ক্যাপিটল হিল হামলার ১ বছর

যুক্তরাষ্ট্রে বেড়েছে অভ্যুত্থানের শঙ্কা

বিশ্বজুড়ে ডানপন্থার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের সংকট এক বাস্তবতা। আফ্রিকা, এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে গত কয়েক বছরে। ১৯৫০ সালের পর থেকে আফ্রিকার দেশগুলোতে ২০০ বারেরও বেশি ক্যু প্রচেষ্টা রয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেক সফল হয়েছে, অর্থাৎ এসব প্রচেষ্টা অন্তত সাত দিন স্থায়ী ছিল।

গত বছর মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ভোটে নির্বাচিত সরকার উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করে। এসব দুর্বল গণতন্ত্রের দেশ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সমালোচনা করেছে, অবরোধ দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র মডেলের গণতন্ত্রের দীক্ষা দিতে চেয়েছে। তবে এবার খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করছেন দেশটির একজন সাবেক জেনারেল। ক্যাপিটল হিল হামলার বর্ষপূর্তিতে এমন দাবি নিশ্চিতভবেই মার্কিন ব্যবস্থার রাজনৈতিক সংকটকেই নির্দেশ করে। 

গত বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ক্যাপিটল হিল হামলার বার্ষিকীকে সামনে রেখে সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনপিআরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক মেজর জেনারেল পল ইটন বলেন, ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফলাফল নিয়ে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হলে সামরিক অভ্যুত্থানের মুখে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ওই নির্বাচনের পর কে কমান্ডার ইন চিফ হবেন- এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী দাবির মুখে সামরিক বাহিনী অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। সামরিক বাহিনীর অনেক সদস্যই বুঝে উঠতে পারবেন না যে, তারা কার নির্দেশে চলবেন। তখন সামরিক অভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতিও দেখা দিতে পারে। পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে পল ইটন বলেন, ২০২০ সালের নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ করে ১২৪ জন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ও অ্যাডমিরাল একটি চিঠিতে সই করেছিলেন। তখনো এমন সম্ভাবনা জোরদার হয়ে উঠেছিল।

উল্লেখ্য, ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেন বিজয়ী হলেও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী দাবি করে ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। এ অবস্থায় গত বছর ৬ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের জয় আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করার জন্য অধিবেশন চলার সময় সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ সমর্থক মার্কিন পার্লামেন্ট ক্যাপিটল হিলে হামলা চালায়।

ট্রাম্প সমর্থকদের এ তাণ্ডবের পর রিপাবলিকান সমর্থকদের মধ্যে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৪৫ শতাংশই হামলাটিকে সমর্থন করছেন। বিশ্বজুড়ে নিন্দার পরও ৮৫ শতাংশ রিপাবলিকান সমর্থক মনে করছেন, ট্রাম্পকে তার বাকি সময়ের জন্য সরিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। আর সেটিই ভয় জাগাচ্ছে বিরোধী শিবিরে। জো বাইডেনের কাছে ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে ট্রাম্প আরও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারেন বলে ধারণা অনেকেরই। তার সমর্থকরা সক্রিয় আরেকটি ‘বিপ্লব’ ঘটাতে।

জরিপের এমন ফলে ভবিষ্যতেও ঘোর বিপদ দেখছেন সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজকর্মীরা। তারা মনে করেন, ট্রাম্প হোয়াইট হাউস ছাড়াতেই ‘ট্রাম্পবাদ’ এবং ফ্যাসিবাদের বিপদ দূর হয়ে যাবে না। বামপন্থী লেখক পিট ডোলাক বলেন, ‘ক্যাপিটলের ঘটনার পরে আর কোনো সন্দেহই নেই যে, যুক্তরাষ্ট্র ফ্যাসিস্ট উত্থানের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। স্বৈরাচারী হওয়ার মতো ট্রাম্পের যথেষ্ট বুদ্ধি ছিল না, শাসক শ্রেণির যথেষ্ট সমর্থনও ছিল না; কিন্তু আরেকজন বাগাড়ম্বরকারীর উত্থান যথেষ্টই সম্ভব এবং তিনি ট্রাম্পের মতো নির্বোধ নাও হতে পারেন।’

এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী ওয়াল্ডেন বেলো বলেন, ‘ক্যাপিটল ভবনে হামলাই দেখিয়ে দিচ্ছে, আগামী চার বছর যুক্তরাষ্ট্রে অনিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক সংঘাত হতে পারে।’ সমাজতাত্ত্বিক স্যামুয়েল ফারবার অবশ্য বলেন, ‘ট্রাম্পবাদ নামে পরিচিত খোলামেলা স্বৈরাচারী, বর্ণবিদ্বেষী, গণবিদ্বেষী, বিজ্ঞানবিরোধী রাজনীতি ততক্ষণ থাকবে; যতক্ষণ তার শিকড় উপড়ে ফেলা যাবে না। অর্থনৈতিক অবক্ষয় এবং তথাকথিত নৈতিক অবক্ষয়ের বস্তুগত পরিস্থিতিতে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়া ঘটতেই থাকবে।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন ওই ঘটনায় দেশটির গণতান্ত্রিক ভাবমর্যাদা ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ হয় এবং দেশটির রাজনীতিতে বিরাজমান বিভক্তি প্রকাশ্যে আসে। আগামীতে আবারও একই ধরনের ঘটনা ঘটলে, বিশ্ব মোড়ল এ দেশটি আরও বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেইসঙ্গে ক্ষমতার বাইরে থেকেও ট্রাম্প বিকল্প সরকার চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত নির্বাচন দুটি বিপরীত চিত্রকে তুলে ধরেছে। ভোটদাতাদের প্রায় অর্ধেক ট্রাম্প ও তার চেতনার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। সেই ৭১ মিলিয়ন মার্কিন জনগণ ওই সমাজ ও দেশেরই নাগরিক। গত মার্কিন নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে- ট্রাম্পের দল সম্পদের উৎকট বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, উগ্র জাতি-বিদ্বেষ পোষণ করে, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি ঘৃণা পুষে রাখে, নারী-বিদ্বেষে বিশ্বাস করে, নিশ্চিত করতে চায় যে, সাদা এলিটরা মার্কিন সমাজে নিজেদের দাপট বহাল রাখবে, গোটা বিশ্বের ওপর ছড়িটা ঘোরাবে কেবল তাদের দেশই। অপরদিকে ডেমোক্রাটিক পার্টি মুখে না বললেও প্রায় একই আধিপত্যের চেতনা ধারণ করে, তবে তারা উগ্রপন্থী নয়, নরমপন্থী। এসব নানা কারণেই নরমপন্থীদের বদলে ট্রাম্পের উগ্রপন্থী বিদ্বেষী চিন্তা প্রতিনিয়ত শক্তিশালী হচ্ছে।

উল্লেখ্য, মার্কিন প্রশাসনের সাধারণ এবং অঘোষিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, সাবেক প্রেসিডেন্টরা জাতীয় নীতিগত বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন। প্রেসিডেন্ট-পরবর্তী অবস্থা সাবেক প্রেসিডেন্টের জন্য একটি দফতর, যার মেয়াদ আজীবন পর্যন্ত নির্ধারিত। সাবেক প্রেসিডেন্টরা এক ধরনের বিকল্প ক্ষমতা চর্চা করেন; কিন্তু নীতিগত বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেন না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের সম্পাদক ক্রিস সিলিজ্জা বলেন, জর্জ ডব্লিউ বুশ তার মেয়াদ শেষ করে টেক্সাসে ফিরে যান এবং সেখানে চিত্রশিল্প নিয়ে সময় কাটিয়েছেন। তিনি তার উত্তরসূরি বারাক ওবামা প্রশাসনের নীতিগত বিষয়ে কখনোই কোনো মন্তব্য করেননি। বিভিন্ন মহল থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা সত্ত্বেও হোয়াইট হাউস থেকে বের হওয়ার পর ওবামা তার উত্তরসূরির কোনো সমালোচনা করতে রাজি হননি। ২০০০ সালে এক বিতর্কিত ভোটের লড়াইয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আল গোর ভোট পুনর্গণনার পর পরাজিত হন। এর পরও তিনি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের অবস্থান অন্যদের থেকে ভিন্ন। তিনি নির্বাচনে জালিয়াতির ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ দ্বিগুণ-তিন গুণ বাড়িয়েছেন, ঐক্যের বদলে বিভক্তির রেখা আরও গাঢ় করেছেন।

ট্রাম্প বরাবরই জো বাইডেন ও অন্য প্রেসিডেন্টদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। নিজেকে অন্যদের থেকে ভিন্ন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি কখনোই পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টদের মতো আচরণ করেননি। ভোটে বাইডেনের জয় কখনোই তিনি স্বীকার করেননি; বরং নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে ট্রাম্প নিজেকে বৈধ প্রেসিডেন্টের মতোই আচরণ করে চলেছেন। করোনা মোকাবেলায় বাইডেন প্রশাসনের উদ্যোগকে তিনি ‘ভয়ঙ্কর’ বলে উল্লেখ করেছেন।

আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার, তালেবানের কাবুল দখল এবং মার্কিন সেনা সদস্যদের নিহত হওয়ার ঘটনায় ট্রাম্প সমালোচনার ক্ষেত্রটি আরও এক কাঠি বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন। ভোটারদের একটি বড় অংশ ট্রাম্পের এসব তীর্যক বক্তব্য সমর্থনও করছেন। আর এর জোরে ট্রাম্প কার্যত এক ছায়া প্রশাসন চালাচ্ছেন। আর ট্রাম্পের এই ‘ছায়া শাসন’ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বিভক্তিকে আরও স্পষ্ট করেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //