‘লাল ঢেউ’ না উঠলেও ট্রাম্প থাকছেন

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ছয় বছর পর পর সিনেট নির্বাচন হয়। দুই বছর পর পর অনুষ্ঠিত হয় হাউস অব রিপ্রেজেন্টিটিভসের (প্রতিনিধি পরিষদ) নির্বাচন। সেই হিসাবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মেয়াদ অর্ধেক হওয়ার সময় মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে প্রেসিডেন্টের পার্টির ক্ষমতা যাচাই হয়।

প্রসঙ্গত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট আর্থিক বা আইনগত কোনো বিশেষ সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট কংগ্রেসে পাস করাতে হয়।

এ নির্বাচনে ১০০ আসনের সিনেটের ৩৫টি আসনে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। সেই সঙ্গে প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনের সবগুলোতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে আগে থেকেই দাবি করা হয়েছিল যে, ভোটে ‘লাল ঢেউ’ উঠতে যাচ্ছে।

তবে ঠিক সেরকম কিছু দেখা না গেলেও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপস্থিতি ছিল সরব। প্রতিনিধি পরিষদে ইতোমধ্যে ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। যদিও রিপাবলিকানদের জয়ের ব্যবধান খুবই কম। যেমনটা তারা আশা করছিল তেমন জোয়ার আসেনি।

আর কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে ডেমোক্র্যাটদের পাওয়া আসনসংখ্যা ৫০টিতে দাঁড়িয়েছে। আর রিপাবলিকানরা জয় পেয়েছে ৪৯টি আসনে। 

এখন শুধু জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ফল বাকি আছে। আগামী মাসে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জর্জিয়ার ফল নির্ধারণ করা হবে। নেভাদায় জয়ের মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত হয়ে গেছে।

এই নির্বাচনের আগে শোনা যাচ্ছিল রিপাবলিকানরা ভালো করলেই ট্রাম্প ঘোষণা করবেন- আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হবেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ফল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য খুব সুখবর নয়। তিনি নিজে যাদের প্রার্থী হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে বাছাই করেছিলেন তাদের বেশিরভাগই তেমন ভালো করতে পারেনি।

সাবেক প্রেসিডেন্ট অবশ্য তার মার-এ-লাগোর বাসভবন থেকে সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে দাাবি করেন, তার অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রার্থীরা বিপুল ব্যবধানে জিতেছেন।

তবে বাস্তবতা হলো- পেনসিলভেনিয়াতে ইতোমধ্যে হেরে গেছেন তার বাছাই করা প্রার্থী মেহমেত অজ। জর্জিয়া ও অ্যারিজোনায় তার অনুমোদিত প্রার্থী ভালো করেননি। ওহাইওতে তার প্রার্থী জয় পেয়েছেন, তবে অল্প ব্যবধানে। ফলে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা এখনো যাচাই করছেন রিপাবলিকানরা।

তবে ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন ট্রাম্প। মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রচারে যে সমর্থন তিনি পেয়েছেন; সেই সঙ্গে জাতীয় বিভিন্ন নীতিগত প্রশ্নে ট্রাম্প বরাবরই প্রেসিডেন্টের বিপরীতে এক বিকল্প ক্ষমতা চর্চা করে আসছেন। যেমনটা অন্য কোনো সাবেক প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।

এদিকে ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান গভর্নর রন ডিসান্টিস বিপুল ব্যবধানে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য জিতেছেন। ধারণা করা হচ্ছে- এই জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে চ্যালেঞ্জ জানানোর একটা অবস্থান তৈরি করেছেন। যদিও প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা তিনি এখনো প্রকাশ করেননি। প্রসঙ্গত, ফ্লোরিডা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ সুইং স্টেট এবং সেখান থেকে তার বিপুল ব্যবধানে বিজয়কে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। 

তবে বিতর্কিত হলেও ট্রাম্পের মতো শক্তিশালী ইমেজ রিপাবলিকান দলে অন্য কারও নেই বলে মনে করা হচ্ছে। ২০২৪ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার ব্যাপারে ট্রাম্পের প্রার্থিতার বিপরীতে আর তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

ট্রাম্প ইতোমধ্যে ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডিসান্টিসকে ২০২৪এ প্রেসিডেন্ট পদের জন্য না দাঁড়ানোর ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রন দাঁড়ালে রিপাবলিকান পার্টির ক্ষতি হবে। ট্রাম্প ফক্স নিউজ টেলিভিশনে ৪৪ বছর বয়সী ডিসান্টিস রনের প্রতি হুমকিও দিয়েছেন- ‘আমি জানি না তিনি দাঁড়াবেন কিনা; কিন্তু যদি দাঁড়ান, তার খুবই ক্ষতি হবে।

আমি সত্যি মনে করি সেটা তার নিজের ও পার্টির জন্য খুবই খারাপ হবে।’ এমনটা হলে তিনি তার সম্পর্কে এমন সব তথ্য ফাঁস করে দেবেন, যা তার জন্য সুখকর হবে না।

এর আগে ট্রাম্পের ফ্লোরিডার বাড়ি মার-এ-লাগোতে অভিযান চালিয়ে ১১ হাজারের বেশি সরকারি নথি ও ছবি উদ্ধার করে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। এর মধ্যে কিছু নথি ‘টিএস/এসসিআই’ বলে চিহ্নিত করা। এর অর্থ হলো- এসব দলিলপত্রে এমন সব তথ্য আছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ‘নজিরবিহীন গুরুতর ক্ষতির’ কারণ হতে পারে।

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি ও গোপন নথি সরানোর অভিযোগ তোলা হয়। তখন ট্রাম্প বলেছেন, তিনি কোনো অন্যায় কাজ করেননি এবং এসব নথি গোপনীয় বলে যে তকমা ছিল তা তুলে নেওয়া হয়েছিল। তার কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানায়, প্রেসিডেন্ট পদে থাকাকালে ট্রাম্প ওই নথিগুলো গোপনীয় রাখা হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে ট্রাম্প গোপন এজেন্টদের নাম, গোপন অভিযান ও বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংবেদনশীল সম্পর্কসহ বিভিন্ন তথ্য ফাঁস করে দিতে পারেন। এ শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। যে কারণে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অবস্থান নেওয়া থেকে মার্কিন বিচার বিভাগ বিরত থাকছে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এটিকে অনেকে রাষ্ট্রের সঙ্গে ‘ব্ল্যাকমেইল’ বলেও অভিহিত করেছেন।

মার্কিন জাতীয় নীতির মূলে রয়েছে বিভাজনের রাজনীতি। এর মধ্য দিয়েই ক্ষমতা কাঠামো টিকে রয়েছে। বাইডেন ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বর্ণবাদী বিভাজন কমিয়ে আনার। আরও প্রতিশ্রুতি ছিল- ব্যক্তিগত পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করবেন।

তবে এর কোনোটিই সম্ভব হয়নি। বরং মার্কিন সমাজে বিভাজন আরও তীব্র হয়েছে। যার সবচেয়ে বড় প্রকাশ ঘটে মার্কিন পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ডে। যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নাগরিকের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে দুটি নীতি অনুসরণ করে। একটি আচরণ নীতি সাদাদের জন্য, একটি কালোদের জন্য। এই দুটি নীতি সহজাতভাবেই পৃথক ও অসম।

কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মীদের পীড়নমূলক আচরণ এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠছে। দেশটিতে পুলিশিংয়ের মারাত্মক বর্ণবাদী বাস্তবতা এবং পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রাণ হারানোর ঘটনার সমর্থনে মার্কিন নেতৃত্বের দৃঢ় অবস্থান পরিস্থিতিকে আরও শ্বাসরোধকর করে তুলেছে। মার্কিন সংস্থাগুলো কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের মানবিক আচরণের যোগ্য হিসেবে আমলে নিতে চায় না।

‘শ্বেতাঙ্গদের সেবা ও সুরক্ষা সবার আগে’- এটাই তাদের সামাজিক নীতিতে পরিণত হয়েছে, যা সামাজিক বিভক্তির এক জ্বলন্ত উদাহরণ। মার্কিন সমাজে গত ৭০ বছরের মধ্যে এ বিভক্তির দেয়াল বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছেন ট্রাম্প ও তার বিভাজনের রাজনীতি, যা যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

কার্যত ক্ষমতায় না থেকেও ট্রাম্প ক্ষমতাচর্চা করে চলেছেন তার শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের রাজনীতি ও মার্কিন সমাজে বর্ণবাদী বিভাজন আরও জোরালো হওয়ার কারণে। আর এর মধ্য দিয়েই নিজের ভবিষ্যৎ দেখছেন। ট্রাম্প জনগণের নৈরাশ্য, অনিশ্চয়তা, হুমকি ও ভয়কে জনপ্রিয়তা অর্জনের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেন।

সমস্যার সমাধান হোক বা না হোক, তিনি এসব সংকট কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সমর্থকদের মধ্যে আশা জাগাতে সক্ষম। যেটাকে বলা হয়, ‘সাংস্কৃতিক হতাশাবাদের’ সুযোগ নেওয়া। আর এটিই ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের মধ্যে নিজেকে হিরো হিসেবে উপস্থাপনের প্রবণতা আছে। ২০১৬ সালের নির্বাচন থেকেই ট্রাম্প ‘আমেরিকান শত্রুদের’ বিপরীতে নিজেকে হিরো দাবি করে আসছেন। যে কোনো জনসমাবেশে তার আগমনও ঘটে সেভাবেই।

এগুলো মানুষকে খুব সহজে প্রভাবিত করে। অনেকেই আবার ট্রাম্পকে মিথ্যাবাদী অ্যাখ্যা দেন। ওয়াশিংটন পোস্টের মতে, প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ট্রাম্প ৩০ হাজারের বেশি মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর সব অভিযোগ করেন। এসব মিথ্যাচারই তার প্রচারের অভিনব কৌশল।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, যখন কোনো বিষয় সম্পর্কে বারবার মিথ্যা বলা হয়, তখন তা একসময় মানুষের মনে সত্যে রূপান্তর হয়। মানুষ সেটি বিশ্বাস করতে শুরু করে। এই মিথ্যার পসরা সাজিয়ে ট্রাম্প আবারো নেমেছেন হোয়াইট হাউসের দৌড়ে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //