‘নীতি পুলিশে’ চ্যালেঞ্জে ইরান

ইরানে ইসলামের আদর্শ ও আইন ঠিকঠাক মেনে চলা হচ্ছে কি না, তা নজরদারি করে বিশেষ পুলিশ বাহিনী গাশত-ই-এরশাদ। কারও পোশাক ধর্মীয় নির্দেশনার সঙ্গে ‘অসঙ্গতিপূর্ণ’ হলে তাকে আটক করে শাস্তি দেয় তারা। নারীদের সঠিকভাবে হিজাব পরা নিয়ে এ বাহিনীটি সবচেয়ে সরব। যে কারণে এ নীতি পুলিশ বাহিনীকে ‘হিজাব পুলিশ’ বলে ডাকা হয়। 

ঘটনার শুরু গত ১৪ সেপ্টেম্বর, যখন আরও অনেকের সঙ্গে ২২ বছর বয়সী কুর্দি-ইরানি তরুণী মাহশা আমিনিকেও সঠিকভাবে হিজাব পরিধান না করার অপরাধে গ্রেপ্তার করে নীতি পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তারা ব্যাটন দিয়ে আমিনির মাথায় আঘাত করেছিলেন এবং তাদের গাড়ির সঙ্গে আমিনির মাথা ঠুকে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠলেও নীতি পুলিশ তা পুরোপুরি অস্বীকার করছে। দুদিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। মাহশার জানাজার ক্ষোভের আগুন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। হিজাব আইনের বিরুদ্ধে এমনিতেই নারীরা বিক্ষুব্ধ ছিলেন। মাহশার মৃত্যু এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে নারীর পোশাক নিয়ে কঠোর রক্ষণশীলতার রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়া নারীরা তাদের হিজাব পুড়িয়ে, চুল কেটেও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

এই প্রতিবাদে স্মরণীয় হয়ে আছেন হোমা দারাবি। বিক্ষোভে তার নামও উচ্চারিত হচ্ছে। টকশোতে এই নামটি বারবার এসেছে। হোমা দারাবি একজন  শিশু বিশেষজ্ঞ এবং তিনি ইরান নেশন পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি এমবিবিএস শেষে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। ১৯৭৬ সালে ইরানে ফিরে আসেন এবং তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশু মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে ‘হিজাবের প্রতি আনুগত্য না দেখানো’র অভিযোগে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করা হয়। ১৯৯৩ সালের মে মাসে ট্রাইব্যুনাল এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তার অবস্থান তাকে ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

এই ঘটনার পর প্রতিবাদ হিসেবে, দারাবি ১৯৯৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাজরিশের কাছাকাছি একটি জনবহুল রাস্তায় দাঁড়িয়ে হিজাব খুলে ফেলেন। এরপর মাথায় পেট্রল ঢেলে  গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। পরদিন একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। মাহশা আমিনির মৃত্যুর পর যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা হোমা দারাবির কথা মনে করিয়ে দেয়। হোমার মৃত্যুর পরও ইরানজুড়ে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল।

তবে এবারের আন্দোলন আগের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। তখনো ইরানে ইসলামি বিপ্লবের মোহ জনগণের বহুলাংশকেই আচ্ছন্ন করেছিল, এখন সে অবস্থা অনেকটাই পরিবর্তিত। জনগণের একটা বড় অংশই রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার প্রত্যাশা করেন। সেই সঙ্গে আর্থিক ও ভূরাজনৈতিক চাপের মুখে রয়েছে ইরান প্রশাসন। আরেকটা বড় মাথাব্যথা- কুর্দি বিদ্রোহ। মাহশা জাতিগতভাবে কুর্দি। যে কারণে ইয়ারানের কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চল কার্যত অগ্নিকুন্ড হয়ে রয়েছে। সেখানকার অনেক শহরে কারফিউ জারি করতে বাধ্য হয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। অন্তত ১৭ বিক্ষোভকারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শুধু ইরানেই নয়; ইরাক, সিরিয়ার ইরানি পতাকা পুড়িয়ে বিক্ষোভ জানিয়েছে কুর্দিরা। 

প্রায় ৪৩ বছর আগে আয়াতুল্লাহ খোমেনি ফ্রান্সে নির্বাসিত থাকা অবস্থায়ই ইরানে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। সেই বিপ্লবে শাহের রাজত্বের পতন ঘটে, ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ইরানে। এরপরই দেশটিতে হিজাব ও পোশাক-আচারে ধর্মীয় নিয়ম লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোরতা ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৯ সালের ৭ মার্চ আয়াতুল্লাহ খোমেনি ঘোষণা করেন, সব নারীর জন্য কর্মক্ষেত্রে হিজাব বাধ্যতামূলক। পর্দা ছাড়া নারীকে ‘নগ্ন’ বলে মনে করতেন তিনি। সে সময় তেহরানে হিজাববিরোধী প্রথম বিক্ষোভের আয়োজনে ভূমিকা রেখেছিলেন ৭৮ বছর বয়সী আইনজীবী, অধিকার কর্মী মেহরানগিজ কর।

বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থানরত মেহরানগিজ বলেন, ‘এসব রাতারাতি হয়নি, ধাপে ধাপে করা হয়েছিল। বিক্ষোভ শুরু হতেই রাজপথে নারী আর পুরুষের ঢল নামে। সে সময় নারী দিবসে এক লাখের বেশি মানুষ তেহরানের সড়কে জমায়েত হয়েছিল, যাদের বেশিরভাগ ছিলেন নারী। খোমেনির ওই ঘোষণার পর ইরানি কর্তৃপক্ষের একটু সময় লেগেছিল নারীর পোশাক কী হবে তা নির্ধারণ করতে। তখন স্পষ্ট করে কিছু বলা ছিল না। তারপর নারীর কেমন পোশাক পরতে হবে এমন ছবি অফিসের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। বলা হলো- ‘নারীকে হিজাব পরার ওই নির্দেশ মেনে চলতে হবে। অন্যথায় অফিসে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’ 

নারীর ‘ইসলামি’ পোশাক পরায় আইনি বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয় ১৯৮১ সালের মধ্যে। ১৯৮৩ সালে ইরানের পার্লামেন্টে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যে নারীরা জনসমাগমে চুল ঢেকে রাখবে না, তাদের ৭৪ দোররা মেরে শাস্তি দেওয়া হবে। পরে ৬০ দিনের হাজতবাসের শাস্তির বিধানও যোগ করা হয় তার সঙ্গে। মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ২০০৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরই গঠন করা হয় গাশত-ই-ইরশাদ। এর আগ পর্যন্ত ড্রেস কোড নজরদারিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য শাখা ও সংসদীয় ইউনিট কাজ করছিল। এই নীতি পুলিশের আছে বিশেষ ক্ষমতা। তারা যে কোনো জায়গায় নারীকে থামিয়ে দেখতে পারবে। কারও পোশাকে বা চালচলনে নিয়ম লঙ্ঘন হলো কি না, চুল বেশি দেখা যাচ্ছে কি না, সেলোয়ার ও কোট বেশি ছোট ও চাপা কিনা অথবা অতিরিক্ত মেকআপ নিয়েছেন কিনা, তা দেখার দায়িত্বও এই বাহিনীর। 

চাপে সরকার

এবারের আন্দোলন এমন সময় ঘটেছে যখন ইরানের মানুষ এমনিতেই ক্ষুব্ধ। দেশটির অভিজাত ইসলামি রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি, ৫০ শতাংশের বেশি মুদ্রাস্ফীতির কারণে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া, পারমাণবিক আলোচনায় অচলাবস্থা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাব তরুণদেরসহ একটি বিরাট জনগোষ্ঠীকে হতাশ করে তুলেছে। ইরানের সোশ্যাল সিকিউরিটি অর্গানাইজেশন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, দেশটির অন্তত আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং ক্রমশ এই সংখ্যা বাড়ছে। 

এবারের বিক্ষোভের প্রধান স্লোগান হলো, ‘নারী, জীবন, মুক্তি’- যা মূলত ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে অবস্থান ও সমতার আহ্বান। এ ছাড়া এবারের বিক্ষোভ আগের চেয়েও অনেক বেশি নারী-পুরুষ এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার দিক থেকে অংশগ্রহণমূলক। এর আগে ২০০৯ সালে কথিত গ্রিন মুভমেন্টের সময় নির্বাচনে কারচুপির প্রতিবাদে হওয়া আন্দোলনে মধ্যবিত্তরাই অংশ নিয়েছিল। তখন বড় আন্দোলন হলেও সেটি বড় শহরগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। আবার ২০১৭ ও ২০১৯ সালের আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল দরিদ্রদের মধ্যে। কিন্তু এবারের আন্দোলনে মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী- উভয় শ্রেণির মানুষ অংশ নিচ্ছে। এবারের আন্দোলনটি নারীদের নেতৃত্বে হচ্ছে; কিন্তু তারা অন্যদেরও আন্দোলনে শামিল করতে পেরেছেন। এমনকি সরকারের সমর্থকদের একটি অংশ, ইসলামি তাত্ত্বিকরাও এ আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তারা নারীর বিরুদ্ধে পুলিশের ব্যবহারের কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সরকারের হাতে দুটি বিকল্প আছে- একটি হলো হিজাব সম্পর্কিত নিয়ম পরিবর্তন করা। আবার এটি করলে সেটি অনেক বিক্ষোভকারীকে সরকার পরিবর্তনের দাবি আদায়ের দিকে উৎসাহিত করে তুলতে পারে। অথবা কোনো কিছুই পরিবর্তন না করা এবং সহিংস দমন বা বিক্ষোভকারীদের হত্যা করা। এগুলো সাময়িকভাবে পরিস্থিতিকে শান্ত করতে পারে; কিন্তু সেটি ক্রমবর্ধমান ক্ষোভকে রাষ্ট্রব্যবস্থা উচ্ছেদের পথ উসকে দেবে। এর বিপরীতে কিছু সংস্কারের আশ্বাস ও পুলিশ বাহিনীর যেসব সদস্য দমন পীড়ন করেছে তাদের শাস্তি দিয়ে ক্ষোভ নিরস্ত করার দিকে এগোতে পারে সরকার। তবে জনগণ একবার যখন নিজের অধিকার সম্পর্কে বলতে শিখেছে, তখন তার মুখ আটকে রাখা ইরান প্রশাসনের জন্য সহজ হবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //