খান মোহাম্মদ রবিউল আলম
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২০, ০৩:১২ পিএম
খান মোহাম্মদ রবিউল আলম।
আব্দুল লতিফ খান ওরফে ঝড়ু ভাই ওরাল হিস্ট্রি চর্চায় এক গ্রাম্যবীর। তার ছিল প্রখর স্মৃতিশক্তি আর স্থানীয় ইতিহাসের ক্রমিক বিবরণে বিশেষ উৎকর্ষ। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার গল্প শুনতাম। তিনি তরুণদের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করতেন। কথা বলতেন, দেশভাগ, জমিদারি প্রথা, মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক সর্ম্পক, স্থানীয় এলিটদের শানশওকত, অভাব-অভিযোগ, কোট-কাছারি, মামলা-মোকদ্দমা, দুর্যোগ ও মহামারি নিয়ে।
তিনি স্বশিক্ষিত ছিলেন। পেশায় কৃষিজীবী। অবাক লাগে কীভাবে স্মৃতির পরতে পরতে সাজিয়ে রেখেছিলেন স্থানীয় ইতিহাসের বর্ণিল সব অধ্যায়। ঝড়ু ভাইয়ের একটি মুদ্রাদোষ ছিল, তিনি যেকোনো গল্প শুরু করতেন ‘সেই বছর দিয়ে’। সময়ের ব্যাপারটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন এবং পরে তা সুনির্দিষ্ট করতেন।
তিনি ছিলেন ত্রিকালদর্শী। বৃটিশ, পাকিস্তানী ও বাংলাদেশ অধ্যায় দেখেছেন। ঝড়ু ভাই জমিদারি ব্যবস্থার ওপর পরিছন্ন ধারণা রাখতেন। বিশেষত তালন্দ-এর ললিত মোহন ও আনন্দ মোহনের জমিদারি ব্যবস্থার ওপর গল্প শুনে আমাদের শৈশবের সোনালী দিন কেটেছে। তিনি নাধাই স্টেটের জমিদার ঝড়ু বাবুর বিরত্বগাথা ও পতন ইতিহাস শোনাতেন। বিরত্বগাথা পর্বে তিনি সজীব থাকতেন এবং পতন পর্বে তিনি মলিন হয়ে পড়তেন।
তিনি সবসময় গল্প করতেন না। তার গল্প বলার বিশেষ ক্ষণ ছিল। যেমন ধরুন-বাদলের ঝর ঝর বৃষ্টি। আমাদের বৈঠকের বারান্দায় পেতে রাখা বেঞ্চে বসে তিনি গল্প শুরু করলেন। তিনি মূলত নন-ফিকশন স্টোরিটেলার। বাস্তবধর্মী স্থানীয় ইতিহিাস চর্চায় জীবনভর কাটিয়েছেন। এটি ছিল তার ব্যক্তিগত চর্চা। এর কোনো বিনিময় মূল্য ছিল না।
পার্থ চট্টপাধ্যায় ইতিহাসের উত্তরাধিকার অথবা নিম্নবর্গের ইতিহাস বই-এ উল্লেখ করেছেন, ১৮ শতকে বাংলায় কথোপোজীবী শ্রেণির নামে এক বিশেষ শ্রেণির বিকাশ ঘটে। তারা গল্প বলে আয়-রোজগার করতেন। তাদের আয় নাকি এতো বেশি ছিল যে শাসকগোষ্ঠী কথকদের ওপর ট্যাক্স বসিয়েছিলেন। আমরা ঝড়ু ভাইয়ের কাছ থেকে স্থানীয় ইতিহাসের পাঠ নিয়েছি বিনে পয়সায়।
এ বিবর্ণ দিনে গুটি বসন্তের মহামারি নিয়ে ঝড়ু ভাইয়ের শোনানো গল্পের কথা মনে পড়ে। তিনি এ মহামারিকে বলতেন মড়ক। ঘটে ১৯৫২-৫৩ সালের দিকে। সমসাময়িক সময়ে কলেরার প্রকোপও ছিল তীব্র।
বলতেন, গ্রামের পর গ্রাম বিরাণ হয়েছে। প্রতিটি গ্রামে নতুন কবর। মহামারির এক বিশেষ উপহার নতুন নতুন কবর। মড়কের সময় ব্যক্তি সম্পর্কগুলো কাঁচের গ্লাসের মতো ভেঙ্গে গেল। কেউ কাউকে চেনে না। চিকিৎসা উন্নত ছিল না। ঝাড়-ফুঁক, তুকতাক এবং গাছ-গাছড়া নির্ভর চিকিৎসা ছিল অবলম্বন।
ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছিল। তবে তা স্থানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। সে দুর্দিনে সামনে ছিল কেবল ঘনঅন্ধকার। কোনো সম্ভাবনা ছিল না বেঁচে থাকার। বলেই তিনি গেঞ্জি সরিয়ে বুকের ওপর থাকা গুটি বসন্তের ক্ষতচিহ্ন দেখাতেন। বলতেন, আমাদের বয়সী অনেকে নেই। আমরা আছি। আরও বলতেন-মড়কের সময় নিশ্চিত মৃত্যুর আশংকা থাকার পরও অনেকে বেঁচে যান। কীভাবে বেঁচে যান জানি না।
ওয়াল্টওমিটার ও জনহপকিন্স সাইটে বিশ্ব করোনা পরিস্থিতি দেখছি আর ঝড়ু ভাইয়ের গল্পের শেষ কথাগুলো কানের কাছে গুণগুণ করে বাঁজছে। অনেকে বেঁচে যান। কীভাবে বেঁচে যান জানি না।
লেখাটি যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ খান মোহাম্মদ রবিউল আলমের ফেসবুক থেকে নেয়া হয়েছে।