কারোনাকালে বিশ্বসেরা প্রযুক্তিবিদদের বাণিজ্য আরো রমরমা

২০১৯ সালের শেষ নাগাদ চীনের হুবেই প্রদেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর ক্রমান্বয়ে বিশ্বব্যাপী তা আতঙ্কজনকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং অতিমারির রূপ ধারণ করেছে। এই অতিমারির সংক্রমণ কবে নাগাদ প্রশমিত হবে, বা আদৌ হবে কিনা তার কোনো কূল-কিনারা নেই। কভিড-১৯ বিশ্ববাসীর সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে, ব্যসবা-বাণিজ্যে ধ্বস নেমেছে।  বছরের প্রথম তিন মাসে বিশ্বব্যাপী ৬.৫ ট্রিলিয়ন ডলার পারিবারিক সম্পদ অদৃশ্য হয়ে গেছে বলে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম জানিয়েছে।

এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ধাক্কা বলে উল্লেখ করেছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান জেরোম এইচ পাওয়েল। সম্প্রতি তিনি জানান মহামারি শুরুর আগে বিগত ৫০ বছরের মধ্যে মার্কিনীদের বেকারত্বের হার সর্বনিম্ন স্তরে চলে এসেছিল, কিন্তু মাত্র গত দুই মাসে ৯০ বছরের  কাছাকাছি সময়ের মধ্যে তাদের বেকারত্বের হার এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে এসেছে। অন্যদিকে, আমেরিকানস্ ফর ট্যাক্স ফেয়ারনেস (এটিএফ) এবং ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ (আইপিএস)-এর নতুন এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে যে, ব্যাপকভাবে মহামারি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত চার কোটি পঞ্চান্ন লকক্ষাধিক আমেরিকাবাসী বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক অধোগতির কারণে সরকারের নিকট দরখাস্ত করেছেন। মার্কিন শ্রম বিভাগও এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। 

অন্যদিকে, ১৮ মার্চ থেকে ১৭ জুন, ২০২০, এই তিন মাস সময়কালে প্রায় ২১ লক্ষ আমেরিকান করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং তাদের মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ আঠার হাজার মারা গিয়েছেন। মহামারিতে অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৭ লক্ষ আমেরিকান রয়েছেন যারা তাদের নিয়োগকর্তা দ্বারা সরবরাহকৃত স্বাস্থ্যসেবা কভারেজ হারাতে পারেন। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রে স্বল্প বেতনের শ্রমিক, অভিবাসী, কালোবর্ণের মানুষ এবং মহিলারা সম্মিলিত চিকিত্সা ও অর্থনৈতিক সংকটে অস্বচ্ছলতার শিকার হয়েছেন। 

সার্বিক অর্থনীতিতে নিম্নগতি এবং করোনাভাইরাস জনিত স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনায় অপ্রতুলতা সত্তেও মহামারী শুরুর পর জুন মাসের ১৭ তারিখ পর্যন্ত মার্কিন ধনকুবেরদের সম্পদের পরিমাণ ৫৮৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। শীর্ষস্থানীয় বিজনেস ম্যগাজিন ফোর্বস্ সূত্রে প্রাপ্ত উপাত্ত নিয়ে এটিএফ এবং আইপিএস কর্তৃক গবেষণার ভিত্তিতে নিচের সরণিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়নেয়ারদের গত তিন মাসের ব্যবধানে সম্পদের হিসাব তুলে ধরা হলো: 

নাম সম্পদের পরিমাণ (বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ৩ মাসে শতকরা বৃদ্ধির হার কোম্পানী

মার্চ ১৮, ২০২০ জুন ১৭, ২০২০ ৩ মাসে মোট বৃদ্ধি

জেফ বেজোস ১১৩.০ ১৫৬.৮ ৪৩.৮ ৩৮.৭% অ্যামাজন

বিল গেটস ৯৮.০ ১০৯.৫ ১১.৫ ১১.৭% মাইক্রোসফ্ট

মার্ক জুকারবার্গ ৫৪.৭% ৮৬.৮ ৩২.১ ৫৮.৬% ফেসবুক

ওয়ারেন বাফেট ৬৭.৫ ৭১.৯ ৪.৪ ৬.৬% বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে

ল্যারি এলিসন ৫৯.০ ৬৯.০ ১০.০ ১৭.০% ওরাকল

মোট ৩৯২.২ ৪৯৩.৯ ১০১.৭ ২৫.৯%

অন্যান্য ২,৫৫৫.৩ ৩,০৩৭.৫ ৪৮২.২ ১৮.৯%

সর্বমোট ২,৯৪৭.৫ ৩,৫৩১.৪ ৫৮৩.৯ ১৯.৮%


উপরোল্লিখিত শীর্ষ পাঁচ মার্কিন বিলিয়নেয়ার- জেফ বেজোস, বিল গেটস, মার্ক জুকারবার্গ, ওয়ারেন বাফেট এবং ল্যারি এলিসনের মোট সম্পদ বেড়েছে ১০১.৭ বিলিয়ন ডলার বা ২৬ শতাংশ। গত তিন মাসে ছয় শতাধিক বিলিয়নেয়ারের যে পরিমাণ সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে, তার মধ্যে এই পাঁচজনের দখলেই গেছে ১৭.৪ শতাংশ। তাদের মধ্যে আবার কেবলমাত্র বেজোস ও জুকারবার্গ নিয়েছেন ৭৬ বিলিয়ন ডলার বা ৫৮৪ বিলিয়ন ডলারের ১৩ শতাংশ। 

উপরোক্ত শীর্ষ পাঁচ সম্পদশালীর বাইরে আরো ১২ জন বিলিয়নেয়ারের সম্পদের পরিমাণ গত তিন মাসে দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের মধ্যে আবার দুইজনের সম্পদ বেড়েছে ৫ গুণেরও বেশি।

মার্কিন ধনকুবেরদের সম্পদের এই বেলেল্লাপনাই তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি মৌলিকভাবে কতটা ত্রুটিযুক্ত তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তিন মাসে প্রায় ৬০০ বিলিয়নেয়ার তাদের সম্পদ যে-পরিমাণ বাড়িয়েছেন, তা দেশটির গভর্নরদের রাজ্যগুলিতে ৩৩ কোটি বাসিন্দাকে সেবা সরবরাহ করতে যে পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন সংস্থার প্রয়োজন হয় তার চেয়ে ঢের বেশি। বিলিয়নেয়াদের সম্পদ দ্বিগুণ বেড়েছে এমন এক সময়ে যখন ফেডারাল সরকার ১৫ লক্ষেরও বেশি আমেরিকাবাসীকে এককালীন চেক তাদের ব্যাংক হিসাবে প্রদান করেছে।

করোনাভাইরাস মহামারি যদি কোনো কিছু নগ্নভাবে উন্মোচন করে, তা হচ্ছে মার্কিন সমাজ কতটা অসম এবং আবশ্যই কতটা মারাত্মকভাবে এর পরিবর্তন হওয়া দরকার। মহামারিকালে বিলিয়নেয়ারদের সম্পদ বৃদ্ধি আমেরিকানদের জাতিগত ঐক্য ও সংহতিকে ক্ষুণ্ন করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাই মার্কিন সমাজে শেষতক অনেক বেশি করে অর্থনৈতিক ও জাতিগত মেরুকরণ প্রয়োজন। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে দূরত্ব না বাড়িয়ে মার্কিন জনগণকে সামষ্টিকভাবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে একসাথে বেড়ে উঠতে হবে।

ধনীদের জন্য বিগত কয়েক দশক যাবত কর রেয়াতের কারণে এমনিতেই বিলিয়নেয়ারদের সম্পদ হুহু করে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় জাতীয় জরুরি অবস্থার মধ্যেও বিত্তবানদের কর রেয়াত অব্যাহত থেকেছে এবং অতি সম্প্রতি "মিলিয়নেয়ার গিভয়্যাওয়েস" প্যাকেজ আরো বর্ধিত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এ বছর মার্চের শেষের দিকে “করোনা এইড, রিলিফ অ্যান্ড ইকোনোমিক সিকিউরিটি অ্যাক্ট” শিরোনামে প্রণীত একটি আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। 

যদিও যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট কমিটি অন ট্যাক্সেশন’র মতে, সম্প্রতি প্রণীত “হাউস হিরোস অ্যাক্ট” এই কর বিরতি রদ করবে, যা এ বছর ৪৩ হাজার মিলিনেয়ার ও বিলিনেয়ারের গড়ে ১.৬ মিলিয়ন ডলার কর ছাড় দিবে। এই কমিটি অনুমান করছে যে কর বিষয়ের ছিদ্রপথটি বন্ধ করা গেলে ২৪৬ বিলিয়ন ডলার সংগৃহীত হবে এবং এই বিপুল অংকের অর্থ মহামারি থেকে মুক্তি পাওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু এই তত্ত্ব কেবলই অনুমাননির্ভর। 

তবে সবকিছু ছাড়িয়ে গবেষণায় বিশেষভাবে একটি ব্যাপার উঠে এসেছে যে, বর্তমান শীর্ষ পাঁচ মার্কিন বিলিয়নেয়ার- জেফ বেজোস, বিল গেটস, মার্ক জুকারবার্গ, ওয়ারেন বাফেট এবং ল্যারি এলিসনের মধ্যে একমাত্র ওয়ারেন বাফেট ছাড়া অন্য সবাই তথ্যপ্রযুক্তি ও ই-কমার্স ব্যবসার সাথে জড়িত। তাদের বাইরে ৩০ শীর্ষ বিলিয়নেয়ারের মধ্যে আরো বেশ কয়েকজন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ রয়েছেন, যাদের ব্যবসায়ও করোনাকালে চড়াভাব। তাই করোনাভাইরাস মহামারিকালে অন্যদের ব্যবসা-বাণিজ্যে ধ্বস নামলেও শীর্ষ প্রযুক্তিবিদদের বাণিজ্য অতীতের চেয়েও রমরমা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারোনা অতিমারীতে দুই বিপরীতমুখী অর্থনীতি’র প্রেক্ষিতে বাংলা প্রবাদ বাক্য ‘কারো ঘর পোড়ে, কেউ খই খায়’ আরো স্বতঃসিদ্ধ হলো।-বিজ্ঞপ্তি 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //