের ৩১টি প্রদেশের ১৬১ শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এ বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অন্তত ৪৮৮ জন বিক্ষোভকারী নিহত হন এবং মানবাধিকার কর্মীদের হিসাব মতে, এ পর্যন্ত অন্তত ১৮ হাজার ২৫৯ জনকে আটক করা হয়েছে। বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর ৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ইরান সরকারের ভাষ্যে, নিহতের সংখ্যা দুই শতাধিক। ইরানের অভিনেতা-অভিনেত্রী, ক্রীড়াবিদসহ বিভিন্ন অঙ্গনের বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি ইতিমধ্যে বিক্ষোভে সমর্থন দিয়েছেন। বিক্ষোভের মুখে কঠোর হিজাব আইনে পরিবর্তন আনার আভাস দিয়েছে ইরান সরকার।

প্রায় তিন মাস ধরে চলা বিক্ষোভের মুখে আলোচিত ও সমালোচিত নীতি পুলিশ বা হিজাব পুলিশ বিলুপ্ত করার কথা জানা গিয়েছিল। তবে এই বিষয় নিয়ে নতুন করে সংশয় দেখা দিয়েছে। ইরানের অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ জাফর মনতাজেরিকে উদ্ধৃত করে ফরাসি সংবাদমাধ্যম এএফপি জানায়, হিজাব পুলিশ বিলুপ্ত হচ্ছে। এক অনুষ্ঠানে মনতাজেরি বলেছেন, ‘ইরানের বিচার বিভাগের সঙ্গে নীতি পুলিশের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি বিলুপ্ত করা হচ্ছে।’

তবে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের এমন দাবি নাকচ করে দিয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম। বলা হয়েছে, দেশটির হিজাব পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে। এটি বিচার বিভাগের অধীনে না।

আরবি ভাষার আল-আলম টেলিভিশন দাবি করেছে, বিদেশি সংবাদমাধ্যমে মনতাজেরির মন্তব্যে বিক্ষোভের মুখে নীতি পুলিশ বিলুপ্ত করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু তার (মনতাজেরির) মন্তব্য ছিল, হিজাব পুলিশ সরাসরি বিচার বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ইরানের কোনো কর্মকর্তা এখনো বলেননি যে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

এবারের বিক্ষোভে প্রধান স্লোগান গান হলো- ‘নারী, জীবন, মুক্তি’- যা মূলত ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে অবস্থান ও সমতার আহ্বান। এ ছাড়া এবারের বিক্ষোভ আগের চেয়েও অনেক বেশি নারী-পুরুষ এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার দিক থেকে অংশগ্রহণমূলক।

এর আগে ২০০৯ সালে কথিত গ্রিন মুভমেন্টের সময় নির্বাচনে কারচুপির প্রতিবাদে হওয়া আন্দোলনে মধ্যবিত্তরাই অংশ নিয়েছিল। তখন বড় আন্দোলন হলেও সেটি বড় শহরগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। আবার ২০১৭ ও ২০১৯ সালের আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল দরিদ্রদের মধ্যে।

কিন্তু এবারের আন্দোলনে মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী- উভয় শ্রেণির মানুষ অংশ নিচ্ছে। এবারের আন্দোলনটি নারীদের নেতৃত্বে হচ্ছে; কিন্তু তারা অন্যদেরও আন্দোলনে শামিল করতে পেরেছেন। এমনকি সরকারের সমর্থকদের একটি অংশ, ইসলামি তাত্তি¡করাও এ আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তারা নারীর বিরুদ্ধে পুলিশের ব্যবহারের কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সরকারের হাতে দুটি বিকল্প আছে- একটি হলো হিজাব সম্পর্কিত নিয়ম পরিবর্তন করা। অথবা কোনো কিছুই পরিবর্তন না করা এবং সহিংস দমন বা বিক্ষোভকারীদের হত্যা করা। এগুলো সাময়িকভাবে পরিস্থিতিকে শান্ত করতে পারে; কিন্তু সেটি ক্রমবর্ধমান ক্ষোভকে রাষ্ট্রব্যবস্থা উচ্ছেদের পথ উসকে দেবে। তবে সরকার এখনো কট্টর অবস্থানেই রয়েছে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //