নারী নেতৃত্ব বিশ্বের জন্য শুভ

উন্নয়নশীল বিশ্বের জনগণ প্রাচীন মূল্যবোধে বিশ্বাসী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে তার কণ্ঠস্বর বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দিতে অনেক লড়াই করতে হয়। ধারণাগুলো বহুল প্রচলিত; কিন্তু যুগ পাল্টেছে। আধুনিক বিশ্বের নেতৃস্থানীয় নারীদের কার্যক্রমে পরিলক্ষিত হয় বিপরীত চিত্র।

বর্তমান বাস্তবতার নীরিখে বলা যায়, নারী নেতৃত্ব গোটা বিশ্বের জন্যই মঙ্গলজনক। নারীকে হয়তো এখনো লড়াই করতে হয় তার অধিকারের জন্য; কিন্তু নিজ অধিকারের জন্য লড়াইয়ের পাশাপাশি তারা সুদৃঢ় কণ্ঠে তুলে ধরছেন নানা সামাজিক সমস্যা। এসব সামাজিক সমস্যা নিরসনে পদক্ষেপও নিচ্ছেন সুদৃঢ় চিত্তে। প্রকৃতপক্ষে, মহামারী, জলবায়ু সংকট, শিক্ষা ও অবকাঠামোসহ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা মোকাবেলার ক্ষেত্রে বিশ্বের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা এই দৃঢ় মনোভাবাপন্ন নারীদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিতে পারেন। 

উন্নয়নশীল বিশ্বে সফল নারী নেতৃত্ব নতুন কিছু নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ইন্দিরা গান্ধী বেশ ক্ষমতাধর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই ছিলেন। দেশ পরিচালনা করেছেন দাপটের সঙ্গে দক্ষ হাতে। আফ্রিকার কিছু দেশেও নারী নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে বিস্ময়কর গতিতে। 

এলেন জনসন সারলিফ ২০০৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পশ্চিম আফ্রিকার দেশ লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার সময় দেশটির অবস্থা ছিল বেশ সঙ্গীন। দুই মেয়াদে তিনি লাইবেরিয়ার জনগণের পক্ষেঅক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আজও দেশটিকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এলেন জনসন সারলিফ বারো বছর চাকরির সুবাদে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ক্ষমতা অর্জনের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। এই অবদানের জন্য ২০২০ সালে টাইম ম্যাগাজিনের বছরের শীর্ষ ১০০ নারীর তালিকায় জায়গা করে নেন তিনি। 

দক্ষিণ আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান নারী নেতাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মনদীপ রাই। প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক অনলাইন পোর্টাল গার্ডিয়ানে। মনদীপ রাই ‘দ্য ভ্যালুজ কমপাস: হোয়াট ১০১ কান্ট্রিজ টিচ আস অ্যাবাউট পারপাস, লাইফ অ্যান্ড লিডারশিপ’ বইয়ের লেখক। তিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুরিনাম, গায়ান, ত্রিনিদাদ, টোব্যাগো এবং বারবাডোজের নেতৃস্থানীয় নারীদের।

উন্নয়নশীল এই অঞ্চলে একদিনে নারীরা নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেননি। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য অনেক চড়াই-উতরাই অতিক্রম করতে হয়েছে তাদের। বিক্ষোভপূর্ণ সময়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে জনগণের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছে। আর এটিই এই নারীদের সাফল্যর অন্যতম চাবিকাঠি। 

মিডা মটলি ক্যারিবিয়ান এবং দক্ষিণ আমেরিকাজুড়ে সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো মোকাবেলা করা শক্তিশালী নারীদের একজন। ক্ষমতা গ্রহণের পর এই বারবাডিয়ান প্রধানমন্ত্রী মিয়া মটলি পাল্টে দিয়েছেন দেশের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা। কর্মক্ষেত্রে স্বচ্ছ তিনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনসম্মুক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তাদের অধিকার অর্জনে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছেন। ক্যারিবিয় অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে প্রকৃত সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। কোভিড সংকটের সময় বারবাডোজের অর্থনীতি স্থিতিশীল ও টেকসই রাখতে তার অবদান অনেক। এসময় দেশটিতে নিরাপদ বিনিয়োগের নিশ্চয়তাও দিয়েছেন মটলি। বারবাডোজের মতো দেশ কখনোই বিশ্ব অর্থনীতি বা রাজনীতির গল্পে প্রধান চরিত্র নয়। তবুও নিজের অবস্থান থেকে মটলি জলবায়ু সংকট এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়নের মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন। এ অঞ্চলে মটলি তার কাজের বরাতে সমর্থনও পাচ্ছেন প্রচুর। ভোর ৫টায় ঘুম ভেঙে গায়ানার প্রেসিডেন্ট ইরফান আলী বিখ্যাত ফিশ কারি রান্না করে পরের ফ্লাইটে তা যত্ন সহকারে পাঠিয়ে দেন মটলির জন্য, যা মটলির প্রতি সমর্থনেরই ইঙ্গিত। 

নেতৃত্ব ভাগাভাগির ক্ষেত্রে ‘ফার্স্ট লেডি’ ভূমিকা রাখতে পারেন, বিষয়টি মুগ্ধ করেছে মনদীপ রাইকে। তিনি জানান, সুরিনামের ফার্স্ট লেডি মেলিসা সানতোখি-সিনাচেরি সরকারি নীতির সহায়তার মাধ্যমে নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছেন যে, ‘কেউ পিছিয়ে থাকবে না’। তিনি সফল আইনজীবী। নারী নেতৃত্ব, ক্ষমতায়ন ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রচারণামূলক কাজ করছেন মেলিসা। 

পিছিয়ে নেই গায়নার ফার্স্ট লেডি আরিয়া আলীও। তিনি অন্তর্ভূক্তিমূলক কাজের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশব্যাপী নারী, মেয়ে, প্রতিবন্ধী ও শিশু সহায়ক স্কিম চালু করতে পদক্ষেপ নিয়েছেন আরিয়া। পারিবারিক সহিংসতা, ধর্ষণের মতো চ্যালেঞ্জগুলো নিয়েও কাজ করতে ভয় পান না তিনি। এর জন্য সাহস ও ইচ্ছে লাগে। তার এ দুটোই রয়েছে প্রচুর পরিমাণে।

এক্ষেত্রে গায়ানার আনেট আরজুনের কথা না বললেই নয়। তিনি তার পরিবেশ ও সম্প্রদায়গত কাজের জন্য গোটা বিশ্বে বহুল পরিচিত। আরজুন দেশের প্রথম এবং সবচেয়ে সফল সংরক্ষণ অলাভজনক সংস্থা (এনজিও) গায়ানা মেরিন টার্টল কনজারভেশন সোসাইটি প্রতিষ্ঠার জন্য দায়বদ্ধ। এই এনজিও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের পথের নেতৃত্ব দিচ্ছে।

এই ধরনের নেতৃত্ব রয়েছে- ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগোর বেসরকারি খাতে। যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এখানে ও জ্যামাইকায় নারী প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের (সিইও) প্রতিনিধিত্ব বেশি। ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগোর বিজনেস হলো, অব ফেইম অ্যাওয়ার্ড জয়ী অ্যাঞ্জেলা লি লয় কোভিডকালে তার কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছেন। বাড়ি থেকে কাজ করার সুবিধা দিচ্ছেন। কর্মীদের বাড়িতে কোনো সমস্যা হলেও তা সমাধানে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সর্বোপরি সবক্ষেত্রেই কর্মীদের সমর্থন জুগিয়ে চলেছেন অ্যাঞ্জেলা। এই উদ্যোক্তার ভাষ্যে, আমি বিশ্বাস করি, তাদের গার্হস্থ্য জীবনে সমর্থনের প্রয়োজন হলে, তা আমাদেরও উদ্বেগের কারণ হওয়া উচিত। এই সমর্থনের জন্য তার কর্মীরা কর্মরত ও অনুগত রয়েছেন।

এ অঞ্চলের নারী নেতাদের জন্য এভাবে এগিয়ে যাওয়ার পথটি কখনোই সহজ ছিল না। এখানকার লক্ষ্যণীয় নারীরা সাহসের সঙ্গে সব বাধা অতিক্রম করে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছেন। স্থাপন করেছেন বিশ্বের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। উদ্দেশ্য, আবেগ ও সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে থাকা মানুষদের সঙ্গী করে এই নারীরা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছেন। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিশ্ব পরিচালনায় নারীর সংখ্যা বাড়লে আমূল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে সব খাতে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //