করোনা-দুর্যোগে কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে

আলমগীর খান

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২০, ০৬:৩৫ পিএম

করোনাভাইরাসের আক্রমণ সারা বিশ্বকে থমকে দিয়েছে আর শিগগিরই এ থেকে উত্তরণ আশা করা কঠিন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কারণেও বাংলাদেশের মানুষ ব্যাপক দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে। করোনায় সংক্রমণ বিস্তার ও মৃত্যু ছাড়াও মানুষের জীবনে হানা দিয়েছে বেকারত্ব, খাদ্যের অভাব, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, বিভিন্ন রোগ ও অসুস্থতায় উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবসহ অনেক কিছু।

গত ৬ মে গার্ডিয়ান পত্রিকায় নোবেল পুরস্কারবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক নিবন্ধে লিখেছেন, “অনেক জায়গায় লকডাউনের ফলে মানুষের দুর্গতি এখন স্পষ্ট হচ্ছে। শিশুরা টিকা পাচ্ছে না ও ফসল ঘরে উঠছে না। নির্মাণকাজ যখন থেমে গেছে আর বাজার বন্ধ, চাকরি ও আয় তখন উধাও। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় দীর্ঘস্থায়ী কোয়ারেন্টিন ভাইরাসের মতোই ক্ষতি সাধন করতে পারে।”

এ পরিস্থিতিতে সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যাতে বিস্তার লাভ না করে এবং দরিদ্র ও অসহায় মানুষ যাতে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে এ সংকট মোকাবিলা করতে পারে। তবে কাজটি খুবই কঠিন এবং সবার সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রয়োজন। সরাসরি করোনা সংক্রমণজনিত স্বাস্থ্যসমস্যা মোকাবিলা করা ছাড়াও এ সময়ে সহযোগিতা নানামুখী হতে পারে। 

ইতোমধ্যে দেশের বেশিরভাগ উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ড বিশেষ করে পোশাক শিল্প কভিড-১৯-এর বিরাট ধাক্কা অনুভব করেছে। তারপরও আমাদের দেশের মানুষ এসব ধাক্কা কিছুটা সামলাতে পারবে যদি অন্তত আমাদের কৃষির চাকা সচল থাকে। সরকারও তাই এ সময়ে খাদ্য সংকট ও ক্ষুধা মোকাবিলার জন্য অব্যাহত কৃষি উৎপাদনের ওপর ভরসা করছে। তবে খাদ্যসংকট মোকাবিলায় কৃষি উৎপাদন ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য কৃষকের কাছ থেকে সর্বত্র পৌঁছানো এবং দরিদ্র ও অসহায় মানুষের তা পাওয়া নিশ্চিত করা। করোনা সংকট সফলভাবে মোকাবিলার জন্য অনেক কিছুর মধ্যে এটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রীও বলেছেন যে, করোনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষিপণ্যের বিপণন এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ১৬ মে  কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনলাইনে মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের শাকসবজি ও মৌসুমি ফলসহ কৃষিপণ্যের পরিবহন এবং বাজারজাতকরণে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারছে না। বড় শহরের বাজারে ক্রেতার আগমন প্রায় না থাকায় ও জনগণের আয় হ্রাস পাওয়ার কারণে বাজারে কৃষিপণ্যের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে, ফলে পাইকার ও আড়তদাররা কৃষিপণ্য ক্রয়ে আগ্রহ হারাচ্ছে। কৃষিপণ্য পরিবহন শেষে ট্রাক খালি ফেরার আশঙ্কায় ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে বেশির ভাগ উৎপাদিত ফল ও সবজি।

এ ক্ষেত্রে করণীয় কী? কৃষি উৎপাদনের সাফল্য ধরে রাখা, প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য দেশের সর্বত্র পৌঁছানো এবং সর্বশ্রেণির মানুষের জন্য তা কেনা ও পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ ও এ সময়ে খুব কঠিন কাজ। এনজিওরা সমন্বিতভাবে ও সরকারের সাথে এক্ষেত্রে কিছু কাজ করতে পারে। গ্রামে কৃষকের মাঝে সিদীপের (সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইনোভেশন অ্যান্ড প্র্যাকটিসেস) একটি উদ্যোগে এমনই একটা নমুনা দেখা যায়।            

এবার নাটোর জেলার গুরুদাসপুরে কয়েকটি গ্রামে বাঙ্গি ও রসুনের ভালো ফলন হয়েছে। এ জেলার বনপাড়ায় অনেকে পেয়ারা চাষ করেন ও সেখানে এর ভাল ফলন হয়েছে। পাবনা জেলার সাঁথিয়া, আমিনপুর ও সুজানগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পেঁয়াজের ফলন ভালো। এ জেলায় বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে চালকুমড়া চাষ হয়। এসব কৃষকের অনেকে এনজিওটির কাছ থেকে এসএমএপি প্রকল্পে ঋণ গ্রহণ করেছেন। প্রত্যেক বছর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ভৈরব, সিলেট, বগুড়া, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলা হতে বেপারি এসে ট্রাক ভর্তি করে এসব কৃষিপণ্য কিনে নিয়ে যান। কিন্তু এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকটে কৃষকরা তাদের ফসল বিক্রি করতে যথেষ্ট সমস্যায় পড়েছেন।

এমন পরিস্থিতে এনজিওটির স্থানীয় কর্মীরা বেপারিদের সাথে ও ট্রাক ড্রাইভারদের সাথে যোগাযোগ করেন। এখন প্রতিদিন গুরুদাসপুর থেকে ২০/২৫টি ট্রাক নিয়মিত বাঙ্গি বহন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। বনপাড়া থেকে ৮/১০টি ট্রাক নিয়মিত পেয়ারা নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। পাবনার এই গ্রামগুলো থেকে পেঁয়াজ ও চালকুমড়া বিক্রি হয়ে প্রতিদিন ২/৩টি ট্রাকে করে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

সংস্থাটির এরূপ উদ্যোগের ফলে একইভাবে গাজীপুরে মাওনায় কয়েকটি গ্রামে ডিম ও দুধ উৎপাদনকারী, কুমিল্লার মাধাইয়ায় দুগ্ধ-খামারি ও নিমসারে ডিম-উৎপাদনকারী ক্ষুদে উদ্যোক্তারা আশার আলো দেখতে পেয়েছেন। তারা এখন ন্যায্যমূল্যে তাদের উৎপাদিত পণ্য পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে পারছেন। ট্রাকচালকদের সহায়তায় সেগুলো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাচ্ছে। এর ফলে উপকৃত হচ্ছেন উৎপাদনকারী, পাইকার, ট্রাকশ্রমিক, ভোক্তাসহ সবাই।

দেখা যাচ্ছে কারো এমন সামান্য উদ্যোগ কৃষককে সঠিক সময়ে ন্যায্য মূল্য পেতে সাহায্য করে এবং তাদেরকে হতাশার হাত থেকে রক্ষা করে। কৃষিপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করে। উৎপাদনস্থল থেকে ঘাটতি এলাকায় খাদ্য ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পৌঁছে দিতে কাজ লাগে। এ সময়ে কৃষকের সাথে বিক্রেতা ও ভোক্তার যোগাযোগ তৈরি করে দেয়া একটা জরুরি কাজ। গ্রাম এলাকায় যোগান এবং শহর ও উপশহর এলাকায় চাহিদার মাঝে ভারসাম্য স্থাপন এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। না হলে অনেক কৃষকের যেমন মাথায় হাত পড়বে, গ্রামে ও শহরে অনেক মানুষই তেমনি সরবরাহের অভাবে তা ন্যায্যমূল্যে পাবে না, যা দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনবে। 

আরো বিভিন্ন রকম কৃষিপণ্য এবং অন্যান্য উৎপাদিত দ্রব্যের বেলায়ও এ ধরনের উদ্যোগ করোনা সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এনজিওসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সরকারের সাথে একত্রে এ ধরনের আরো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন, যা করোনা-দুর্যোগ মোকাবিলায় কিছু ভূমিকা রাখবে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপসহ সবার সহোযোগিতায় একত্রে দ্রুত এ গভীর সংকট থেকে উত্তরণ লাভ করা যাবে।


আলমগীর খান

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh