বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন

মাতৃভাষা প্রতিটি জাতির অস্তিত্বের সাথে জড়িত। বাংলা ভাষার স্থান আমাদের হৃদয়ের গভীরে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা মায়ের সন্তানরা তাদের মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠায় নিজের বুকের রক্ত দিয়েছিল।  ১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১১ জন শহীদ হন।

আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সৃষ্টি হয়েছিল এক রক্তস্নাত অধ্যায়ের মহান দৃষ্টান্ত। ঠিক তেমনি ১১ জন ভাষাশহীদের রক্তের বিনিময়ে আসামে বাংলা ভাষা রাজ্যভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছিল ১৯ মের রক্তস্নাত অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে।

সারাবিশ্বের বাঙালিদের জন্য এ এক গর্বের ইতিহাস। ২১ ফেব্রুয়ারির মতো উনিশে মের ১১ জন ভাষাশহীদ সমগ্র বিশ্বের মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষের গর্ব ও অহংকার। আমরা প্রায়ই গর্ব করে বলে থাকি একমাত্র বাংলাদেশের বাঙালিরাই ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আমাদের পাশের দেশ ভারতের আসামেও যে ভাষার জন্য রক্ত ঝরেছে সে ব্যাপারে এখনো অনেকের অজানা রয়ে গেছে।

ব্রহ্মপুত্র ও বরাক, দুই নদের অববাহিকা অঞ্চলে বিভক্ত আসাম। দুই নদের অববাহিকা অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি এমনকি ভৌগোলিক অবস্থানেও বিস্তর ফারাক। ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, মেঘালয় ছাড়াও বাংলাদেশ দিয়ে ঘেরা বরাকে আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে সড়কপথে সরাসরি যাওয়ার রাস্তা নেই। অসমিয়া নয়, এখানে সবাই কথা বলেন বাংলায়। খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতিও বাঙালিদের মতোই।

প্রথম থেকেই বরাকের বাঙালিরা সংখ্যালঘু অসমিয়াদের দাদাগিরির শিকার হয়ে আসছিলো। ১৯৬০ সালে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নেয় গোটা রাজ্যে শুধু অসমিয়া ভাষাই সরকারি স্বীকৃতি পাবে। প্রতিবেশী পূর্ব পাকিস্তানে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনায় সমৃদ্ধ বরাকের বাঙালিরা প্রতিবাদে শামিল হন। শুরু হয় ভাষা আন্দোলন।

বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে বরাক জুড়ে শুরু হয় আন্দোলন। এই আন্দোলনকে গুরুত্ব না দিয়ে কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী বিমল প্রসাদ চালিহা ১০ অক্টোবর বিধানসভায় বিল আনেন একমাত্র অসমিয়া ভাষার সরকারি স্বীকৃতির।

অসমিয়াদের তীব্র বাঙালিবিদ্বেষের প্রতিবাদে ঝড় ওঠে বরাক উপত্যকায়। শুরু হয় গণ-আন্দোলন। ৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় কাছাড় গণসংগ্রাম কমিটি। বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন পায় নতুন গতি। ১৪ এপ্রিল বরাকের কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে পালিত হয় সংকল্প দিবস।

১৩ এপ্রিল গণসংগ্রাম কমিটির নেতা রবীন্দ্রনাথ সেন ১৯ মে ১২ ঘণ্টার হরতালের ডাক দেন। বাঙালির আন্দোলনের তীব্রতার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে আসাম সরকারের দমন-পীড়নও। পুলিশ, আধা-সেনা নামিয়ে আন্দোলন দমানোর সব রকম চেষ্টা শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়-এই অজুহাতে জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।

১৯ মের আগে থেকেই নিরাপত্তা বাহিনীতে ছেয়ে যায় বরাক উপত্যকা। ১২ মে থেকেই সেনা কমান্ডে পরিচালিত আসাম রাইফেলস জওয়ানেরা শুরু করেন ফ্ল্যাগ মার্চ। ১৮ মে গ্রেফতার হন রবীন্দ্রনাথ সেন, নলিনীকান্ত দাশ, বিধুভূষণ চৌধুরীসহ ভাষা আন্দোলনের প্রথম সারির নেতারা।

১৯ মে সকাল থেকেই সত্যাগ্রহীরা অহিংসভাবে হরতাল পালন করছিলেন। তিন জেলাতেই পিকেটারদের গ্রেফতার করে পুলিশ। শিলচরের তারাপুর রেলস্টেশনেও শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল অবরোধ। ভারতীয় সময় বেলা ২টা ৩৫ মিনিট নাগাদ বিনা প্ররোচনায় নিরাপত্তারক্ষীরা ১৭ রাউন্ড গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন নয়জন ভাষাসৈনিক। পরে আরো দুজনের মৃত্যু হয়। জখম হন আরো একজন।

৫২ পর ৬১, মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিলেন বাঙালি। শহীদ হলেন, কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য। এই আন্দোলনের পর বাংলা ভাষা বরাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

“দেখা যায়, আসামের ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বহু নারী জড়িত ছিলেন। শিলচরের বিজন শংকর রায়ের (তখন কলেজের ছাত্র) কথায় জানা যায়, সংগ্রামের প্রস্তুতির জন্য যখন চাঁদা তুলতে গেছেন, তখন বাজারের ভিতরে এক মেয়ে দোকানী তাঁর হাতে দুই আনা পয়সা দিয়ে বলেছিলেন, বাবা, আমাদের ভাষা আসবে তো? এই দোকানীর হয়তো সারাদিনে উপার্জন হবে আট আনা। সেখান থেকে সে দুই আনা দিয়ে দিলো।

মাতৃভাষার প্রতি তীব্র ভালোবাসা না থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। মে মাসের প্রখর রোদে বিজন শংকর খোলা মাঠে বক্তৃতা করছেন। হঠাৎ অনুভব করলেন তাঁর গায়ে ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে। তিনি অবাক হয়ে তাকাতেই দেখলেন একজন বৃদ্ধা মা তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করে চলেছেন এবং তার পাশে একটি বাচ্চা ছেলে পানির গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবার শহরের দক্ষিণ প্রান্তে যখন সভা করতে গেলেন তখন একজন মা এসে তাকে মঙ্গল চণ্ডির আশীর্বাদ দিলেন।

এদিকে শহরের উত্তর প্রান্তে যখন বক্তৃতা করতে গেলেন তখন এক গ্লাস পানি চাওয়ার কিছুক্ষণ পর পাশের বাড়ি থেকে একটি কিশোরী মেয়ে শরবত নিয়ে এলো। তাদের দলেও ছিলো সংগ্রামী ছয়টি মেয়ে। সুতরাং দেখা যায়, আসামে বাংলা ভাষার জন্য মেয়েরা মায়েরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমান তালে এগিয়ে এসেছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে আসামেরই মেয়ে কমলা ভট্টাচার্য একমাত্র নারী যিনি বাংলা ভাষার জন্য শহীদ হয়েছেন। (সূত্র : বরাকের ভাষা আন্দোলন- আখতারুন নাহার আলো, আসামে বাংলা ভাষা আন্দোলন- ভাষা আন্দোলন স্মৃতিরক্ষা পরিষদ, ১৯ মে, ২০১০)

কমলা ভট্টাচার্যের ছোটবোনের নাম মঙ্গলা ভট্টাচার্য। সে তখন ৫ম শ্রেণির ছাত্রী। ১৯৬১ সালের ১৯ মে সে কিছু না বুঝেই বন্ধুদের সাথে চলে যায় রেল স্টেশনে। শত শত নারী পুরুষের মাঝে সে খুঁজে নেয় তার দিদি কমলাকে। অবাঙালি সিআরপি পুলিশ যখন এলোপাথাড়ি গুলি করতে থাকে, তখন তার দিদি রেল লাইন ধরে দৌড়চ্ছিলেন। মঙ্গলাও কমলার পিছু পিছু দৌড়চ্ছিলেন। দশ বার হাত দূর থেকে পুলিশ কমলা ও মঙ্গলাকে গুলি করে। দু’বোনই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কমলা সাথে সাথেই মৃত্যুবরণ করেন। মঙ্গলা তিন মাস শিলচরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

পরে সুস্থ হয়ে শিলচর ছেড়ে তার রেলকর্মী দাদার কাছে গৌহাটিতে চলে আসেন। কমলার বড় দিদি বেনু ভট্টাচার্য বদরপুর রিটায়ার কলোনীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। তিনি নার্সের চাকুরি করতেন। প্রতি বছর উনিশে মে বদরপুরের বাড়িতে অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার সাথে তুলসীতলায় এক গ্লাস শরবত রাখতেন কমলার অতৃপ্ত আত্মার উদ্দেশ্যে। কমলা ভট্টাচার্যের মা সুপ্রভাষিণী ভট্টাচার্য কমলার শোকে পাগল হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।”

প্রতি বছর ১৯ মে তাঁদের স্মরণে এখনো বরাক উপত্যকায় ভাষা শহীদ দিবস পালিত হয়ে আসছে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে তারিখে যে শিলচর স্টেশনে আর তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে আসাম পুলিশের গুলিতে এক নারীসহ ১১ জন প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের লড়াইতে, সেই রেল স্টেশনটির নাম হয়েছে এখন ভাষা শহীদ স্টেশন।

বরাকের মানুষ ২০০৫ সালে প্রথম দাবি তুলেছিলেন যে বাংলা ভাষার আন্দোলনের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, সেই শহীদদের মর্যাদা দেয়ার জন্য স্টেশনটির নামকরণ হোক ভাষা শহীদ স্টেশন। তবে স্টেশনের নাম ভাষা শহীদ স্টেশন করা হলেও বাংলা ভাষা আন্দোলনে নিহতদের শহীদের মর্যাদা দিবে বললেও এখনো প্রজ্ঞাপন জারি করেনি ভারত রাষ্ট্র।

বিহারের মানভূম-সিংভূম বাংলা ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে ছিলেন অধ্যাপক সুভাষ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়।  তাঁর পরিবারও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। গেলো ফেব্রুয়ারিতে কথা হয় তাঁর সাথে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বাংলা ও বাঙালি জাতিকে যেভাবে ধারণ করে বাঁচিয়ে রেখেছেন তা নিশ্চয়ই শ্রদ্ধা করার মতো। আসামেও আমাদের আন্দোলন করে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে হয়েছে। আমি সেই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে দুই দেশের বাঙালিদের মধ্যে আরো পারস্পরিক বুঝাপড়া বাড়াতে হবে। দুই বাংলার মানুষের মধ্যে এখনো যে দূরত্ব রয়েছে তা কমিয়ে আনতে হবে।


এ কথা গর্ব করেই বলা যায়, বাঙালি হল এমন এক জাতি, যারা মাতৃভাষা রক্ষার্থে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। অথচ বরাক উপত্যকার সেই ভাষা আন্দোলনের কথা কতটুকু আমরা জানি? আমাদের এখানে ১৯৬১ সালের সেই ভাষা আন্দোলনের ওপর খুব কম আলোচনাই হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //