হিজাব-বিতর্কের অন্তরালে

ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) হিজাব নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বিজেপি কয়েক দশক ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউসিসি) চালুর আরজি জানিয়ে আসছে। তারা মুখে এটাকে ধর্মীয় চেতনার বাইরে বললেও কার্যত কথিত ভারতীয় সংস্কৃতির নামে ভগবত গীতা পাঠের মতো বিষয় বাধ্যতামূলক করতে চাইছে, যেটাকে সংখ্যালঘুরা হিন্দু আইন চালিয়ে দেওয়ার শামিল হিসেবে দেখছেন। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, হিজাব-বিতর্কে যেমন সরকারের বিভিন্ন সমালোচনা চাপা পড়ে যাচ্ছে, তেমনি আদালতের বিভক্ত রায়ে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার পথ আরও মসৃণ হচ্ছে।

ভারতের বিজেপিশাসিত রাজ্য কর্নাটকের উদুপির একটি কলেজে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর হিজাব পরা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। সেখান থেকেই এই হিজার-বিতর্কের শুরু। প্রথমে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিষিদ্ধ করা হয় হিজাব। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে বির্তক-প্রতিবাদ শুরু হয়।

ছাত্রীদের হিজাবের পাল্টা হিসেবে বেশ কয়েকটি জায়গায় ছাত্র-ছাত্রীরা গেরুয়া স্কার্ফ বা উত্তরীয় গায়ে ক্লাসে আসে। ভাইরাল হয় মুসকান নামে এক ছাত্রীর হিজাব পরে কলেজে ঢোকার ভিডিও। যেখানে দেখা যায়, পেছনে গেরুয়া ধ্বজাধারী বেশকিছু ছাত্র কার্যত তাকে তাড়া করতে করতে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিচ্ছে। পাল্টা ওই ছাত্রীও স্লোগান দেন- ‘আল্লাহু আকবার’ বলে। গোটা বিষয়টি নিয়ে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে কর্নাটক। এতে রাজনৈতিক প্রভাব খুবই স্পষ্ট। আগামী বছরই অনুষ্ঠিত হবে কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচন। এ বিতর্কের পেছনে যে ভোটের সমীকরণ রয়েছে, সেটিও সামনে এসেছে।

হিজাব-বিতর্কের এক পর্যায়ে সরকারি নির্দেশনায় জানানো হয়, প্রি-ইউনিভার্সিটির আওতায় যে সরকারি কলেজগুলো রয়েছে সেখানে কলেজ ডেভেলপমেন্ট বোর্ড যে পোশাক নির্দিষ্ট করেছে সেটাই থাকবে। আর যেখানে এই পোশাকবিধি নেই, সেখানে শিক্ষার্থীরা এমন পোশাক পরতে পারে, যাতে  সম্প্রীতি, সমতা ও আইনশৃঙ্খলা বজায় থাকে। ১৯৮৩ সালের শিক্ষা আইনের কথা উল্লেখ করে নির্দেশিকায় বলা হয়েছে- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট করে দেওয়া পোশাক পরেই শিক্ষার্থীদের কলেজে আসা বাধ্যতামূলক।

হিজাব-বিতর্কের পর সেই ইস্যুই গড়িয়েছে আদালতে।

রাজ্যের মুসলিম ছাত্রীরা সরকারের হিজাব নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কর্নাটকের হাইকোর্টে আবেদন করে। এতে বেশ কিছু সাংবিধানিক প্রশ্ন রয়েছে বলে মামলাটি বৃহত্তর বেঞ্চে পাঠানো হয়। কর্নাটক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ঋতু রাজ অবস্থি, বিচারপতি কৃষ্ণা এস দিক্ষীত ও বিচারপতি জেএম কাজির বেঞ্চে ছিল সেই মামলার শুনানি। সংবিধানে হিজাব পরার অধিকারের কথা উল্লেখ রয়েছে কিনা, হিজাব পরা কোনো জরুরি ধর্মীয় রীতি কিনা, সেসব নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে আদালতে। 

ভারতের মোটর ভেহিকেলস আইনে শিখদের জন্য ছাড় রয়েছে। সেখানে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রীদের কেন হিজাব পরায় বাধা দেওয়া হচ্ছে, সেই প্রশ্নই তুলেছেন কর্নাটকে ওই ছাত্রীদের পক্ষে আদালতে দাঁড়ানো আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে। উল্লেখ্য, ভারতের মোটর ভেহিকলস আইনে হেলমেট পরার ক্ষেত্রে ছাড় রয়েছে শিখ ধর্মের পুরুষদের। তাদের মাথায় পাগড়ি বা টার্বান থাকলে হেলমেট পরতে হবে না- এ কথা বলা আছে আইনে। এর বিপরীতে কর্নাটকের শিক্ষা সংক্রান্ত আইনে ইউনিফর্মের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

সঞ্জয় হেগড়ে আরও জানান, ১৯৮২ সালে তিনি নিজেও কর্নাটকের সরকারি কলেজের ছাত্র ছিলেন, তাদের কোনো ইউনিফর্ম ছিল না। ইউনিফর্ম শুধু স্কুলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। কলেজের ক্ষেত্রে অনেক পরে ইউনিফর্মের প্রচলন হয়। তবে এর বাধ্যবাধকতা নেই। তাই নিয়ম লঙ্ঘনের কোনো প্রশ্ন থাকাও উচিত না। আর ভাঙলে জরিমানার কোনো প্রশ্নও নেই।

গত ১৫ মার্চ ছাত্রীদের করা আবেদন খারিজ করে দেন কর্নাটক হাইকোর্ট। রায়ে আদালত জানান, শ্রেণিকক্ষের ভেতরে ছাত্রীদের হিজাব পরার অনুরোধ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের জন্য অপরিহার্য ধর্মীয় চর্চার অংশ নয়। অর্থাৎ হিজাব ইসলাম ধর্মের অপরিহার্য অংশ নয়। কার্যত এর মধ্য দিয়ে হিজাব পরার মতো সব নাগরিকের ধর্মচর্চার যে স্বাধীনতার কথা ভারতের সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে, তা লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেই রায়ের বিরুদ্ধেই সুপ্রিমকোর্টে মামলা করেছিলেন মুসলিম ছাত্রীরা।

স্কুল-কলেজের শ্রেণিকক্ষে মুসলিম ছাত্রীরা হিজাব পরতে পারবে কিনা, তা নিয়ে ১৩ অক্টোবর রায় শোনানোর কথা ছিল সুপ্রিমকোর্টের; কিন্তু কোর্টের দুই বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি।

হিজাব পরা নিয়ে পরস্পরবিরোধী মত প্রকাশ করেছেন তারা। কোর্টের এক বিচারপতি কর্নাটক হাইকোর্টের ওই রায় বহাল রেখেছেন। আরেক বিচারপতি বলেছেন, হাইকোর্টের ওই আদেশ ভুল ছিল। হিজাব পরা ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। দুই বিচারকের এই ভিন্নমতের ফলে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। নিয়মানুযায়ী এখন বিষয়টি চলে যাবে সুপ্রিমকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে। প্রধান বিচারপতি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

তবে খণ্ডিত এ রায়ে হিজাব নিয়ে বিতর্ক আরও দীর্ঘ হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। মামলার শুনানি হয়েছিল বিচারপতি হেমন্ত গুপ্ত ও বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়ার বেঞ্চে। বেঞ্চের নেতৃত্বে থাকা বিচারপতি হেমন্ত গুপ্ত কর্নাটক হাইকোর্টের হিজাব নিষিদ্ধের রায় বহাল রেখে ছাত্রীদের আবেদন খারিজ করেন। 

মামলার শুনানিকালে বিচারপতি হেমন্তের কিছু মন্তব্য ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি আক্রমণাত্মক, যা সংবাদমাধ্যমের শিরোনামও হয়েছে। তিনি হিজাব পরার অধিকারের পক্ষে যুক্তি দেওয়া এক আইনজীবীকে বলেছিলেন, ‘আপনি এটাকে অযৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন না। পোশাক পরার অধিকারের মধ্যে পোশাক খোলার অধিকারও অন্তর্ভুক্ত থাকবে কিনা?’

হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি

আগামী বছরই কর্নাটকে বিধানসভা নির্বাচন। তাই হিজাব-বিতর্ক উস্কে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে- হিজাব নিষিদ্ধ করতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘসহ (আরএসএস) বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী গ্রুপ কলেজ কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ দিয়েছে। উদুপি থেকেই শুরু হয়েছিল হিজাব-বিতর্ক। স্থানীয় বিজেপি বিধায়ক রঘুপতি ভাট এই বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। সেই সঙ্গে কুণ্ডাপুরের বিজেপি বিধায়ক শ্রীনিবাস শেট্টিও হিজাব পরে শিক্ষাঙ্গনে আসার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান প্রকাশ করেন।

এ প্রসঙ্গে প্রবীণ কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরাতে কিছু মানুষ হিজাব- বিতর্ক উস্কে দিচ্ছে। কর্নাটকে হিজাব ইস্যুটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভোটের মেরুকরণের জন্য এবং হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বিবাদ উস্কে দেওয়ার জন্য করা হচ্ছে। কিছু রাজনৈতিক দল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নেপথ্যে রয়েছে।’

কর্নাটকে কংগ্রেসের রাজনৈতিক অঙ্ক ভিন্ন। বিজেপির ধর্মীয় রাজনীতির বিপরীতে তারা সেখানে নিম্নবর্ণের রাজনীতিকে উপজীব্য করে। সেখানকার জেলে সম্প্রদায় মোগাবিরা ও বিল্লাভা নৃগোষ্ঠী তাদের বড় ভোটব্যাংক। বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পাল্টা হিসেবে কংগ্রেস এখানে জাতপাতের রাজনীতিতে স্বার্থরক্ষা করতে চায়। তবে মুশকিল হলো- কর্নাটকের অন্যান্য অঞ্চলে বর্ণ একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে, তবে হিজাব- বিতর্কে ওই উপকূলীয় কর্নাটকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আধিপত্য রয়েছে। সেখানে তাই জাতপাত ছাপিয়ে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন মুখ্য হয়ে উঠেছে।

কংগ্রেস জাতপাতের ভিত্তিতে রাজনীতি করায় এ অঞ্চলের ধর্মীয় রাজনীতিতে হিন্দু- মুসলিম বিভাজনকে উস্কে দিতে চাইছে বিজেপি। তারা জানত যে, বিল্লাভা ও মোগাভিরারা যদি হিন্দুত্বের ব্যানারে একত্র না হয়ে জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট দেয়, তবে তা কংগ্রেসের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। হিজাব- বিতর্ক পরিস্থিতিকে হিন্দু বনাম মুসলিম হিসেবে বদলে দিয়েছে।

মুসলিমদের আশঙ্কা, ইউনিফর্ম সিভিল কোডের নামে আইন জারি করতে হিন্দুত্ববাদী গ্রুপগুলোর বড় অ্যাজেন্ডার অংশ এই ধরনের বিতর্ক। এরই মধ্যে দেশজুড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘কমন ড্রেস কোড’ বাস্তবায়ন করতে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতেও আবেদন করা হয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউনিফর্ম সিভিল কোডের সঙ্গে হিজাব পরিধানের কোনো সম্পর্ক নেই। বর্তমান ভারতে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দুটি প্রক্রিয়া কাজ করছে, যা একে অপরের পরিপূরক। 

একটি দীর্ঘমেয়াদি, অন্যটি স্বল্পমেয়াদি। দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়াটি হলো ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুত্বে’র ধারায় ভারতকে ঢেলে সাজানো। যেখানে ইউনিফর্ম সিভিল কোডকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর স্বল্পমেয়াদি প্রক্রিয়াটি হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ আধিপত্যের নির্বাচনী খেলায় সাম্প্রদায়িকতাকে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় নিয়ে আসা। যেখানে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক বিতর্ক তুলে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফেরানো, জনগণকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব। আর এই ক্ষমতাচর্চার মধ্য দিয়ে আরএসএসের মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো তাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের দিকেই এগোচ্ছে ক্রমাগত।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //