ফেসবুক নিয়ে নতুন পদক্ষেপ নিতে পারেন জাকারবার্গ

উনিশ শতকে ক্রীতদাস প্রথা বিলোপের দাবিতে ব্রিটেনে যখন আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তখন আন্দোলনকারিরা ব্রিটিশ জনগণকে উৎসাহিত করেছিল ক্রীতদাসদের দিয়ে উৎপাদিত পণ্য না কিনতে। এই কৌশল কাজ করেছিল। তখন প্রায় তিন লক্ষ মানুষ চিনি কেনা বন্ধ করে দিয়েছিল এবং এর ফলে দাস প্রথা বিলোপের দাবিতে একটা বিরাট চাপ তৈরি হয়েছিল।

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী একটি সংগঠন ‘দ্য স্টপ হেইট ফর প্রফিট‌’ এখন বয়কটকে তাদের আন্দোলনে এক বড় রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। আন্দোলনকারিরা দাবি করছে, ফেসবুক তাদের প্লাটফর্মে বর্ণবাদী এবং ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ জিনিস বন্ধ করতে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

আন্দোলনকারিরা বেশ কিছু বড় বড় কোম্পানিকে ফেসবুক এবং এধরনের অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করতে রাজি করাতে পেরেছেন। আর বয়কট খুব কার্যকর একটি কৌশল। ফেসবুক এখন এটা বেশ ভালোভাবে টের পাচ্ছে। এসব কোম্পানির মধ্যে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ফোর্ড, অ্যাডিডাস এবং এইচপি। এর আগে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল কোকা-কোলা, ইউনিলিভার এবং স্টারবাকস।

নিউজ ওয়েবসাইট এক্সিওনের এক খবরে বলা হচ্ছে, মাইক্রোসফট্ গত মে মাস থেকে ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামে বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করেছে। কারণ এই দুটি প্লাটফর্মে যে ধরনের আপত্তিকর কনটেন্ট প্রকাশ পাচ্ছে সেটা নিয়ে তাদের উদ্বেগ আছে।

এদিকে রেডিটের মতো অন্যান্য অনলাইন প্লাটফর্মও ঘৃণা এবং বিদ্বেষপূর্ণ কন্টেন্টের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে। এটি ফেসবুকের ওপর আরও চাপ তৈরি করছে।

এই বয়কট কি ফেসবুকের ক্ষতি করতে পারে? সহজ এবং সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে ‘হ্যাঁ’। কারণ ফেসবুকের মোট আয়ের একটা বিরাট অংশ বিজ্ঞাপন থেকে আসে। এভাইভা ইনভেস্টরস এর ডেভিড কামিং বলেন, ফেসবুকের ব্যাপারে এই যে একটা আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে এবং তাদের কোনো নৈতিক অবস্থান নেই বলে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে সেটা তাদের ব্যবসার ক্ষতি করতে পারে।

গত শুক্রবার ফেসবুকের শেয়ারের দাম পড়ে গেছে প্রায় ৮%। এর ফলে ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী এবং মার্ক জাকারবার্গের সম্পদ অন্তত কাগজে-কলমে ৬ বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ড কমে গেছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি আরো বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে কিনা কিংবা ফেসবুকের অস্তিত্বের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে কিনা সেটা এখনো স্পষ্ট নয়।

কোন সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে এটাই প্রথম বয়কটের ডাক নয়। দুহাজার সতের সালে বড় বড় অনেক ব্র্যান্ড এবং কোম্পানি ঘোষণা করেছিল যে তারা ইউটিউবে বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করবে। কারণ এই বিজ্ঞাপনগুলো বর্ণবাদী এবং সমকামী বিদ্বেষী ভিডিওর পাশে দেখানো হচ্ছিল।

সেই বয়কটের ঘটনা হয়তো এখন অনেকেই ভুলে গেছেন। ইউটিউব এরপর তার বিজ্ঞাপন নীতিমালা অনেক পরিবর্তন করেছে। তিন বছর পর ইউটিবের মূল কোম্পানি গুগল এখন বেশ বেশ ভালই ব্যবসা করছে।ফেসবুকের বেলাতেও বয়কট যে সেরকম বড় কোন ক্ষতির কারণ হবে না সেটা বিশ্বাস করার অন্য অনেক কারণ আছে।

প্রথমত অনেক কোম্পানি মাত্র এক মাসের জন্য ফেসবুক বয়কটের ঘোষণা দিয়েছেন। দ্বিতীয়তঃ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, তা হলো, ফেসবুকের বিজ্ঞাপন রাজস্বের বেশিরভাগটাই কিন্তু আসে হাজার হাজার ছোট বা মাঝারি আকারের ব্যবসা থেকে। 

সিএনএনের এক রিপোর্টে বলা হচ্ছে , সবচেয়ে বড় ১০০ টি ব্র্যান্ড, যারা বিজ্ঞাপনের পেছনে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে, তাদের কাছ থেকে ফেসবুকের আয় ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ফেসবুকের মোট আয়ের মাত্র ৬ শতাংশ। 

বেশিরভাগ মাঝারি কোম্পানি এখনো পর্যন্ত ফেসবুক বয়কটের ডাকে সাড়া দেয়নি। একটি বিজ্ঞাপনি সংস্থা ডিজিটাল হুইস্কির হেড অফ স্ট্রাটেজি ম্যাথ মরিসন বলেন, অনেক মাঝারি আকারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে যারা আসলে ফেসবুক বিজ্ঞাপন না দেয়ার কথা ভাবতেই পারে না। এই মাঝারি বা ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় বড় টেলিভিশন নেটওয়ার্কে বিজ্ঞাপন দেয়ার সাধ্য নেই। তারা ফেসবুকের মত প্লাটফর্মে অনেক কম খরচে বিজ্ঞাপন দিতে পারে। একমাত্র ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মে এরকম টার্গেটেড বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই এইসব ব্যবসা আসলে টিকে থাকে।

তবে কোন আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জনে লবি করার জন্য ফেসবুক একটি ভালো টার্গেট। ফেসবুকের যে কাঠামো, সেখানে মার্ক জাকারবার্গের একটা বিরাট ক্ষমতা আছে। তিনি যদি চান, একটা বড় পরিবর্তন তিনি নিয়ে আসতে পারেন। কাজেই একজন মার্ক জাকারবার্গকে প্রভাবিত করতে পারলেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।

ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে জাকারবার্গ হয়তো নতুন পদক্ষেপ নিতে পারেন। শুক্রবার ফেসবুক ঘোষণা করেছে যে তারা ঘৃণা এবং বিদ্বেষপূর্ণ যেসব কনটেন্ট সেগুলো ট্যাগ করা শুরু করবে। এ বিষয়ে সামনে আরো ঘোষণা আসতে পারে।

তবে ‘দ্য স্টপ হেইট ফর প্রফিট’ আন্দোলনকারিরা এসব ঘোষণায় যে সন্তুষ্ট হবেন সেটা মনে হচ্ছে না। চলতি বছরটি সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর জন্য খুবই ঝামেলাপূর্ণ একটি বছর হয়ে দাঁড়াতে পারে। ফেসবুক এখানে কোন ব্যতিক্রম নয়। তবে কোম্পানিগুলো সবসময় তাদের ব্যবসার ব্যালেন্স শিট দেখেই সিদ্ধান্ত নেবে।

যদি এই বয়কট শরৎকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে এবং আরো অনেক কোম্পানি এই বয়কটে যোগ দেয় তাহলে সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্ক ফেসবুকের জন্য এবছরটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর হয়ে উঠতে পারে।-বিবিসি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //