মাওলানা লিয়াকত আলী
প্রকাশ: ২৩ মে ২০২০, ০৫:১১ পিএম
সামনে ঈদুল ফিতর। মাহে রমজানের পর আসে মুসলিম মিল্লাতের বার্ষিক প্রধান দুটি আনন্দ উৎসবের একটি ঈদুল ফিতর। ঈদ অর্থ আনন্দ। আর ফিতর বলতে রোজার সমাপ্তি কিংবা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্য।
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনায় নিয়োজিত থাকার পর তাতে সমাপ্তি ঘটানো অর্থাৎ দিনের বেলায় পানাহারের স্বাভাবিক নিয়মে ফিরে যাওয়া উপলক্ষে আনন্দ উপভোগের ব্যবস্থা করেছে ইসলামী শরিয়ত। এটা শুধু অনুমতি নয়, বরং অনেকটা বাধ্যতামূলক নির্দেশ। কেননা শাওয়ালের প্রথম দিনে রোজা রাখাই নিষিদ্ধ। দুই ঈদের দিনে পানাহার করা ও আল্লাহর নিয়ামতের স্বাদ গ্রহণ করা অবশ্য পালন করার তাৎপর্য অনেক।
হাদিসের গ্রন্থগুলোয় বর্ণিত আছে, মহানবী (সা.) হিজরত করে মদিনায় এসে দেখলেন সেখানকার বাসিন্দারা বছরের দুটি দিন আনন্দ উৎসবে কাটায়। যদিও এর আগে সেখানকার অনেকে মুসলমান হয়েছিল; কিন্তু প্রথাটি চালু ছিল। যেহেতু এতে পৌত্তলিকতার ছাপ ছিল এ জন্য মুসলমানদের তাতে যোগ দেয়ার ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় আল্লাহর নবী (সা.) তাদের জানালেন, আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের আরো উন্নত ও উত্তম দুটি দিন দান করেছেন আনন্দ উৎসবের জন্য। একটি রমজান মাসের শেষে শাওয়ালের প্রথম তারিখে। আরেকটি জিলহজ মাসের দশম তারিখে বা হজের পরের দিন। দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য দুই ঈদের দিন নির্ধারিত হয়েছে। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনায় আত্মনিয়োগের মাধ্যমে তাকওয়ার স্তর উন্নত করা এবং তার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার একান্ত সান্নিধ্য ও অসাধারণ অনুগ্রহের উপযোগী হতে পারা নিঃসন্দেহে খুশির বিষয়। তেমনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ও শ্রম দিয়ে দীর্ঘ সফরের পর সম্পন্ন হয় হজ। ৯ তারিখ আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের মাধ্যমে হজ আদায়ে সক্ষমতা প্রমাণ হয়, যা আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানিতেই সম্ভব। তাই পরের দিন আনন্দ প্রকাশ যুক্তিসঙ্গত। যারা হজে যান না, তারা হাজিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য নিজ বাড়িতে থেকেও খুশি উদযাপন করেন, যার নাম ঈদুল আজহা।
প্রতিটি জাতিগোষ্ঠী নির্দিষ্ট দিনে আনন্দ করে থাকে। সাধারণত দেখা যায়, যারা ধনী, তারা আনন্দ-ফুর্তি করে, গরিব-অসহায়রা তা থেকে বঞ্চিত থাকে; কিন্তু ইসলামে ঈদের খুশি শুধু ধনীরা করতে পারবে তা নয় শুধু, বরং গরিব-অসহায়রাও ঈদের খুশি উপভোগ করবে। তাই ঈদুল ফিতরের সময় ধনীদের ওপর সাদাকাতুল ফিতর অত্যাবশ্যক করা হয়েছে। মুসলমানদের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব হচ্ছে ঈদুল ফিতর। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস মাহে রমজান। যারা মাহে রমজানকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পেরেছেন, তাদের জন্য ঈদ খুশির বার্তা নিয়ে আসে।
সিয়াম সাধনার মাস সফলভাবে সম্পন্ন করার শেষ প্রান্তে উপনীত হওয়া একটি শুভ আলামত। তাই আল্লাহতায়ালার অপার রহমত ও অনুগ্রহের অধিকারী হওয়ার এবং পাপরাশি থেকে পাকসাফ হয়ে ঈদের আনন্দ ভোগের সুসংবাদ ঘোষণা হয়ে থাকে রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে।
তবে মাহে রমজানে যেসব সদভ্যাস গড়ে উঠেছে, যেসব নেক কাজ পালন করা হয়েছে, বিশেষভাবে নফল ইবাদতের প্রতি মনোযোগ দেয়া হয়েছে, রমজানের পরও সেগুলো অব্যাহত রাখতে পারা বড়ই সৌভাগ্যের বিষয়। তাকওয়া, তাওয়াক্কুল ও খোদাপ্রেমের দীক্ষা রমজানের বহুল আলোচিত বিষয় হলেও এগুলোর সম্পর্ক শুধু এ মাসের সঙ্গে নয়, সারা জীবন এ সব মহৎ গুণ চর্চা করা সৌভাগ্যের চাবিকাঠি।
দুনিয়াতে মানুষের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য আল্লাহর আদেশ ও অভিপ্রায়ের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। বস্তুত এরই নাম ঈমান ও ইসলাম। যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্যের শপথ করে নিজেদেরকে মুমিন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে, তাদের কিছু নিয়ম কানুন মাথা পেতে নিতে হয়। জীবন নির্বাহের সুনির্দিষ্ট পথ বেয়ে তাকে চলতে হয়। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে তাকে অনুসরণ করতে হয় শরীয়ত নির্দেশিত নীতিমালা। ভোগ-আস্বাদন-বিনোদনেও তাকে সীমারেখা মেনে চলতে হয়। এভাবে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখার সাধনা তাকে করে যেতে হয় সব সময়ের জন্য। এ ক্ষেত্রে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্তের মেয়াদ সীমাবদ্ধ নেই। এমনকি পার্থিব জীবনে এ সিয়ামের ইফতারও নেই। যেদিন আহকামুল হাকেমীনের দরবারে হাজির হতে হবে, দুনিয়াবি জীবনের প্রতিটি কথা, কাজ ও আচরণের হিসেব দিতে হবে, সেদিন সেই হিসাব-নিকাশে যদি উৎরে যাওয়া যায়, তাহলে রহমাতুল্লিল আলামীন হাউজে কাওছারের শরবত দিয়ে এসব রোজাদারকে ইফতার করাবেন। তারপর তাদের পাঠিয়ে দেয়া হবে জান্নাতে, যেখানে তাদের উপভোগের জন্য তৈরি রাখা হয়েছে এমন নেয়ামতরাজি, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি, এমনকি কোনো মানুষের কল্পনায়ও আসেনি। সেটাই তো প্রত্যেক মুমিনের কাম্য।
নিয়ন্ত্রিত ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন নির্বাহ করা ইসলামের অন্যতম মৌলিক শিক্ষা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানাহার, নিছক উদরপূর্তি কিংবা রসনা তৃপ্তির জন্য আহার মুমিনের আদর্শ নয়। মুমিনের প্রতিটি কাজ হতে হবে উদ্দেশ্য ও ফলাফল বিবেচনায় রেখে। পার্থিব স্বার্থ ও সুবিধার চেয়ে আখেরাতের কল্যাণকে প্রাধান্য দিতে হবে। রমজানের ত্রিশ বা ঊনত্রিশ দিনের পর পানাহার ও কামাচার নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ রহিত হবে না। সব ক্ষেত্রেই তাকে আল্লাহর নির্দেশ ও রাসূলুল্লাহর নির্দেশনা মেনে চলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এই প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারই রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাসের শেষভাগে মুমিন বান্দাদের একান্ত কর্তব্য।
ঈদের দিনটি আমাদের জন্য আনন্দের দিন। মনের সব কালিমা দূর করে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে, মান-অভিমান বিসর্জন দিয়ে সবাই হাতে হাত মেলানো, বুকে বুক মেলানো, গলায় গলা মেলানো অর্থাৎ সবার দেহ-মন এক হওয়ার আনন্দ হলো ঈদের আনন্দ; নিজের মনের হিংসা, ঘৃণা, লোভ, অহঙ্কার, অহমিকা, আত্মম্ভরিতা, আত্মশ্লাঘা, ক্রোধ, বিদ্বেষসহ যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করার আনন্দ। সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির আনন্দ।
ঈদের দিনে খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, মিসওয়াক করা, মহল্লার (এলাকার) মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়া, গোসল করা, সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা, আতর ব্যবহার করা, নামাজের আগে সদাকাতুল ফিতর আদায় করা, ঈদুল ফিতর নামাজের আগে কিছু মিষ্টান্ন খাওয়া, তিন, পাঁচ বা বেজোড়সংখ্যক খেজুর বা খুরমা খাওয়া, সকাল সকাল ঈদের নামাজ পড়ার জন্য যাওয়া, ঈদের নামাজ ঈদগাহে গিয়ে পড়া সম্ভব না হলে মহল্লার মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়া, আস্তে আস্তে নিম্নলিখিত দোয়া পড়তে পড়তে ঈদগাহে যাওয়া, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ, ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া, এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা, শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে খুশি প্রকাশ করা প্রভৃতি ঈদের সুন্নত। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাঁর সুসংবাদের অধিকারী করুন। প্রকৃত খুশি ও উভয় জগতের কল্যাণ আমাদের নসিব করুন। সবাইকে অগ্রিম ঈদ মোবারক।