মধ্যরাতে রহস্যভেদ

খন্দকার মাহমুদুল হাসান

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২০, ০৩:০৯ পিএম | আপডেট: ৩১ মে ২০২০, ০৩:৪৮ এএম

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। একটা ভয়ংকর দুঃসংবাদ শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল রিংকু। খবরটা হলো, গত রাতে মলয় বাবু খুন হয়েছেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে খুব বেশি দিনের ঘনিষ্ঠতা নয় ওর। জীবনে এক দিনে মাত্র দু’বার দেখা হয়েছে তার। সেই দিনের স্মৃতিটা ভেসে উঠল ওর চোখের সামনে।

সেদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই দোতলার বারান্দায় বাগানবিলাসের ডালগুলোর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রিংকু। নিচ থেকে ডালগুলো উঠে এসে পৌঁছে গেছে তৃতীয় তলা পর্যন্ত। ফুলে ফুলে ভরে গেছে। ওদিকে নিচের রাস্তায় মানুষের আনাগোনা ধীরে ধীরে বাড়ছে। স্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় হনহনিয়ে হেঁটে চলেছে কেউ কেউ। রাতের শিফটের কাজ শেষে কারখানার শ্রমিকেরা শিগগিরই পথে নেমে আসবে। এমন সময় পাশের বাড়ি থেকে বেশ জোরে চিৎকার ভেসে এলো। ও ভেবেই পেল না সাতসকালে কে এমন চিৎকার করতে পারে। এ অবস্থায় কী করা উচিৎ তা নিয়ে একটু ভাবল।

তারপর গায়ে জামা চাপিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল। প্রধান ফটকটা ভেতর থেকে বন্ধ। ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবে নাকি ফিরে যাবে তাই নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেল সে। কারণ ভেতরে ঢুকলেই দারোয়ান জিজ্ঞেস করবে কোন ফ্ল্যাটে যাবে। কিন্তু ও তো জানে না কোন ফ্ল্যাট থেকে আওয়াজ এসেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ফিরে যেতে উদ্যত হয়েছে সে এমন সময় ফটক খুলে বেরিয়ে এলেন বাড়ির একজন বাসিন্দা হালিম চাচা। এই হালিম চাচার সঙ্গে পরিচয় আছে রিংকুর।

এই চিৎকার কোত্থেকে এলো তা জানতে চাইলে চাচা জানালেন, আওয়াজ এসেছে তিন তলা থেকে। তার পাশের ফ্ল্যাটের প্রদীপ বাবুর বাসা থেকে। আওয়াজ শুনে প্রতিবেশীদের মধ্যে তিনিই প্রথম ছুটে গিয়েছিলেন। তিনি জানালেন, প্রদীপ বাবুর একমাত্র মামা মলয় বাবু আমেরিকায় থাকেন। তিনি কয়েকদিন হলো দেশে এসেছেন। বরাবরের মতো এবারেও তিনি একমাত্র ভাগ্নের বাড়িতেই উঠেছেন। দু’জনেই একমাত্র, অর্থাৎ প্রদীপ বাবুর আপন মামা যেমন মলয় বাবু, আবার মলয় বাবুরও একমাত্র আপন ভাগ্নে এই প্রদীপ বাবু।

সাতসকালে কেউ তাকে ফোন করেছিল। ফোনটা পাওয়ার পরেই তার চোখেমুখে ফুটে ওঠে আতঙ্কের ছাপ। আর কিক্ষুক্ষণের মধ্যেই তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। হঠাৎ করে জ্ঞান হারানোর ব্যাপারটায় খুব ভড়কে যান তার স্ত্রী। ভীষণভাবে চিৎকার করে ওঠেন তিনি। তাতে পুরো বাড়ির মানুষ ছুটে আসে ওই ঘরে। পরে অবশ্য বুদ্ধি খাটিয়ে তার চোখেমুখে জল ছিটিয়ে দেওয়া হয়। আর তাতেই ফিরে আসে তার জ্ঞান। 

কথাগুলো শুনে রিংকু বলল, তাহলে তো আমারও যাওয়া উচিত ওখানে। প্রদীপ বাবুদের পরিবারের সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে। আমাদের বাড়ি একই এলাকায়। 

‘তাহলে যাওনা ঘুরে এসো। প্রতিবেশী হিসেবে এ তো কর্তব্যই।’ - কথাগুলো বলে হালিম চাচা হাঁটতে চলে গেলেন। 

প্রদীপ বাবুর ফ্ল্যাটে গিয়ে ও দেখল, মলয় বাবু বালিশে হেলান দিয়ে বিছানায় বসে আছেন। রিংকুদের পরিবারের সঙ্গে তারও জানাশোনা আছে। যদিও বহুবছর ধরে তিনি আমেরিকায় থাকেন, কিন্তু গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। নিয়মিত ফোন করে আশপাশের দু-দশ গ্রামের খোঁজও নেন। সেভাবেই শুনেছিলেন রিংকুর কথাও। কারণ ত্রিসীমানায় কোনো গ্রামের ছেলেই অত্তটুকুন বয়সে সুদূর দার্জিলিং-কালিম্পঙে লেখাপড়া করতে যায়নি। তাই খবরটা দূর আমেরিকা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে অবলীলায়। 

রিংকুকে দেখে তার মনটা খুব খুশি খুশি হয়ে গেল। হেলান থেকে পিঠ তুলে সোজা হয়ে বসে মৃদু হেসে বললেন, তুমি কি আগের মতোই দুষ্টুমি কর? আমি তো শুনেছি, গ্রামে তোমার বাবা তোমাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছিলেন না। শেষে ত্রাতা হিসেবে উদয় হয়ে উদ্ধার করেন তোমার কাকা, এখন এখানে পাশের বিল্ডিংয়ের একটা ফ্ল্যাটের বাসিন্দা যিনি। তুমি নিশ্চয় ওখান থেকেই আসছ। তিনিই তোমাকে দার্জিলিং না কালিম্পং কোথায় যেন ভর্তি করে দিয়েছেন শুনেছি। কি, ঠিক বলিনি? 

হাসতে হাসতে জবাব দিল রিংকু, ওরে বাবা! আপনি তো আমার নাড়িনক্ষত্র জানেন। ওখানকার কঠিন শাসনে দুষ্টুমি করার আর সুযোগ নেই। বছরের নির্দিষ্ট সময় ছাড়া দেশে আসার উপায়ও নেই। মাত্র গতকালই দেশে ফিরেছি। আজকের দিনটা ঢাকায় কাটিয়ে কালই বাড়ি যাব। 

‘জানব না কেন? তুমি কি দূরের কেউ? আমরা তো পাশাপাশি গ্রামের মানুষ। আমার বাড়ি গোপালনগর। তোমার বাড়ি বনোয়ারীনগর। হ্যাঁ, একটা কথা বলতে পার, আমি তো থাকি দূর আমেরিকায়; কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে খবরা-খবর পাওয়ার ক্ষেত্রে এই দূরত্বটা কোনো বাধাই নয়। আমার বাড়ি আর গ্রামের সম্পত্তি দেখাশোনার জন্যে দুলাল কর্মকার নামের একজনকে রেখেছি। ওকে মাসে মাসে টাকা পাঠাই। দিনে অন্তত একবার ওর সঙ্গে কথা হয়ই। অনেকসময় কয়েকবারও। আমি সব খবর পাই। তা তুমি বাড়ি যাবে কবে বলছিলে? ’ - একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলেন তিনি। 

রিংকু হেসে জবাব দিল, কাল। 

মলয় বাবু মাথা দুলিয়ে বললেন, বেশ। আমিও আসছি কয়েকদিনের মধ্যেই। ঢাকায় একটু কাজ আছে আমার। দুলালের মোবাইল নম্বরটা তোমাকে দিয়ে রাখছি। তোমার নম্বরটাও দিয়ে যাও। দিন তিনেক পর আমি গ্রামে যাব। দুলালকে বলে রাখব যাতে সে তোমায় ফোন করে। 

মলয় বাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার পরও রিংকুর মনের মধ্যে খুঁতখুঁত করতে লাগল। কে ফোন করেছিল মলয় বাবুকে, কী এমন প্রশ্ন করেছিল যা শুনে তিনি জ্ঞান পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিলেন, এইসব প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল তার মাথায়। প্রশ্নগুলোর কোনো কুলকিনারা করতে না পেরে বিকেলে আবার হাজির হলো সে মলয় বাবুর কাছে। 

এটা-সেটা বলার পর বলেই ফেলল আসল কথাটা। প্রশ্ন শুনে একটু থমকে গেলেন তিনি। খানিকটা লজ্জা পেয়ে বললেন, আমার অবশ্য অতটা ভেঙে পড়া উচিৎ হয়নি। কিন্তু কী করব বল। বয়স তো আর কম হলো না। এই বয়সে অত ধকল সইতে পারি না। তার ওপর আমার হার্ট খুব দুর্বল। খুব সহজেই আমি ভয় পেয়ে যাই। উড়ো একটা ফোন এলো। আমাকে ধমক দিয়ে বলল, উচিৎ শিক্ষা দেবে। আর কথা না বলেই ফোনটা রেখে দিল। 

ওই নম্বরে পরে আবার ফোন করে দেখেননি?

- প্রদীপ ফোন করেছে কয়েকবার; কিন্তু ফোনটা বন্ধ পেয়েছে। প্রদীপের মেয়ে, মানে আমার ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া নাতনি বলেছিল টাকা আদায়ের মতলবে কেউ হুমকি দিয়ে থাকতে পারে। আবার ভয় দেখিয়ে মজা করার জন্যও কেউ এই কাজ হয়তো করে থাকতে পারে। তবু থানায় একটা জিডি করে রাখতে বলেছিল সে। একে তো থানা-পুলিশের ঝামেলা আমি এড়িয়ে চলতে চাই, তার ওপর আমার তো কোনো শত্রু নেই। ঢাকার শান্তিনগরে আমার যেই বাড়িটা আছে, সেখান থেকে আরমান নামেরভাড়াটিয়াকে বাধ্য হয়ে পুলিশ ডেকে তুলে দিতে হয়েছিল, তার নামে জিডি করতে বলেছিল প্রদীপ। কারণ লোকটা বাড়ি ছাড়ার সময় যে বেশ তর্জনগর্জন করেছিল সেটা ওর জানা। কিন্তু আমি তো নিশ্চিত নই যে, সে-ই ফোনটা করেছে। তাই শেষ পর্যন্ত জিডিও করতে চাইনি।

কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে ফিরে গেল রিংকু। এটাই ওর সঙ্গে মলয় বাবুর শেষ দেখা। পরদিন ও গ্রামে চলে এসেছে। তখন এখানকার স্কুলেও ছুটি চলছিল। তাই পুরনো বন্ধুরা নতুন করে জুটে গেছে চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে। গাছে গাছে বাদুড়ঝোলা হয়ে শাখামৃগদের মতো বেশ আনন্দেই কাটছে দিন। কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ করেই ঘটল এই বিনা মেঘে বজ্রপাতের ঘটনাটা। বেশ সকাল সকাল কে একজন ওর বাবাকে ফোন করে জানাল, মলয় বাবু খুন হয়েছেন। তাও আবার গোপালনগরের বাড়িতে। খবরটা শুনেই রিংকু বুঝল, তাহলে তো তিনি ঢাকা থেকে গ্রামে এসেছিলেন। ওর খুব কষ্ট হলো। বন্ধু পলাশকে ডেকে নিয়ে ছুটল সে মলয় বাবুর বাড়িতে। পলাশের মামাবাড়ি গোপালনগরে। সে ওখানকার অনেককেই চেনে। 

ওরা যখন পৌঁছেছে তখন পুলিশ এসে গেছে। লাশ ময়না তদন্তের জন্যে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মলয় বাবুর নিথর দেহটা বিছানায় পড়ে আছে। একটা বালিশের ওপর রাখা আছে তার মাথা। আরেকটা বালিশ খানিকটা মোচড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে পাশেই। আশপাশে কান্নাকাটি করছে অনেকেই। মৃতদেহের পায়ের কাছে বসে কপাল চাপড়াচ্ছে একটা লোক। তাই দেখে পলাশ বলল, আহারে। দুলাল কাকার অবস্থাটা দেখ। বেচারা কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে গেছে। আর হবে না-ই বা কেন। মলয় বাবুর সবকিছু তো তিনিই দেখেশুনে রেখেছিলেন। 

ময়নাতদন্তে জানা গেল, তাকে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে। খুনি তার মুখে বালিশচাপা দিয়ে মেরেছে। মলয় বাবুর দেহটা যখন পুলিশের কাছ থেকে ফেরত এলো ততক্ষণে ঢাকা থেকে মলয় বাবুর স্ত্রী, প্রদীপ বাবু এবং অন্যান্য আত্মীয়রাও এসে গেছেন। তাদের কান্নাকাটি-আহাজারিতে ভরে উঠল চারদিক। এরই মধ্যে বিকেল নাগাদ গ্রামের শ্মশানে মলয় বাবুর শেষকৃত্য সম্পন্ন হলো। 

আত্মীয়স্বজন, পরিবারের লোকজন সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করল পুলিশ। জানা গেল, মলয় বাবু নিঃসন্তান ছিলেন। ধনসম্পত্তির কোনো অভাব ছিল না; কী গ্রামে, কী ঢাকায়, কী আমেরিকায়। পূর্বপুরুষেরা জমিদার ছিলেন। কিন্তু গাঁয়ের মায়া তার মধ্যে প্রবল ছিল। তাই বছরে অন্তত একবার কয়েকটা দিন গ্রামে এসে কাটিয়ে যেতেন। স্ত্রীর ডায়াবেটিসের বাড়াবাড়ি চলছিল বলে তাকে ঢাকায় রেখে এবারে একাই বাড়ি এসেছিলেন। 

জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে পুলিশ জেনেছিল উড়ো ফোন এবং মলয় বাবুর ঢাকার শান্তিনগরের বাড়ির সাবেক ভাড়াটে আরমানের কথা। পুলিশ আরমানের বর্তমান অবস্থান খুঁজে বের করল। সেটা শান্তিনগরের কাছেই রাজারবাগে। পাড়াপড়শির সঙ্গে কথা বলে তারা জানতে পারল, লোকটা রগচটা স্বভাবের। কথার শুরুতেই রে রে করে তেড়ে যায়। তবে নিধিরাম সর্দার ধরনের মানুষ। গর্জন বিরাট। কিন্তু অর্জন সামান্যই। পরিবারের লোকেরা তো বটেই পাড়াপ্রতিবেশিরা পর্যন্ত বুঝে গেছে তা। আর পরিবারের সদস্যরা কেউই তাকে পছন্দ করে না। তার জায়গা না আছে ঘরে, না আছে বাইরে। কোনো ভাড়া বাড়িতেই বেশিদিন টেকেনি।

মলয় বাবুর বাড়িতেও বেশ কয়েক মাসের ভাড়া বাকি থাকায় তাকে ওই বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। মলয় বাবুর সঙ্গেও অনিবার্যভাবে ঝগড়াঝাটি হয়েছে। পুলিশ ধরে আনল আরমানকে। সবকিছু শুনে আরমান হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, ফোনটা আমিই করেছিলাম। কিন্তু এ নিয়ে যে এত তুলকালাম হয়ে যাবে তা ভাবতে পারিনি। আসলে মলয় বাবু আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ায় আমি খুব ক্ষেপে ছিলাম তার ওপর। কিছুদিন আগে তাকে শান্তিনগর এলাকায় গাড়িতে দেখে বুঝেছিলাম তিনি দেশে এসেছেন।তিনি দেশে এলে যে ফোন নম্বরটা ব্যবহার করেন সেটা আমার জানা ছিল। আমার তো মেজাজের কোনো স্টেশন নেই। তাই তার ওপর রাগ ঝাড়তে ফোনটা করেছিলাম। বিশ্বাস করুন আমার কোনো বদ মতলব ছিল না।

পুলিশ তার কথা বিশ্বাস করল। কিন্তু এমনি এমনি ছাড়ল না। ভবিষ্যতে কিছু ঘটলে তাকে ধরে আনা হবে মর্মে অঙ্গিকারপত্রে সই করিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো তাকে। 

পুলিশ জানতে পারল, গ্রামে যাওয়ার আগের দিন মলয় বাবু তার বাংলাদেশের সব সম্পত্তি একমাত্র ভাগ্নে প্রদীপ বাবুকে লিখে দিয়ে গেছেন। এই খবরটা কে যেন মোবাইলে ফোন করে থানায় জানিয়েছিল। প্রদীপ বাবুর ব্যাপারে যাতে একটু খোঁজখবর নেয়া হয় সেব্যাপারেও থানাকে ওই ফোনেই জানানো হয়েছিল। মলয় বাবুর মৃত্যুতে প্রদীপ বাবুর স্বার্থ জড়িত আছে বিবেচনা করে পুলিশ কর্তারা নড়েচড়ে বসলেন। খবরটা ঢাকার পুলিশ দপ্তরে জানিয়ে দেওয়া হলো। এ নিয়ে পুলিশ দপ্তরে অনেক আলোচনা চলল। তারপর পুলিশ গিয়ে ধরে আনল প্রদীপ বাবুকে। প্রদীপ বাবু তো কেঁদেকেটে হয়রান। পুলিশ তাকে জিজ্ঞেস করল, মলয় বাবুকে লোক ভাড়া করে আপনি তো খুন করিয়েছেন। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী? পুলিশকে বললেন তিনি, আমার মামাকে খুন করাতে যাব কেন আমি? এ কী সম্ভব?

পুলিশ অফিসার বললেন, আপনি কেন খুন করাবেন সেটা পরে বলছি। তার আগে বলুন, আরও অনেক আত্মীয়স্বজন থাকতে হঠাৎ করে আপনাকেই কেন সম্পত্তি লিখে দিতে গেলেন? 

- মামার নিজের তো কোনো সন্তানাদি ছিল না। আমাকে তিনি সন্তানের মতোই দেখতেন। তিনি স্থায়ীভাবে আমেরিকায় থাকতেন। আমেরিকায় তার যে সহায়সম্পদ তা দিয়ে তার দিন কেটে যাবে চোখ বন্ধ করে। তবে দেশের সম্পত্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে তার চিন্তা ছিল। যখন তখন দেশে এসে সম্পত্তির দেখাশোনা তার পক্ষে কঠিন ছিল। তার আশঙ্কা ছিল উপযুক্ত মানুষের হাতে না পড়লে সেসব নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমার হাতে থাকলে তা যোগ্য মানুষের হাতেই থাকবে। এ-ই ছিল তার ধারণা। 

এবারে বলে উঠলেন পুলিশ অফিসার, তাহলে শুনুন আপনি কেন আপনার মামাকে খুন করিয়েছেন। মামার মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি সুবিধে তো আপনারই হয়েছে। আপনি ছাড়া এত সুবিধে আর কার হয়েছে? আপনি তো জমিদার বনে গেছেন। 

- কিন্তু তা তো মামা বেঁচে থাকতেই হয়েছি। উনি তো বেঁচে থাকতেই আমাকে সবকিছু লিখে দিয়ে গেছেন। সবকিছু পাওয়ার পরে কেন এই কাজ আমি করতে যাব? 

- করতে তো যাবেনই। কারণ লোভে পড়লে মানুষের হুঁশজ্ঞান থাকে না। লাভের লোভ লাফিয়ে চলে আকাশ পাণে। আপনি ভেবেছিলেন, বেঁচে থাকলে তো উনি দানপত্র বদল করে অন্য কাউকে লিখে দিতে পারেন। তাই সম্পত্তি যখন একবার লিখে নিতে পেরেছি, তখন বুড়োটাকে আর বাঁচিয়ে রেখে লাভ কী। হুঁ হুঁ প্রদীপ বাবু, আপনি চলেন ডালে ডালে আমরা চলি পাতায় পাতায়। 

খবরের কাগজে খবর প্রকাশিত হলো- ‘সম্পত্তির লোভে মামাকে খুন।’ চারদিকে ঢি ঢি পড়ে গেল। গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ল সেই খবর। রিংকুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওর মনের মধ্যে চলতে লাগল অস্থিরতা। ব্যাপারটা নিয়ে খুব ভাবল সে। 

খবরের কাগজে সংবাদটা ছাপা হওয়ার পরদিন সকালে মলয় বাবুর বাড়িতে গেল সে। সঙ্গে নিল বন্ধু পলাশকে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখল, বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। কেউ নেই। এমনকি দুলাল কর্মকার পর্যন্ত নেই; কিন্তু ও তো এই মানুষটার সঙ্গেই কথা বলতে চায়। জানতে চায়, মলয় বাবু তাকে ডাকতে বলেছিলেন কি-না। পাশেই মলয় বাবুর কাকার বাড়ি। সেই কাকা অবশ্য বেঁচে নেই। তবে তার ছেলেরা আছে। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানল, দুলাল কর্মকার বাড়ি চলে গেছে। মলয় বাবুই যখন নেই তখন সে আর থেকে কী করবে। তাছাড়া তার বেতনই বা কে দেবে। 

দুলাল কর্মকারের বাড়ি রামনগর। খুব বেশি দূরের পথ নয়। তাই পলাশকে নিয়ে সেখানেই গেল ও। দুলাল কর্মকার বাড়িতেই ছিল। পলাশকে দেখে চিনতে পারল সে। রিংকু নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, আপনার কথা আমি মলয় বাবুর কাছে শুনেছি। আপনাকে বোধ হয় উনি আমার নম্বর দিয়েছিলেন ফোন করার জন্য।

লোকটা উদাস হয়ে সামনের গাছটার দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর ঠা-া গলায় বলল, আর সেসব কথা বলে কী লাভ। যা গেছে তা তো গেছেই। কিন্তু প্রদীপ বাবু এটা কী করলেন? ছি. ছি. ছি.। মানুষ এত খারাপও হতে পারে? আপন মামাকে কেউ খুন করতে পারে? 

- উনি কি নিজে খুন করেছেন? 

- ওই একই কথা। চালাক মানুষ, তাই অন্য কাউকে ভাড়া করেছিলেন। 

- সেই অন্য কেউটা কে হতে পারে? 

- দেখ, গ্রামের লোক তো অত পাকা খুনি হতে পারে না। তাই হত্যাকারী নিশ্চয় ঢাকা থেকে এসেছিল। 

- আপনার কাউকে সন্দেহ হয়? তার নাম তো পুলিশকে জানানো দরকার। 

- সন্দেহ তো আমার হয়ই। তাই আমি পুলিশকেও জানিয়েছি। আমাকে যখন জিজ্ঞেস করল, কাউকে সন্দেহ হয় কি-না ; তখনই আমি বলে দিয়েছি। 

‘কে সেই নরাধম, ’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল পলাশ। 

‘শয়তানটার নাম বিটু। প্রদীপ বাবুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। মলয় বাবুর স্ত্রীর শরীর খারাপ বলে তিনি একাই বাড়ি আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তখন তার দেখাশোনা এবং যাত্রাপথে সঙ্গি হবার কথা বলে প্রদীপ বাবুই তার সঙ্গে জুটিয়ে দিয়েছিল খুনিটাকে। 

- কিন্তু প্রদীপ বাবু তো শিক্ষিত মানুষ। তাছাড়া মলয় বাবুর সম্পত্তিও তিনিই পেয়েছিলেন। নিজের আর্থিক অবস্থাও ভালো। এমন একজন মানুষ.... 

রিংকুকে থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করল দুলাল কর্মকার, আরে রাখ তো তোমার শিক্ষা। শিক্ষা কী আর বই পড়লেই হয় নাকি। মানুষ হতে পারলেই প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া যায়। উনি সব সম্পত্তি লিখে নেওয়ার পরও কোন লোভে খুনটা করেছিলেন সেসব কাহিনি তো খবরের কাগজেই ছাপা হয়েছে। পড়নি তুমি? 

- হ্যাঁ, পড়েছি তবে বিটু নামের লোকটার কথা তো পড়িনি। 

- পড়বে, পড়বে। ওর নামও পড়বে। আমি তো বলেই দিয়েছি পুলিশকে। পারলে তোমরাও বলে দাও না। 

- ঠিক আছে। আচ্ছা, মলয় বাবুর কাছে কি দামি কোনো কিছু ছিল, যা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যে ডাকাতির মতো কিছু ঘটার সম্ভাবনা ছিল?

- মূল্যবান কিছু? ডাকাতি? না, না। মূল্যবান আবার কী থাকবে? নারী হলে না হয় গয়নাগাটি থাকত। আর ডাকাতির কথা বলছ? আমি তো বাড়িতেই ছিলাম। ডাকাতি হলে টের পেতাম না? 

- তা, মলয় বাবুর বাড়ির চাকরিতে তো আপনি বোধ হয় আর যাচ্ছেন না। এখন কি অন্য কিছু করবেন বলে ঠিক করেছেন?

- কী আর করব বল। জমিজমাও খুব বেশি নেই যে চাষবাস করে খাব। তাছাড়া বাপ- ঠাকুর্দারা সবাই করতেন সোনারূপার ব্যবসা। বাজারে তাদের দোকান ছিল। আমি সেই ব্যবসা ধরে রাখতে পারিনি। সেটা অবশ্য আমারই দোষে। জুয়োখেলার নেশায় পড়ে ব্যবসার পুঁজি খুইয়ে পথে বসেছিলাম। মিথ্যে কথা বলব না, খবর পেয়ে মলয় বাবুই উদ্ধার করেছিলেন আমায়। সেই থেকে ছিলাম সেখানেই। আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে কিছু টাকাপয়সা উনি আমাকে দিয়েছিলেন। ভাবছি তাই নিয়ে আর কিছু ধারদেনা করে একটা দোকান দেব।

দুলাল কর্মকারের বাড়ি থেকে ফিরে এলো ওরা। তবে তার একটা কথা ফলে গেল হাতেহাতেই। বিটু নামের লোকটার গ্রেফতার হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল মানুষের মুখে মুখে। লোকটাকে গ্রামের লোকেরা কেউই চিনত না। তার বাড়িও এই এলাকায় নয়। তবে প্রদীপ বাবুকে চিনত সবাই। তাই বদনাম যা হওয়ার তা প্রদীপ বাবুরই হলো। ওদিকে দুলাল কর্মকার ব্যবসা করার জন্যে শহরে চলে গেল। 

এরই মধ্যে মলয় বাবুর মোবাইল নম্বরটায় কল দিয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ঠিকানা জোগাড় করল রিংকু। তারপর পলাশসহ শহরে গিয়ে দুলাল কর্মকারের দোকান দেখে এলো। এরপর মাকে বলল, আমার একটু ঢাকায় যাওয়া দরকার। 

অবাক হয়ে মা বললেন, কেন বাবা? সেদিনই না এলি? তাছাড়া তোর ছুটি তো ফুরিয়ে আসছে ক্রমেই। তুই তো কদিন পরে এমনিতেই চলে যাবি। 

- তা তো ঠিকই মা। কিন্তু আমার যাওয়া খুব দরকার। কারণটা ঘুরে এসেই বলছি। তবে বেড়ানোটাকেও তো একটা কারণ হিসেবে ধরে নিতে অসুবিধে নেই। মোটে এক বা দু'দিনের জন্যে আমায় যেতে দাও। কাল ভোরেই যাব। সঙ্গে পলাশকেও নেব। পলাশ ওর মা-বাবাকে রাজি করিয়েছে। তুমি না করতে পারবে না। বাবাকেও কিন্তু রাজি করাবে তুমি। 

শুনে বাবা প্রথমে রেগে গেলেও পরে মায়ের কথায় শান্ত হলেন। বললেন, বেশ। দুই বন্ধুতে মিলে চাচার বাসায় বেড়াতে যখন যেতেই চায়, তখন যাক। 

ঢাকায় পৌঁছেই ওরা সোজা চলে গেল মলয় বাবুর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। মলয় বাবুর মৃত্যুর পর থেকে তিনি ঢাকায় তার ভাইয়ের বাড়িতে থাকছেন। সেখানেই তার সঙ্গে দেখা করল ওরা। রিংকু তাকে জিজ্ঞেস করল, মলয় বাবু যখন বাড়িতে গেলেন তখন সঙ্গে খুব দামি কিছু কি ছিল? তার সঙ্গে টাকা-পয়সা কেমন ছিল? 

জবাবে তিনি জানালেন, আলাদাভাবে দামি জিনিস তো আর সঙ্গে নেননি। সঙ্গে যা থাকে তা-ই ছিল। আর ব্যাংক থেকে তোলা লাখ দশেক টাকা ছিল। নগদ টাকায় কিছু কিছু দান দক্ষিণার ইচ্ছে ছিল। 

- সঙ্গে কী ছিল?আর দান দক্ষিণা কি কিছু করতে পেরেছেন?

- গলায় একটা রূপোর চেন আর হাতে একটা হীরের আংটি ছিল। ওনার পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচিহ্ন সেটা। আর দান দক্ষিণার কথা আমি জানার সুযোগ পেলাম কোথায়?

- চেন আর আংটি কি ফেরত পেয়েছেন?

- চেনটা পুলিশের লোকেরা দিয়েছে; কিন্তু ওসবের আমার আর দরকার কী? 

কথা বলতে বলতেই কেঁদে ফেললেন তিনি। রিংকু বুঝল, কম মূল্যের চেনটা পেলেও বহুমূল্য হীরের আংটিটা তিনি পাননি। ওই পরিস্থিতিতে প্রদীপ বাবু কিংবা বিটু নামের লোকটার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগই পেল না ওরা। 

এরপর ওরা গেল প্রদীপ বাবুর ফ্ল্যাটে। ও-বাড়ির সবাই এক কঠিন অবস্থায়। ঘরে থাকলেও তাদের মনে অশান্তি। আর বাইরে গেলে লোকের গঞ্জনা। শুধু প্রদীপ বাবুর জন্যেই নয়, বিটুর জন্যও তারা চিন্তিত। খুব বিশ্বস্ত কর্মচারী। তাছাড়া ওদের পরিবারেরই একজন যেন ছিল সে। এখন খুনের দায় নিয়ে পুলিশের হেফাজতে। তবে মলয় বাবুর কথাও তারা ভুলতে পারছে না কিছুতেই। 

এইসব করে কাকার বাড়িতে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। উনিও ততক্ষণে ফিরেছেন। কাকার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা বলেই ও আবার ছুটল মলয় বাবুর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে।

ওদেরকে আবারও ফিরে আসতে দেখে তিনি অবাক হয়ে বললেন, তোমরা? কোনো বিশেষ দরকার আছে? 

- হ্যাঁ, খুবই জরুরি প্রয়োজন। মলয় দাদুর হত্যাকা-ের ন্যায়বিচার এবং প্রকৃত খুনির শাস্তির জন্যে আপনার একটু সাহায্যের খুব প্রয়োজন। আপনি কি দয়া করে এই সাহায্যটুকু করবেন? 

- আরে বলছ কী তোমরা? নিশ্চয় করব। আমার চাওয়াপাওয়া বলতে তো এখন একটাই। 

- তাহলে আপনাকে এক্ষুণি আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। 

- কোথায়?

- বনোয়ারীনগরে। 

- হঠাৎ ওখানে? তাছাড়া বিনা প্রস্তুতিতে এই রাতের বেলায়... 

- হ্যাঁ, এক্ষুণি যেতে হবে। কারণ মোক্ষম সময় এটাই। কারণ দেরি হলে পাখি উড়ে যেতে পারে, পালের গোদা পগার পার হতে পারে। আর যেতে কোনো সমস্যা হবে না। আমার কাকা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সে গাড়িতেই এসেছি। তার আগে একটা ছবি আপনাকে দেখাই। আমার মোবাইলে তোলা। 

 ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বেরিয়ে পড়ল ওরা। আর মাঝ রাতের আগেই বনোয়ারীনগরে পৌঁছে সোজা থানায় উপস্থিত হলো। রিংকুর অনুরোধে ওর কাকা আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন পুলিশকে। রিংকু ওর মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় তোলা একটি ছবি পুলিশ অফিসারকে দেখিয়ে বলল, এই ছবিটা যার তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই খুব বড় একটা কাজ হবে। ছবির লোকটার হাতের আংটিটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সব রহস্য। নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। সামান্য একটু আঁচ করতে পারলেও পালিয়ে যাবে লোকটা। 

মধ্যরাতেই চলল অভিযান। শহর থেকে সন্ধের দিকে বাড়ি এসেছে দুলাল কর্মকার। সেখান থেকেই পাকড়াও করা হলো তাকে; কিন্তু আংটিটা তার কাছে পাওয়া গেল না। জিজ্ঞাসাবাদের শুরুর দিকে সে বলল যে, অমন কোনো আংটির কথা সে জানেই না। গম্ভীর হয়ে বলে উঠল রিংকু, ওই আংটি পরা আপনার ছবি আমি তুলেছি। আপনি প্রকাশ্যে আংটিটা পরে দোকানে বসে ছিলেন। ছবিটা থানার ওসি সাহেবও দেখেছেন। ওই আংটি যে আপনার কাছেই আছে তার আরো প্রমাণ আছে। আমি একা নই, আরও যারা দেখেছে তাদের সাক্ষাৎকারও আমি রেকর্ড করে রেখেছি। এখন আপনি যতই অস্বীকার করেন না কেন, এই সত্য লুকোনোর সাধ্য আপনার নেই। এবারে বলুন, আপনার হাতে ওই আংটি গেল কী করে? ওটা তো মলয় বাবুর খুব প্রিয় আংটি ছিল। সব সময় হাতে রাখতেন তিনি। মলয় বাবুর স্ত্রী এখানে আছেন। তার কাছেই একথা জেনেছি আমি। 

গজরাতে গজরাতে জবাব দিল দুলাল কর্মকার, ওনার জিনিস উনি কি কাউকে দিতে পারেন না? ধরে নিন উনি আমাকে দিয়েছেন। 

- এটা ধরে নেয়া যায় না। এই জিনিসটা ওনার খুব প্রিয়। উনি এটা আগেও কাউকে দেননি। এটা সবচেয়ে বেশি জানেন ওনার স্ত্রী। তার কাছেই আমরা এটা জেনেছি। কাজেই ওটা আপনি দানসূত্রে পাননি, পেয়েছেন দখলসূত্রে। 

- না, না। দানসূত্রেই পেয়েছি। 

একথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন পুলিশ অফিসার। বললেন, আর বলতে হবে না। আমরা বুঝে গেছি। আপনি নিজের অজান্তেই স্বীকার করে নিয়েছেন যে, আংটিটা আপনার কাছেই আছে। এবারে বলুন, কোথায় আছে? 

দুলাল কর্মকার এবারে থমকে গেল। উত্তর হাতড়াতে লাগল মনে মনে। কিন্তু জবাব খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইল। 

এবার মুখ খুললেন মলয় বাবুর স্ত্রী, গ্রামে আসার পর এক দিনই বেঁচে ছিলেন তিনি। ওই দিন তিন বার তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। একবারও তিনি বলেননি যে, আংটিটি তোমাকে দেবেন। বরং তোমাকে একমাসের বেতন আগাম দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। এখন শুনছি তুমি নাকি বলে বেড়াচ্ছ, উনি তোমাকে ব্যবসা করার টাকা দিয়েছেন। তোমার এই কথা ডাহা মিথ্যে। 

এবারে ঘাড় সোজা করে বলল রিংকু, ওই টাকা আর আংটি আপনি মলয় দাদুকে খুন করেই পেয়েছেন। বলুন ঠিক কি-না। মলয় দাদু যে টাকা এনেছিলেন তা তিনি বিলি করার সুযোগই পাননি। নিশ্চয় উনি বিশ্বাস করে আপনাকে টাকার কথা বলেছেন। তাছাড়া বিতরণ করার সময় আপনার সাহায্য তো খুবই দরকার ছিল, সেকারণেও তিনি নিশ্চয় আপনাকে জানিয়েছেন। আর আপনি বিশ্বাসভঙ্গ করে টাকার লোভে তাকে খুন করেছেন। সেই টাকায় দোকান খুলেছেন।

ওই টাকা আর আংটির তুলনায় চেনটার দাম সামান্য বলে এবং লোকের যাতে সন্দেহ না হয় সেজন্যে চেনটা নেননি। মৃতদেহ দেখার সময়ই আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে আংটিটা নেই। অথচ ঢাকার বাসায় ওই আংটি আমি দেখেছিলাম। ওটা ছিল তার পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচিহ্ন। হীরে বসানো ওই আংটির দাম অনেক ছিল। তবে তার চেয়েও বড় কথা, ওটা তার বংশের ধারাবাহিকতার চিহ্ন এবং সৌভাগ্যেরও প্রতীক। তাই ওই আংটি তিনি হাতছাড়া করেননি কখনো। কব্জা করার পর কয়েকদিন ওটা লুকিয়ে রেখে যেইনা দেখলেন যে, বিটু আর প্রদীপ বাবু ফেঁসে গেলেন, আপনার ওপর কারো কোনো সন্দেহই নেই অমনি আপনি আংটিটা পরার সাহস দেখালেন। তখনই আংটিটি আঙুলে লাগিয়েকুসংস্কারের বশে আপনিও নিজেকে সৌভাগ্যবান হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন। 

- না, না। আর যা-ই করিনা কেন, খুন আমি করিনি। 

গর্জে উঠল রিংকু, তাহলে কে খুন করল?

- গোপালনগরের রাজন। খুনের জন্যে সে দু’লাখ নিয়েছে। কাজেই মলয় বাবুর সব টাকা আমি পাইনি। আর আংটিটাও রাজনের বাড়িতেই আছে। সে আমাকে চাপ দিয়েছিল যে, যদি ওই আংটিটা তাকে না দিই তাহলে সে ওই আংটির সূত্র ধরে আমাকে খুনের দায়ে ফাঁসিয়ে দেবে। তাই শেষ পর্যন্ত আংটিটা আমি তাকে দিয়ে দিতে বাধ্য হই। কত বড়ো বেইমানি করল সে আমার সঙ্গে! অথচ খুনের পর আমিই ফোন করে থানায় জানিয়েছিলাম যে, মৃত্যুর আগে মলয় বাবু তার সম্পত্তি প্রদীপ বাবুকে লিখে দিয়ে গেছেন। এই ঘটনার পর পুলিশের সব সন্দেহ গিয়ে পড়ে প্রদীপ বাবুর ওপর। আর রাজন হয়ে যায় ধোয়া তুলসীপাতা। 

- কিন্তু রাজনটা আবার কে? 

পলাশ চেঁচিয়ে উঠল, চিনি। আমি চিনি তাকে। আমার মামাবাড়ির কাছেই বাড়ি। 

এরপর খুব দ্রুতই ঘটে গেল ঘটনাগুলো। রাজনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে হীরে বসানো আংটিটা উদ্ধার করল পুলিশ। গ্রেফতারও করল তাকে। তবে নগদ টাকা তেমন পাওয়া গেল না। ওদিকে আংটিটা দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন মলয় বাবুর স্ত্রী, আরে এটাই তো সেই আংটি। 

পুলিশের জেরায় সব দোষ স্বীকার করল দুলাল আর রাজন। থানার পুলিশ অফিসার আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন, আমার গোটা চাকরি জীবনে এই ছেলের মতো বাহাদুর গোয়েন্দার দেখা পাইনি। মধ্যরাতে এমন নাটকীয় রহস্যভেদও আর দেখিনি। এবারে মামলার নথিপত্র সাজানো হবে নতুন করে। শিগগিরই মুক্তি পাবেন প্রদীপ বাবু আর বিটু। 

সারা রাতের দক্ষযজ্ঞের পর রিংকুরা যখন থানা থেকে বেরিয়ে এলো তখন পুবের আকাশ লাল হয়ে গেছে। সবাইকে নিয়ে রিংংকু যখন বাড়ি ফিরল, তখনতো সবাই হতবাক। পুরো ঘটনাটা খুলে বললেন মলয় বাবুর স্ত্রী। সবকিছু শুনে রিংকুর বাবা বললেন, এ-ও কী সম্ভব? 

রিংকুর মা এসে জড়িয়ে ধরলেন রিংকু আর পলাশকে। বললেন, আমার ছেলেরা এই অসাধ্য সাধন করেছে। 

মায়ের চোখে তখন জল। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh