প্রধানমন্ত্রীকে কি বিতর্কিত করা হচ্ছে না?

শেখর দত্ত

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২০, ০২:৩০ পিএম

কলাম লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে কয়েকটা ভাবনা যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল এবং কোন বিষয় নিয়ে লিখব এ প্রশ্নে পেন্ডুলামের মতো দুলছিলাম- তখন ১২ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত বিশিষ্ট কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘শেখ হাসিনার চূড়ান্ত পরীক্ষা’ শিরোনামের লেখাটির কথা মনে পড়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে গেল। কলামের ছোট পরিসরে সুন্দর তিনটি গল্পের সমাহারে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো ওই কলামটিতে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে কেউ নেই, রাঘববোয়ালদের বহিষ্কার ও কঠোর শাস্তি দিতে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা প্রভৃতি নিয়ে যথাযথ মন্তব্য করে সবশেষে লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী দারুণ সংগ্রাম করে যা অর্জন করেন, তা ব্যর্থ করার জন্য তার চারপাশেই রাঘববোয়ালের দল তৎপর। ... কিন্তু এই দুরূহ কাজটিই ভাগ্যবিধাতা হাসিনার ওপর চাপিয়ে তার দক্ষতা, যোগ্যতা ও ধৈর্যের পরীক্ষা করছেন।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধারাবাহিকভাবে বদি, সম্রাট, পাপিয়া, পাপুল, সাহেদ গংদের বিরুদ্ধে যখন যথাসম্ভব ভারসাম্যমূলকভাবে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করেছেন, তখন দেখা যাচ্ছে, তার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য যতটুকু না পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রচার হচ্ছে, তার চাইতে কী বলা হলো না হলো তা নিয়ে সমালোচনা, আঁকাবাঁকা কথা কিংবা নীরবতা পালন বেশি হচ্ছে। যার ফলে রাঘববোয়ালরা একাট্টা ও তৎপর হতে পারছে। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিতর্ক বা সমালোচনা হতে পারে, এমন সব নেগেটিভ বা ডিফেন্সিভ কথার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে? সুযোগসন্ধানী, সুবিধাবাদী ও স্বার্থবাদী ‘চাটার দল’ নিজেদের আড়াল করতে কিংবা পিঠ বাঁচাতে নেত্রীকে যেন বর্মের মতো সামনে কথা বলতে এগিয়ে দিচ্ছে? করোনা দুর্যোগের মধ্যে মানুষ যখন অনিশ্চয়তার মধ্যে স্পর্শকাতর তখন এটা কি ঠিক হচ্ছে?

প্রশ্নগুলো এভাবে করলাম এ কারণে যে, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে বিশ্বের সব দেশের সরকার পড়েছে নেগেটিভ বা ডিফেন্সিভ অবস্থার মধ্যে। যে কোনো সরকারের জন্যই অনিশ্চিত অবস্থা এবং খারাপ সময়। সর্বোপরি কেবল একদিক থেকে নয়, সবদিক থেকে পরিস্থিতি অনিশ্চিত। করোনা শুধু নয়, যে কোনো রোগে নিজে বা পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে কি হবে, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া কি হবে, বাড়ির বাইরে বা প্রবাসে ছেলে-মেয়ে আত্মীয়-স্বজন কেমন আছে প্রভৃতি সবকিছু নিয়েই মানুষ রয়েছে অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে। আর অনিশ্চিত থাকা মানেই উদ্বেগ ও শঙ্কার মধ্যে থাকা। উদ্বেগ ও শঙ্কা মানুষকে স্পর্শকাতর করে তোলে। তখন সীমাবদ্ধতা-দুর্বলতাসহ নেগেটিভ ছোট বিষয় বড়, বড় বিষয় আরও বড় হয়ে দেখা দেয়। সরকার তো সবকিছুর দায়িত্বে। সবচেয়ে সহজ সরকারকে টার্গেট করা। 

প্রসঙ্গত, প্রায় প্রতিদিনই দেশের গ্রামাঞ্চল থেকে সহযোদ্ধা বন্ধুরা টেলিফোন করেন। করোনা বিপর্যয়ের দিনগুলোতে রাজধানীর হালচাল জানতে, নিজেদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানাতে। কেমন আছে গ্রামের মানুষ জানতে চাইলে প্রথমেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে যে বিষয়টা বলেন, তা হলো করোনা দুর্যোগের মধ্যেও বাম্পার ধানের ফলন হয়েছে, কৃষক ধান কেটে ঘরে তুলতে পেরেছে, এবারে কৃষক দাম ভালো পাচ্ছে। তারা কেউ কেউ এমনটাও বলেন, দাম পাওয়ায় কৃষক খুশি। খেটে খাওয়া মানুষের কাজেরও তেমন অভাব নেই। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও মোটামুটি ভালো। জীবন-জীবিকা গ্রামে প্রবাহমান। তবে মানুষের করোনা-বিপর্যয়ের মধ্যে কারও অর্থকষ্ট নেই, ত্রাণ পাওয়ার আর্তি নেই, নানা বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই বা ত্রাণ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা নেই, এমনটা নয়। অনেক অনেক মন্দ-অশুভ খবরের মধ্যে সবচেয়ে ভালো খবর তো এটাই। কৃষক ও গ্রাম বাঁচলে, বাংলাদেশ বাঁচবে- কথাটা যথার্থ।

বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হলো, ধান কাটার লোক যখন পাওয়া যায় না, ফসল যখন মাঠে পড়ে থাকার উপক্রম হয়, তখন মাঠের ফসলে আগুন দেয়ার ছবি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কৃষক যখন ন্যায্যমূল্য পায় না, তখন গণমাধ্যম ঝড় তোলে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের সমালোচনায় মুখর হন। কিন্তু দুর্যোগের মধ্যে যখন কৃষক ফসলের দাম পাচ্ছে, তখন কিন্তু এ বিষয়ে প্রচার মাধ্যমে প্রায় নীরবতা বিরাজ করছে। ভালো খবরে নীরব, খারাপ খবরে সরব- এই সংস্কৃতিটা পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। গণ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দেশবাসীর কাছে কেবল ভগ্নদূত হোক, এটা চাওয়া হতে পারে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এসব অর্জন ও সাফল্যের উৎসাহের দিকটা মানুষের সামনে তুলে ধরাটাই প্রধান বিষয়। কেননা নিতান্ত অন্ধ ব্যতীত করোনা অনিশ্চয়তা-দুর্যোগের মধ্যে দেশবাসী সবাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে উৎসাহের খবরই আশা করবে। তিনি নানাভাবে উৎসাহের কথা বলছেন, মানুষের আশা জাগিয়ে রাখছেন এটা সর্বৈব সত্য; কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে, তাকে মন্দ ঘটনা ডিফেন্ড করার দিকে, বিতর্কিত ও সমালোচিত হতে পারে এমন কথা বলার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। ‘চোর ধরেও চোর হয়ে যাচ্ছি। আমরাই ধরি আবার আমাদেরই দোষারোপ করা হয়। এটাই হলো দুর্ভাগ্য।’ কথাগুলো খুবই নেগেটিভ ও ডিফেন্সিভ। এ ধরনের কথার প্রতিক্রিয়া ভালো হতে পারে না। এই কথার পিঠে কত ধরনের সমালোচনা যে হতে পারে! হয়েছে বা হচ্ছেও।

তথ্য সুস্পষ্ট ও সঠিকভাবে না জানা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পাপুল কুয়েতের নাগরিক হলে সংসদ সদস্যপদ এমনিতেই চলে যাবে ইত্যাদি না বললেও পারা যেত। কুয়েতে যদি এই সংসদ সদস্য বন্দি থাকে, সেখানে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হতে দেরি হয়, তবে বাংলাদেশ কি করবে? পাপুলের বিষয়ে দুদক ব্যবস্থা নিচ্ছে। সেই কথাটা সুস্পষ্ট করাই তো সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজন। তা সুস্পষ্ট করবে দুদক। কেননা জবাবদিহি দুদকের রয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ফাইল খুলে ৪-৫ মাসে কী করল দুদক? রিজেন্টের সাহেদ কেলেঙ্কারির বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলুক। তিন সচিব নিয়ে তিনি কেন লাইসেন্স নাই এমন একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করলেন? দুদক বিষয়টি তদারকি করুক।

সংসদে সমাপনী বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতি-অনিয়ম বিষয়ে সুস্পষ্ট বলেছেন, ‘কে কোন দলের সেটা বড় কথা না। দুর্নীতি অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত, যেখানেই পারছি, ধরছি।’ এভাবে বলা অর্থাৎ বিশেষভাবে দিক-নির্দেশনাটাই তো যথেষ্ট। খুঁটিনাটিসহ অসমাপ্ত সব কাজ নিয়ে সব কথা তিনি বলতে যাবেন কেন? প্রধানমন্ত্রী ইতিবাচকভাবে সব বিষয়ে বলবেন, মন্ত্রণালয়-প্রশাসন প্রধানমন্ত্রীর কথানুযায়ী পদক্ষেপ নিবে, নির্দেশ বাস্তবায়ন করবে। জনগণ দেখবে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশমূলক কথায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কাজ হচ্ছে কি না? কাজ হলে মানুষ খুশি হবে, ভরসা বাড়বে। আর না হলে তাদের সমালোচনা করবে। স্বচ্ছ ও জবাবদিহি প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও পদাধিকারীর জন্য প্রযোজ্য।

মুজিববর্ষ, তাই বঙ্গবন্ধুর তাস খেলার একটি গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। ‘বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ’ বইটির লেখক বিশ^খ্যাত সাংবাদিক এন্থনি মাসকার্নহাস যুব বয়সে ছিলেন শেখ মুজিবের একান্ত বন্ধু। ১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মকালে আমেরিকা সরকারের আমন্ত্রণে ওই দেশ ভ্রমণের সময় প্রায় এক মাস হোটেলের একই রুমে থাকার সময়ে করাচিতে পূর্ব পরিচিত শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সাংবাদিক বন্ধুটি বঙ্গবন্ধুকে চটাতেন এই বলে যে, ‘আমি তাঁকে তাঁর স্ত্রীর চাইতেও বেশি জানি।’ তিনি লিখেছেন, সুদক্ষ তাস খেলোয়াড় শেখ মুজিবসহ তাদের দলটি অ্যারিজোনা রাজ্যের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখে ট্রেনে লস এঞ্জেলেস যাচ্ছিলেন। ডিনার সেরে তারা মজা করতে তাস খেলতে বসে গেলেন। দুই বন্ধু জুটি বাঁধলেন তিন ইন্দোনেশীয়র বিরুদ্ধে।

হারতে শুরু করলেন দুই বন্ধু। এক পর্যায়ে মাসকার্নহাস খেলতে চাইলেন না; কিন্তু বঙ্গবন্ধু নাছোড়বান্দা। এটেনডেন্টকে বলে নতুন এক প্যাকেট তাস আনলেন। তখন তাঁরা বিস্ময়করভাবে জিতে গেলেন। কেমনে জেতা সম্ভব হলো প্রশ্ন করায় শেখ মুজিব বললেন, ‘তুমি যখন কোনো ভদ্রলোকের সঙ্গে খেলবে, তখন তোমাকে ভদ্রলোক হয়ে খেলতে হবে। আর তুমি যখন বদমাশের সঙ্গে খেলবে, তখন তোমাকেও এর চেয়ে বড় বদমাশ হতে হবে। তা না হলে তুমি হেরে যাবে।’ গল্পটার বহুমুখী দিক বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের জন্যও সর্বৈবভাবে প্রাসঙ্গিক। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা শুধু আওয়ামী লীগেরই নয়, দেশের রাজনীতিরও সম্পদ।


শেখর দত্ত

কলাম লেখক, রাজনীতিক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh