স্যানিটারি প্যাডের উচ্চমূল্য

ব্যবহার করতে পারছেন না দরিদ্ররা

শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার অংশ ঋতুস্রাবের জন্য ব্যবহৃত স্যানিটারি প্যাডের উচ্চমূল্যের কারণে এর ব্যবহার বাড়ছে না। বিশেষত কম আয়ের পরিবারে মেয়েরা তাদের প্রয়োজনে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে পারেন না বলে নানা ধরনের জীবাণু সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন। নিয়মিত কাজ করতে না পারায় কর্মজীবী মেয়েদের আয়ও কমে যায়। 

স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার না করে অনেকে পুরনো কাপড়, তুলার মতো কিছু ব্যবহার করায় নিজেদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছেন। দরিদ্র নারীদের মধ্যে পুরনো কাপড় ধুয়ে ব্যবহারের প্রবণতা বেশি, যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। স্যানিটারি প্যাডের দাম কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে এলে সবাই তা ব্যবহার করতে পারতো বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন। সম্প্রতি ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন জরিপে দেখা গেছে, স্যানিটারি ন্যাপকিনের উচ্চমূল্যের কারণে ৮৬ শতাংশ নারীই ঋতুকালীন তা ব্যবহার করতে পারছেন না। মাত্র ১০ শতাংশ নারী স্বাস্থ্যকর স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে পারছেন। 

বিশিষ্ট অবস্ট্রেটিক অ্যান্ড গাইনিকোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. সালেহা বেগম চৌধুরী বলেন, ‘ঋতুকালীন স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার না করলে সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যায়। পুরনো, ময়লা কাপড় ব্যবহার করলে মাসিকের রাস্তায় অথবা জরায়ুতে ইনফেকশনের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে করে ভবিষ্যতে গর্ভধারণের জটিলতাসহ মারণব্যাধি ক্যান্সারও হতে পারে। একটি সুস্থ জাতির জন্য নারীদের অবশ্যই সুস্থ থাকতে হবে।’ 

অধ্যাপক সালেহা বেগম চৌধুরী বলেন, “স্যানিটারি ন্যাপকিন একটি অত্যাবশ্যক পণ্য। এটা বিলাসী পণ্যের মধ্যে ফেলা উচিত নয়। সরকার যেমন ‘অত্যাবশ্যক’ ঘোষণা করে কিছু ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে, ওষুধ উৎদানকারীরা সরকারের অনুমতি ছাড়া এসব ওষুধের দাম বাড়াতে পারে না। তেমনি স্যানিটারি ন্যাপকিনকে ‘অত্যাবশ্যক পণ্য’ ঘোষণা করে এর দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হোক। এই পণ্য একই দামে দেশের সর্বত্র বিক্রি হবে এবং তা হতে হবে সব শ্রেণির নারীর ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে।” স্যানিটারি প্যাড তৈরির সব সামগ্রীই বংলাদেশে উৎপাদনের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

চিকিৎসকরা বলেন, পুরনো, নোংরা কাপড় ব্যবহার করা হলে লোকাল ইনফেকশন হতে পারে। যৌনাঙ্গে ফাঙ্গাস বা ছত্রাকের আক্রমণ হতে পারে। ফাঙ্গাসজনিত ইনফেকশন দূর করতে না পারলে, অথবা এটি ক্রনিক আকার ধারণ করলে তলপেটে ব্যথা, বমি হওয়া অথবা ভ্যাজাইনেটিস হতে পারে। প্রথম দিকে চিকিৎসা না করালে, পরে এটা সারানো সহজ হয় না।

হাইজিন বেসলাইনের জরিপে বলা হয়, দেশের ৪০ শতাংশ মেয়ের ঋতুস্্রাব হলে তারা তিন দিন স্কুলে যায় না। এই ৪০ শতাংশের এক-তৃতীয়াংশ জানিয়েছে, ঋতুকালীন স্কুলে অনুপস্থিতির কারণে তাদের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেসলাইনের তথ্যমতে, কেবল ৬ শতাংশ মেয়ে ঋতুকালীন সমস্যা ও প্রতিকারের বিষয়গুলো স্কুল থেকে জানতে পারে। 

এদিকে মিডিয়ায় খুব আকর্ষণীয় করে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হলেও প্যাড উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো এর দাম কমাচ্ছে না। এক পিস প্যাডের দাম কোথাও ৮ টাকার নিচে নয়। আফরিন আরা রাজধানী ঢাকার একজন গৃহবধূ, এ প্রতিবেদককে জানানÑ ‘আমার বয়স এখন ৩২। ১৭ বছর থেকে স্যানিটারি প্যাডের ব্যবহার শুরু করি। আমি গ্রামে বড় হয়েছি। আমার বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না বলে আমি অথবা আমার মা এসবের চিন্তাও করতে পারতাম না। বিয়ের আগে আমি পুরনো কাপড় ধুয়ে ব্যবহার করতাম। তখন কিছু শারীরিক সমস্যায়ও ভুগেছি। তখন বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারছি যে, স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার না করায় এটা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০০৬ সালে আমি ১৫ পিস স্যানিটারি প্যাডের একটি প্যাকেট ৬৫ টাকায় কিনতে পারতাম। এখন এটা কিনতে হয় ১২০ টাকায়। এই ক’বছরে এর দাম দ্বিগুণ হয়েছে। আমাদের ইনকাম কিন্তু সে তুলনায় বাড়েনি। সংসারে আমি ও আমার মেয়ের প্রতি মাসেই স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে দুশো টাকার উপরে চলে যাচ্ছে। আমার ১২ বছরের মেয়ের জন্য এ সময় বিশেষ কেয়ার প্রয়োজন হয়। এখানে সরকার ভর্তুকি দিতে পারে। সরকার যদি আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সহায়তা না করে তাহলে শুধু স্যানিটারি প্যাড কেন, ওষুধ কেনা বা চিকিৎসাও নাগালের মধ্যে আসবে না।’

বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, দেশীয় কোম্পানির স্যানিটারি ন্যাপকিনের একটি মাত্র প্যাডের দাম ৮ থেকে ১৪ টাকার মধ্যে। যেমন ১৬ পিসের স্যানোরা কনফিডেন্স ১৫০ টাকা, ৮ পিসের স্যানোরা কনফিডেন্স আল্ট্রার দাম ১১০ টাকা, ১০ পিসের স্যানোরা কনফিডেন্স সুপার ১১০ টাকা, ১০ পিসের স্যানোরা কনফিডেন্স রেগুলার ১১৫ টাকা। এসিআই লিমিটেডের ১০ পিনের স্যাভলন ফ্রিডম কম্বোপ্যাক ১১০ টাকা, একই কোম্পানির ৮ পিসের হ্যাভির দাম ১১০ টাকা, ১৬ পিস হ্যাভির দাম ২০০ টাকা, ১০ পিসের ফ্রিডম রেগুলারের দাম ১১০ টাকা এবং ফ্রিডম রেগুলার ২০ পিসেরটির দাম ২০০ টাকা। এসএমসির ৮ পিসের জয়ার দাম ১০০ টাকা, ৮ পিসের সানিডের দাম ১৩০ টাকা, ৮ পিসের হুইসপারের দাম ১৩৩ টাকা, ৮ পিসের সোফির দাম ৭৬ টাকা, একই রকম স্টেসেফের দাম ১০০ টাকা এবং মোলপেডের দাম ২৩৫ টাকা।

বাজারে স্যানিটারি প্যাডের দাম দেখে শাসুদ্দিন আহমেদ নামের একজন ক্রেতা বলেন, ‘আমরা এমনিতেই অনেক বিষয়ে অসচেতন। আমরা রোগের শেষ পর্যায়ে না গেলে ওষুধ খেতে চাই না অথবা টাকার জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে চাই না। খরচ বৃদ্ধি না করে অনেক নারী প্রচলিত পন্থায় শারীরবৃত্তীয় এ কাজটিকে সামলে নেন। ফলে এক সময় কঠিন রোগে ভোগে আরও বেশি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন।’

পুরনো কাপড় ব্যবহার প্রসঙ্গে গাইনি কনসালট্যান্ট ডা. শারমিন জানিয়েছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে সমস্যাটা পুরনো কাপড়ে নয়। পুরনো সুতি কাপড় সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিলে এটা ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এ কাপড়টি সাবান দিয়ে ধুয়ে নিলেও রোদ লাগে এমন দৃশ্যমান জায়গায় শুকাতে দেওয়া হয় না। এটা ঘরের কোণে অথবা কোনো একটা স্থানে রেখে দেওয়া হয়, যেখানে রোদ লাগে না। ফলে রোদে না শুকানোর কারণে এতে ফাঙ্গাস পড়ে এবং অন্যান্য জীবাণু বাসা বাঁধতে পারে এবং গ্রামের মেয়েরা লজ্জায় এ কাজটিই করে থাকে। এসব কারণে যে পুরনো কাপড় নারীরা ব্যবহার করেন, তাতে রোগ-জীবাণু থেকেই যায়। এ কারণে স্যানিটারি প্যাডই ব্যবহার করা উচিত।’ 

স্যানিটারি প্যাড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান স্যানোরার এক জরিপে বলা হয়েছে, সেখানে অংশ নেওয়া ৮৭ শতাংশ নারীই প্যাড ব্যবহার করে না। আবার ৪০ শতাংশ নারী এখনো পর্যন্ত প্যাড ব্যবহার সম্পর্কে জানেনই না।

‘ডোনেট এ প্যাড ফর হাইজিন বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী মারজিয়া প্রভা কাজ করছেন স্যানিটারি প্যাডের দাম কমানোর আন্দোলনে। তিনি গ্রামের স্কুল ছাত্রীদের ঋতু¯্রাব নিয়ে সচেতনতার কাজ করেন স্বেচ্ছা ভিত্তিতে। একই সঙ্গে তিনি কম মূল্যে মেয়েদের স্যানিটারি প্যাড দিয়ে থাকেন। আবার যাদের এই কম দামে কেনারও সামর্থ্য নেই, তাদের বিনামূল্যে প্যাড দিয়ে থাকেন তিনি। 

মারজিয়া প্রভা বলেন, তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়ায় একটা ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পেইনে যান কিছু প্যাড নিয়ে। ওই যাত্রায় বিভিন্ন জন তাকে প্রায় ৬০০টি প্যাড দেন বিনামূল্যে। তিনি জানতে পারেন, সেখানকার মেয়েরা ঋতু¯্রাবের সময় নোংরা কাপড়, কাপড়ের মধ্যে বালি ব্যবহার করেন। আবার অনেকে এ সময় কিছুই ব্যবহার করেন না। পেটিকোট রক্তে ভেসে গেলে নদীতে গিয়ে কিছুক্ষণ ডুব দিয়ে ধুয়ে আসেন তারা। আবার কাপড়গুলো না শুকিয়েই, সেই নোংরা অথচ ভেজা কাপড় নিয়েই কাজ করেন। যাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেন তারা তাকে কম দামে স্যানিটারি প্যাড দেন বলে জানান প্রভা।

নারীর জন্য অত্যাবশ্যক হলেও সরকার এটাকে বিলাসী পণ্যের আওতায় ফেলে করারোপ করেছিল। পরে তা প্রত্যাহার কর হয়। সরকার স্যানিটারি ন্যাপকিনের কাঁচামালের ওপর আরোপিত ৪০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এ বিষয়ে গত ১ জুলাই প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে। কথা ছিল করারোপ তুলে নেওয়া হলে স্যানিটারি প্যাডের মূল্য বর্তমানের চেয়ে অর্ধেকে নেমে আসবে, কিন্তু অর্থ বছরের চার মাস চলে গেলেও স্যানিটারি প্যাডের মূল্য কমানো হয়নি।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //