দিনমজুর

এই রিকশা, মাইলের মাথা যাবি?

-না, আমার ভাড়া আছে।

কই? কাউকে তো দেখছি না। চল আমাদের মাইলের মাথায় নামিয়ে দিয়ে আসিস।

-না, আমি এখন সেদিকে যাব না। আপনি অন্য কোনো রিকশায় যান।

ভাড়া বাড়িয়ে দেব। তবু চল।

-দেখুন, বাসা থেকে  কল এসেছে, আমার মায়ের খুব অসুখ। আমাকে এখনই বাসায় যেতে হবে।

রিকশা নিয়ে বের হয়েছিস। আবার বলছিস যাবি না। এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দেব। রিকশা ঘুরিয়ে নে। আগে আমাদের মাইলের মাথায় দিয়ে আস।

-স্যার, আপনি রাগছেন কেন? আমার সমস্যা আছে বলেই তো সেদিকে যাচ্ছি না।

আবার মুখে মুখে তর্ক করছিস। বেয়াদব কোথাকার- এ কথা বলে রিকশাওয়ালাকে মারতে উদ্যত হয় বিপ্লব সাহেব। রিকশাওয়ালা বিপ্লব সাহেব মুখের দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বিপ্লব সাহেবের ছেলে সম্রাট বাবার হাত ধরে টানতে টানতে রিকশা থেকে একটু দূরে সরে আসে।

বিপ্লব সাহেব রাজনীতি করেন। তার দল সরকারে আছে। এলাকার মানুষের কাছে তার পরিচয় একজন প্রভাবশালী রাগী মানুষ হিসেবে। কারও সাথে একটু উনিশ-বিশ হলেই তিনি রেগে গিয়ে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সবাই তাকে ভয় পায়। সম্রাট বিপ্লব সাহেবের একমাত্র ছেলে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। খুব মেধাবী ছাত্র। সে রাজনীতি বোঝে না। বোঝে না মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য। রিকশাওয়ালার ওপর বাবাকে অন্যায়ভাবে রাগতে দেখে খুব মন খারাপ হয় তার। বাবার হাত ধরে একপাশে নিয়ে এলে আরেকজন রিকশাওয়ালা কাছে এসে বললেন, স্যার, আপনারা আমার রিকশায় আসেন। যেখানে যেতে চান আমি নিয়ে যাব। সত্যিই ওর মায়ের খুব অসুখ। যেকোনো সময়..! অভাবের সংসারে মাভক্ত ছেলেটা দিন-রাত খাটুনি করে রিকশা চালায়। আমার বাসার পাশেই ওরা থাকে।

বিপ্লব সাহেব সম্রাটকে সাথে নিয়ে রিকশায় উঠলেন। রিকশা তাদের গন্তব্যে ছুটছে। সম্রাট রিকশাওয়ালার দিকে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থাকে। রিকশাওয়ালা অনবরত ঘামছে। বাম হাতে গলার গামছা দিয়ে বারবার ঘাম মুছছে। দেখে মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত। তবু অবিরাম রিকশার হ্যান্ডেলে পা দুটো চালিয়ে যাচ্ছে। সামান্য কটা টাকার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। কোনোমতে খেয়েপরে বাঁচতেই এত কষ্ট সহ্য করা। এদের সারা দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে উপার্জিত টাকার সমপরিমাণ টাকা কিংবা তারও বেশি সম্রাটদের মতো ধনীর ছেলেমেয়েরা রোজ অপচয় করে।

সম্রাট আবেগী হয়ে রিকশাওয়ালাকে দেখিয়ে আস্তে করে বাবাকে বলল, দেখো বাবা, লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত। তবু রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা কত আরাম করে রিকশায় বসে আছি! ওরাও তো মানুষ! শুধু বেঁচে থাকতে ওরা নিত্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। ওদের ন্যায্য পাওনাও কখনও কখনও ঠিকমতো ভাগ্যে জোটে না। কি ঠিক না বাবা?

এতক্ষণ ছেলের বলা কথামালা গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনলেন বিপ্লব সাহেব। এ বয়সেই সম্রাটের এমন মানবিক উপলব্ধিতে বাবার মন প্রশান্তিতে ভরে যায়। ছেলের দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, মানুষের প্রতি তোমার যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তুমি যা যা বলেছ সব সত্য। শ্রমিকের ঘাম ঝরানো শ্রমেই গড়ে উঠেছে আমাদের আজকের সভ্যতা। তাদের শ্রমেই আমাদের সুন্দর-আরামে পথচলা। অথচ সেই তারাই আবার নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছে।

-কিন্তু কেন?

আমার মনে হয়, এর পেছনের অনেকগুলো কারণের মধ্যে ওদের অসহায়ত্ব আর ধনী সম্প্রদায়ের শোষণ মনোবৃত্তিই মূল দায়ী।

-তার মানে তুমি বলতে চাইছ, এখানে মানবিকতাই মূল।

হ্যাঁ, তুমি একদম ঠিক ধরেছ। আমরা সবাই যত বেশি মানবিক হব, তত বেশিই ধনী-গরিবের বৈষম্য কমবে। সমাজে শান্তি আসবে।

-বাবা, তোমাকে একটা কথা বলতে আমার খুব খারাপ লাগছে। সেই রিকশাওয়ালার সাথে তোমার উত্তেজিত হওয়াটা মনে হয় ঠিক হয়নি? লোকটা মনে খুব কষ্ট পেয়েছে!

বিপ্লব সাহেব একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, তুমি ঠিক বলেছ। এখন আমার কাছেও তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু তুমি জানো না, এ রকম অনেক রিকশাওয়ালাকে আমি দেখেছি, যারা অকারণে বসে থাকবে। যাত্রীর জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে আমলে নেবে না। এমনও দেখেছি, ঘরে চাল নেই, বৌ-বাচ্চা না খেয়ে আছে, অথচ ওদের মধ্যে কেউ কেউ নেশা করে, জুয়া খেলে সময় পার করছে। ইচ্ছে করলেই যেতে পারে। একটু ভালো থাকার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু ওরা তা করে না। তাই মাথাটা গরম হয়ে গেল।

-তোমার সব কথা মানছি। কিন্তু সেই রিকশাওয়ালা তো খারাপ ছিল না।

বিপ্লব সাহেব মাথা নাড়তে নাড়তে সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, ও ভালো লোক ছিল।

-আমার একটা কথা রাখবে?

কী কথা?

-আমরা তো এখন বাসায় গিয়ে ঘুমাব। কিন্তু লোকটার তো ঘুম হবে না। সারা রাত অসুস্থ মায়ের পাশে নির্ঘুম কাটিয়ে দেবে হয়তো। আর তোমার সাথে ঘটে যাওয়া বিষয় ওকে আরও পীড়া দিতে পারে।

বিপ্লব সাহেব একটু ভেবে নিয়ে বললেন, তুমি কী বলতে চাইছ?

-আমি চাইছি, এখন বাসায় না গিয়ে আমরা লোকটার বাসার দিকে যাব। তাহলে কাছে থেকে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ হবে। ওর অসুস্থ মাকেও দেখে আসা হবে। আর আমরাও শান্তিতে ঘুমাতে পারব, তাই না বাবা?

সম্রাটকে বুকে জড়িয়ে ধরে গর্বে বলতে লাগলেন, বাংলার ঘরে ঘরে তোমার মতো সন্তান হলে সোনার দেশ হতে বেশি দিন লাগবে না।

এরপর রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ করে বললেন, রিকশাটা উল্টা ঘুরিয়ে নিন। আপনার ভাড়া নিয়ে কোনো টেনশন করতে হবে না। ভাড়া বাড়িয়ে দেব। আমরা সেই রিকশাওয়ালার বাসায় যাব। রিকশাওয়ালা খুশি হয়ে আবার উল্টো দিকে রিকশা চালাতে লাগল। রাত সাড়ে ১২টা। রিকশা থেকে নেমে রিকশাওয়ালার পিছু পিছু সর্দার বস্তিতে প্রবেশ করলেন বিপ্লব সাহেব ও তার ছেলে। চারদিকের দুর্গন্ধে নাক চেপে অনেক কষ্টে গন্তব্যে পৌঁছেন তারা। সেই রিকশাওয়ালা এত রাতে মায়ের শিয়রে বসে মায়ের মাথায় পানি ঢালছে। ফোলা ফোলা চোখ দুটো অশ্রুতে সিক্ত। মায়ের চোখ দুটো বন্ধ। সটান লম্বা হয়ে আধমরা শুয়ে আছেন। হাড্ডিসার দেহ। লোকটা মাথায় পানি ঢালছে আর ‘মা! মা!’ বলে কাঁদছে।

বিপ্লব সাহেব সামনে এসে দাঁড়ালেন। চোখ তুলে তাকাতেই বিপ্লব সাহেবকে দেখে অবাক হয় সে। তারপর বলল, এত রাতে আপনি এখানে!

আমার বিবেক আমাকে এখানে এনেছে। ভাই, তোমার সাথে সে সময় আমার উত্তেজিত হওয়াটা ঠিক ছিল না। আমি ভেবেছিলাম, কিছু লোক আছে, যারা কষ্টে থেকেও কাজ করতে চায় না। বাড়িতে মা-বাবা কিংবা বৌ-বাচ্চা ঠিকমতো খাবার পায় না। অথচ ওরা হয় অলস বসে থাকবে, নয়তো জুয়া খেলে কিংবা নেশার ছলে সময় কাটিয়ে দেবে। তুমিও হয়তো তা-ই।

-আপনি ঠিক কথা বলেছেন। আমার সাথের এমন স্বভাবের অনেককে আমি দেখেছি। আমার ঘনিষ্ঠ অনেককে বুঝিয়েছিও। কেউ কেউ মেনেছে। কেউ আবার বিরক্তও হয়েছে।

আপনাকে আমি ভুল বুঝে বড় অন্যায় করেছি। আমায় ক্ষমা করুন, প্লিজ!

এ কথা বলে বিপ্লব সাহেব লোকটাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। এমন দৃশ্যে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সম্রাট ও অন্য রিকশাওয়ালার মন খুশিতে ভরে যায়। এমন অপ্রত্যাশিত আচরণে অসুস্থ মায়ের বন্ধ চোখও খুলে যায়। তিনি অপলক চোখে বিপ্লব সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //