স্মৃতিতে শারদীয়া

বর্ষা শেষে শরৎকাল বড়ই আনন্দের। গ্রীষ্মের দাবদাহ, বর্ষার অবিন্যস্ত ধারা বর্ষণ শেষে একটুখানি শীতের আমেজ নিয়ে আসে শরৎকাল। পঞ্চাশের দশকে আমাদের বাল্যকালে গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থার কথা কল্পনাই করা যেত না।

তাই দাবদাহের মুক্তির পর আসা শরতের হালকা শীতে একটা কাঁথায় আশ্রয় নিতে হতো। তখন একটু একটু কুয়াশা পড়া শুরু করত। এই ঋতু পরিবর্তনের একটা আয়েশ শরীরে ছড়িয়ে পড়ত। বর্ষার শেষে পানি টান দেওয়ার পর প্রচুর মাছ ধরা পড়ত। তখন নানা কারণেই নদী, পুকুর, খাল, বিল ও জলাশয়ের পানি দূষিত হয়ে পড়ত। কোনো কোনো বছর তাই মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দিত। গ্রামবাংলায় মহামারি সৃষ্ট শোকে হাহাকার পড়ে যেত। কোনো কোনো গ্রাম মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হতো। শরৎ একটু জেঁকে বসতেই এই শোকাবহ অবস্থা থেকে মানুষের পরিত্রাণ হতো। 

এর মধ্যে বেজে উঠতে শুরু করত ঢাকের শব্দ। সেই শব্দ শোনার পরেই মনে হতো পৃথিবী থেকে জরা আর মৃত্যু সরে গিয়ে আবার জীবনের স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে। কিছুদিন পরেই শুরু হতো ধান কাটার মৌসুম। ধানের গন্ধে নবান্নের উৎসবে মেতে উঠবে বাংলা। দেবী দুর্গা যেন বিষাদ সংহার করে পৃথিবীটাকে আবার নতুন করে দেবে। তখনকার শারদীয় পূজায় মেতে ওঠা যেত নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। প্রতিমার নানা সৌন্দর্যে আকুল হয়ে যেত সবার মন। 

তখনো দেশ ভাগের পর প্রচুর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এদেশে রয়ে গেছে। কলকাতার সঙ্গে অনেকের যোগাযোগ আছে। পূজার সময় কলকাতার অনেকেই গ্রামে আসতেন। থিয়েটারের আয়োজন হতো। তেমনি এক পূজায় গ্রামের হিন্দুপ্রধান এলাকায় কলকাতা থেকে আসা বন্ধুদের অভিনীত ‘কর্ণার্জুন’ নাটকটি দেখেছিলাম। গ্রামের নাটমণ্ডলে আমার বন্ধুদের এ নাটক অভিনীত হতো। বিদ্যুতের ব্যবস্থা গ্রামে তখন কেবল কল্পনারই বিষয়। হ্যাজাক বা পেট্রোম্যাক্সের আলোয় চলতো অভিনয়ের ব্যবস্থা। দু-তিনজন লোক কিছু সময় পর পর পাম্প দিয়ে যেত। তার মধ্যেই অভিনয় চলত। মাইক্রোফোনের ব্যবস্থাও ছিল না। তাই হাজার হাজার দর্শকের পিনপতন নীরবতার মধ্যেই ওই গ্রামের অভিনয়টা নির্বিঘ্নে চালিয়ে নেওয়া হতো। একই সঙ্গে চলত যাত্রাপালা। স্থানীয় যাত্রাদলের প্রায় সবাই সেখানে নাচত। আবার কিছু অভিজাত এবং ধনাঢ্য পরিবারের অর্থায়নে কখনো কখনো বাইরে থেকে দল এসে পালা করে যেত। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চলত শারদীয় যাত্রা। আর সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চলত কবিগান, পালাগান, কনক ঠাকুরের মুখে ‘মহাভারত’-এর গল্প বলা। অল্প কয়েক দিনের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলা আনন্দোৎসবের শেষ হতো প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। তখন এই বিসর্জনের বাজনা যেন হৃদয়ে একটা বেদনার ঝঙ্কার তুলত। পরবর্তী পূজার আশা নিয়ে সবাই ঘরে ফিরে যেত। অবশ্য সামনের লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতী পূজা এবং কালীপূজার আমেজেও উৎসবের রঙ খুঁজে পাওয়া যেত। 

আমার যেখানে কৈশোর কেটেছে সেখানকার স্থানীয় জমিদাররা কালীর উপাসক ছিলেন। কালীপূজা তখন খুব ধুমধাম করে পালন করা হতো। সেই উদযাপনের বয়স ছিল অনেক পুরনো। সেখানে স্থায়ী একটি নাটমণ্ডল ছিল। পূজার সময় কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রাদল আসত। প্রচুর খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা হতো এবং সানাই বাজত। সেই সকালে বলিদানের মধ্য দিয়ে শুরু হতো পূজার কাজ। কখনো পাঁঠার সঙ্গে মহিষও বলি দেয়া হতো। তবে সেই বলির কথা আমরা শুনেছি, কখনো দেখিনি। 

আমাদের সেই কৈশোরে আর তখন জমিদারি প্রথার প্রচলন নেই। কিন্তু তার জন্য পূজার আয়োজনে ঘাটতি থাকত না। আমার কৈশোরের এক দুর্গাপূজার সময়ের একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা কখনোই ভুলতে পারিনি। তখন টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে রণদা প্রসাদ সাহার বাড়িতে ধুমধাম করে পূজা হতো। আমার দুই চাচাতো বোন তখন ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রী ছিলেন। আমার দুই চাচাই তখন থাকতেন মির্জাপুরে। একরকম শখের মোহেই আমি তাদের সঙ্গে পূজা দর্শনে গেলাম। বাবা আমার এই যাত্রায় প্রথমে রাজি ছিলেন না। কেননা সেখানে যেতে হবে নৌকায়। নৌকায় স্থান সংকুলানের বিষয়টি বিবেচনা করে তিনি রাজি ছিলেন না। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা হয়ে বললাম, ‘নৌকার সামনের পাটাতনের উপর শুয়ে হলেও যাব।’ আমার এক কাকীও সঙ্গে যাবেন। তখন কিছুটা তার প্রশ্রয়ে এবং রসিক কাকার দয়ায় অনুমতি মিলল। নৌকা চলতে শুরু করল। এ সময় মেঘের আনাগোনাও হয় বেশ। মেঘের কোলে রোদ হাসে। একটু আধটু বৃষ্টিও হয়। কাকীমার কল্যাণে আমার ছইয়ের ভেতরেই শোবার বসার জায়গা হয়ে গেছে। রসিক কাকা শুধু সুরসিকই নন, ভালো গায়কও বটে। সঙ্গে হারমোনিয়াম নিয়েছিলেন। তিনি একটি গানই ভালো করে গাইতে পারতেন। সেটি ছিল নজরুল গীতি-‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রানী।’

এই গানটি গাইলেই কাকীমা রাগে জ্বলে উঠতেন আর বলতেন, ‘আর কোনো গান জানা নেই যেন।’ কাকা কিন্তু মৃদু হেসে গান গাইতেই থাকতেন। নৌকার খাবার খুবই সুস্বাদু হয়। আর নৌকাযাত্রায় খিদে লাগে প্রচুর, তাই রান্না যা-ই হোক তাই পেট ভরে খাওয়া যায়। সকালে খিচুড়ি দিয়েই শুরু হলো খাওয়া। তারপর পথে পথে বাজার থেকে নানাধরনের তরিতরকারি, ছোট ছোট মাছ, মাঝারি মাছ এবং মুরগি সদাই করা হলো। নৌকার মাঝিরা ভালো রান্না করে। তাদের রান্না গরম ভাতের সঙ্গে গরম ডাল দিয়েই শুধু খাওয়া যায়। এরকমভাবে একসময় মির্জাপুর পৌঁছে গেলাম। মাঝখানে একদিন ও একরাত চলে গেছে। 

ঘাটের কিছুটা দূর থেকেই ঢাকের বাদ্য শোনা যাচ্ছিল। নৌকা গিয়ে ভিড়ল ভারতেশ্বরী হোমসের ঘাটে। গ্রামে থাকা পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানদের আবেগঘন সাক্ষাতে পরিবেশটা সুন্দর হয়ে উঠল। আমরা পূজামণ্ডপের মাঠে পৌঁছে আয়োজন দেখা শুরু করলাম। আগের দিন থেকেই যাত্রাপালা শুরু হয়ে গেছে। ‘ভোলানাথ অপেরা’ এসেছে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া থেকে। সেদিন হবে ‘মোনাই দীঘি’ পালা। বিখ্যাত এই দলের পালা দেখব ভাবতেই শরীরে একটা শিহরণ অনুভব করলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি সব আয়োজন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে সানাই আর ঢোলের সমন্বয়ে বাজনা দেখলাম এরপর। কখনো হরিনাম, উলুধ্বনিতে মণ্ডপ মুখরিত হচ্ছে, আবার ‘দুর্গা মা কি জয়’ ধ্বনি সবকিছুকে ছাপিয়ে তুলছে। দেশ-বিদেশের নানা ধরনের মানুষের আনাগোনায় উৎসব মণ্ডপের চেহেরাটাই পাল্টে যাচ্ছে। 

মির্জাপুরে যাবার পথটাও তখন সহজ ছিল না। কালীগঙ্গা নদী দিয়ে ধলেশ্বরী পার হয়ে মির্জাপুর। এর বাইরে হয়তো খাল-বিল পেরিয়েও কোনো বিকল্প পথ থাকতে পারে। দুপুর পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে কখনো হারিয়েও যেতাম। দুই কাকা খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যেতেন। আবার দুই বোনও খুঁজতে থাকত এবং যখন আমাকে পেত তখন একগুচ্ছ গালাগালি দিয়ে ভরিয়ে দিত। মাথা নিচু করে সেসব সহ্য করতাম। খাবারের সময় উপস্থিত হলো। নৌকায় কাকী অপেক্ষা করছেন। বিলম্বের কারণটা আমি হওয়াতে তিনি আর ভর্ৎসনা করতেন না। এরপর খাবারের আয়োজন শুরু হতো। 

পেট ভরে এমন খাবার খেতাম যে হাত ধোয়ার পরই ঘুমকাতরে আমি নৌকার সামনের অথবা পেছনের পাটাতনে শুয়ে গভীর ঘুমে ডুব দিতাম। ঘুম ভাঙত বিকেলে। বিকেলের খাবার ছিল মুড়ি। শর্ষের তেল, কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে মুড়ি। সন্ধ্যাবেলায় আরতির শব্দ শোনা যেতেই উসখুস করতে শুরু করেছি। নৌকা থেকে চাচারা নামতেন। সঙ্গে আমার প্রতি কঠোর সতর্কবার্তা-আমি যেন সবসময় সঙ্গে সঙ্গে থাকি। কোথাও একা যাওয়া যাবে না। আমি তখন তাতেই রাজি। 

আরতি শেষ হতেই একপ্রহর সময় চলে গেল। গিয়ে দেখলাম, যাত্রার দর্শকেরা প্যান্ডেলে জায়গা করে নিয়ে বসে গেছে। আমরাও শতরঞ্চির একটা ভালো জায়গা দখল করলাম। ওই সময়ে সবারই ক্ষুধা লাগার কথা, কিন্তু কারও কোনো উৎসাহ দেখলাম না। এরপর শুরু হলো কনসার্ট। এই কনসার্টের আওয়াজ রক্তে যেন নাচন ধরিয়ে দেয়। দর্শকদের মধ্যে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি আছেন। এক সময় রণদা প্রসাদ সাহাও এসে বসলেন। তখন পালা শুরু হয়ে গেল, ‘সোনাইদীঘি’। নায়িকার নাম সোনাই। আর ভিলেনের নাম ‘ভাবনা কাজী’। নায়িকা সোনাইকে পাওয়ার জন্য মরিয়া ভাবনা কাজী। সংগীতের আবহে অভিনয় চলছে। প্রম্পটারের উৎকণ্ঠিত কণ্ঠ। সংলাপ আগে থেকেই বলা হয়ে যাচ্ছে, তাতে সাসপেন্স বা নাট্যমুহূর্ত তৈরিতে কোনো বিঘ্ন হচ্ছে না। 

এর মধ্যে মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। অভিনয় এবং সংগীতের শব্দ ছাড়া চারদিক সুনসান। কোনো ধরনের মাইকের ব্যবস্থা নেই। কিন্তু মনোযোগ অখণ্ড। মাঝে মাঝে দর্শকদের বিবেককে জাগ্রত করে দেয় এক সুকণ্ঠের অধিকারী গায়ক, যাকে যাত্রার ভাষায় বলা হয় ‘বিবেক’। প্রতিটি দুষ্কৃতকারী চরিত্রের সঙ্গে সে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এভাবেই যাত্রাপালা একদা গ্রামবাংলার নিরক্ষর মানুষের বিবেককে নাড়া দিত। সু এবং কু বোঝার ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিত। প্রায় শেষ রাতের দিকে পালা শেষ হলো, সোনাই দীঘিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহননের মধ্য দিয়ে পালা শেষ করল। 

বিষণ্ণ মনে নৌকায় ফিরে এলাম। কাকী তখনো নিদ্রাহীন অবস্থায় খাবার আগলে বসে আছেন। খাবার গরম করে পরিবেশন করতে করতে ভোর হয়ে এলো। আমরা খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন আবার পালা হবে-‘ভক্ত রাম প্রসাদ’। সকালে সেই পূজামণ্ডপে ঘোরাঘুরি করে দুপুরে খাবার খেয়ে নিলাম। খাবারের পর নির্দেশ আসলো, ‘চাচারা যেন মেয়েদের সঙ্গে কোথায় যাবেন, সঙ্গে কাকীমাকেও যেতে হবে। আমাকে নৌকায় থাকতে হবে। কিন্তু নৌকা মণ্ডপের ঘাটে থাকবে না, হোমসের ঘাটে ভিড়িয়ে রেখে দেয়া হবে।’ ওরা চলে যেতেই আমি লাফ দিয়ে নৌকা থেকে নেমে যাই। মাঝি ভাইদের আশ্বস্ত করি যে আমি পাড়েই মধ্যেই থাকব। 

সেই সময় একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। দুর্গম পথ দিয়ে আসা একটা জিপ গাড়ি এসে থামে। জিপ গাড়িটি আসার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং স্বয়ং রণদা প্রমাদ সাহা জিপের কাছে চলে আসেন। তাদের হাবেভাবে মনে হলো যে, একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জিপ থেকে নামলেন। ঘাটেই একটা ছোট্ট লঞ্চ বাঁধা ছিল। সিঁড়ি দিয়ে সেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি দুজনের কাঁধে হাতে ভর দিয়ে লঞ্চে গিয়ে উঠলেন। তার সঙ্গে থাকা একজন উঁচু লম্বা সুদর্শন ব্যক্তি লঞ্চে উঠলেন না। আমি তখন ড্রাইভারের কাছে তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই সে ভর্ৎসনা করে উঠল, ‘এই খোকা ওনাকে দেখো নাই। উনি সোহরাওয়ার্দী সাহেব।’ জীবনে কোনো বড় রাজনৈতিক নেতাকে এত কাছ থেকে দেখলাম। উত্তেজনায় তখন আমি কাঁপছি। ড্রাইভার আরও বলল যে, ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সচিব ওমর আলী। পরে এই ওমর আলীর পরিচয় পেতে অনেক সময় লেগেছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের রাজনীতিতে তখন এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। পূর্ব বাংলার মানুষদের জন্য তিনি তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করে চলেছেন। আমার বাবার কাছে দেশবিভাগের গল্প যখন শুনতাম তখন তিনি প্রায়শই এই নামটি উচ্চারণ করতেন। কলকাতার দাঙ্গার সময় তিনি অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি দাঙ্গার সময় বহু মুসলমানকে বাঁচিয়েছিলেন। 

আমার সামনে তখন দাঁড়িয়ে আছেন ওমর আলী। কিন্তু আমার চোখে শুধুই ভাসছে সোহরাওয়ার্দী সাহেব। মনে মনে তখন আফসোস হচ্ছে যে, লঞ্চে যদি উঠতে পারতাম, তাহলে অনেকক্ষণ ধরে তাকে দেখতে পেতাম আর কথা শুনতে পারতাম। একই সঙ্গে মনে মনে ভাবছি যে, চাচারা আসতে আরও বিলম্ব করুক। 

এর মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ওমর আলী আমাকে ছোট ছোট প্রশ্ন করতে শুরু করেন, ‘কোন ক্লাসে পড়ি, বাড়ি কতদূরে, বাবা কী করেন’ ইত্যাদি। তার কথাতে তেমন মনোযোগী হতে পারছিলাম না, কেননা মনোযোগ তখন অন্যখানে। 

ইতিমধ্যে রাত নেমে আসলো। চাচারাও নৌকায় চলে আসলেন। নৌকায় বসে দেখলাম সোহরাওয়ার্দী সাহেব আবারো লঞ্চ থেকে নামলেন। দ্রুত গাড়িতে করে চলে গেলেন। চাচাদের কাছে আমার অভিজ্ঞতা বললাম। কিছুটা বাড়িয়েও। তারাও এ সুযোগ হারালেন বলে আফসোস করতে থাকলেন। তাদের কাছে তখন সোহরাওয়ার্দী দর্শনের বিষয়টি আমার তুলনায় অনেক বড় বিষয় ছিল। 

রাত হয়ে গেছে। আবারও আরতি, দর্শকের সমাগম এবং যাত্রাপালা ‘রামপ্রসাদ’ প্রদর্শন। পরদিন রামপ্রসাদের ভক্তির গান-দে মা আমায় তবিলদারি অনুকরণে মেতে উঠলাম দিনের প্রায় বেশিরভাগ সময়তেই। তৃতীয় রাতে সম্ভবত নবমীর দিন ‘কবরের কান্না’ দেখে বিষণ্ণচিত্তে নৌকায় করে গ্রামে ফিরলাম। সামনে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে, এবার তার প্রস্তুতি নিতে হবে। 

আজ থেকে প্রায় ৬৮ বছর আগের সেই স্মৃতি এখনো বিস্মৃত হইনি। এরপর বহু সময় মির্জাপুরে গিয়েছি। এখন হয়তো সেখানকার জৌলুস বেড়েছে, কিন্তু সেই জীবন্ত গ্রামীণ সংস্কৃতি আর নেই। অনেক পূজাতে অঢেল অর্থও ব্যয় করা হচ্ছে। আনন্দ আর উৎসবে নিত্যনতুন পোশাকের সমারোহও বাড়ছে। কিন্তু এই উৎসবে যেন জনজীবনের গভীরের সেই হৃদস্পন্দন আর যেন খুঁজে পাই না। হয়তো কোথাও অর্থই একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনে ঋতুর সেই রোমান্টিক শিহরণও উধাও হতে বসেছে। 

ঢোল-কাঁসর-শাঁখের শব্দ আজও পাওয়া যায়। কিন্তু শারদ প্রাতের রাতটা এখন আর শিশিরে টপটপ ভিজে ওঠে না । অথবা শিশিরের শব্দের মতো সন্ধে নামার মুহূর্তটিও বড় একটা দেখা যায় না। তবু শারদীয়া পূজা বাঙালির জীবনে একটা অন্যতম উৎসব। এই উৎসবের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র সকল বাঙালিকে আগের মতো ঐক্যবদ্ধ রাখুক।

লেখক : নাট্যব্যক্তিত্ব

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //