হাসান শাওন
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০১৯, ১১:০৯ পিএম
পৃথিবীর ক্ষয় রোগ শনাক্ত করে জীবনানন্দ দাশ শতবর্ষ আগে লিখেছিলেন,
‘দূরে কাছে কেবলি নগর, ঘর ভাঙে;
গ্রামপতনের শব্দ হয়;
মানুষ ঢের যুগ কাটিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে,
দেয়ালে তাদের ছায়া তবু
ক্ষতি, মৃত্যু, ভয়,
বিহ্বলতা বলে মনে হয়।’
যে প্রযুক্তির ওপর ডানা মেলে অত্যাধুনিক সভ্যতা, সেই প্রযুক্তিই এখন বুমেরাং হয়ে আঘাত করছে মানুষের যাপনে। আক্রান্ত হচ্ছে প্রকৃতি আর তাকে আশ্রয় করা মানুষ। পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতি-মানুষের সাম্প্রতিকতম হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় ই-ওয়েইস্ট বা ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য (ই-বর্জ্য) সমস্যাকে।
ই-বর্জ্য বলতে মূলত বোঝানো হয় পরিত্যক্ত বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বা যন্ত্রপাতিকে। ভোক্তার বাসাবাড়ি বা শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত হয়ে কার্যক্ষমতা হারানো বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, যেমন- মোবাইল ফোন, ফ্রিজ, ক্যামেরা, মাইক্রোওয়েভ, কাপড় ধোয়ার ও শুকানোর যন্ত্র, টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সোলার প্যানেল ইত্যাদিকে সাধারণভাবে ই-বর্জ্য বলা হয়।
বিশেষ এ বর্জ্যরে প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো- এটি অপচনশীল ও মারাত্মক দূষণ সৃষ্টিকারী। ই-বর্জ্যরে মধ্যে অনেক বিষাক্ত পদার্থ ও রাসায়নিক যৌগ আছে, যা রোদে ও তাপে বিভিন্নভাবে বিক্রিয়া করে। অনেক সময় রোদে ফেলে দেওয়া ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (আইসি) থেকে নির্গত হয় ক্ষতিকর বিকিরণ। এই বর্জ্য এতোই ভয়াবহ যে, এর প্রভাবে ভূমিষ্ঠ হতে পারে প্রতিবন্ধী শিশু। এই ই-বর্জ্য পানিতে ফেলে দিলে ও মাটিতে পুতে রেখে দেওয়ার পরও দূষণ থেমে থাকে না। অনেকের মতে, ই-বর্জ্য প্লাস্টিক বর্জ্যরে চেয়েও বেশি ক্ষতি করছে ধরিত্রীর।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ই-বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ৩০ মিলিয়ন ব্যক্তিগত কম্পিউটার ই-বর্জ্যরে আওতায় পড়ে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মোবাইল ফোন অব্যবহার্য হয়ে ই-বর্জ্যে পরিণত হয়। ই-বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে চীন থেকেও। সম্প্রতি ই-বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়তে থাকায় জাতিসংঘও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সর্বনাশ টের পেয়ে ইলেক্ট্রনিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই নিজেদের যন্ত্রাংশ পুন:উৎপাদন (রিসাইক্লিং) করছে। তবে বর্জ্য তৈরির তুলনায় রিসাইক্লিং-এর সংখ্যা নগণ্য।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও দ্রুতগতিতে বাড়ছে ই বর্জ্যরে পরিমাণ। সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘রাজধানীতে ২০১৬ সালে এক লাখ ৪২ হাজার মেট্রিক টন ই-বর্জ্য বের হয়েছে। এর মধ্যে বড় একটি অংশই মোবাইলের ই-বর্জ্য। যা আগামী ২০২১ সালে প্রায় এক লাখ ১৭০ হাজার টনে পৌঁছাবে।’
তবে বেসরকারি সংস্থা এনভাইরনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন (ইএসডিও) পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বছরে ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে প্রায় তিন মিলিয়ন মেট্রিক টন। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে এ বর্জ্যরে পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। শুধু ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক পণ্য নয়। বাংলাদেশে ই-বর্জ্যরে অন্যতম বড় উৎস হলো চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙা শিল্প। এখানে একটি জাহাজের সঙ্গে অসংখ্য রকম বৈদ্যুতিক যন্ত্র আসে। এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ লক্ষ্য করা যায় না।
শুধু এখানেও শেষ নয়। ই-বর্জ্য যন্ত্রাংশ নিয়ে যেসব কারখানা গড়ে উঠছে, সেখানে কাজ করছে শিশু শ্রমিকরা। দূষণ থেকে বাঁচার জন্য কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাদের জন্য নেই। এটি সুস্পষ্টভাবেই শ্রম আইনের লঙ্ঘন। এ নিয়ে শিশু অধিকার বিষয়ে সক্রিয় সংগঠনগুলোর আলাদাভাবে দাবি তোলা উচিত বলে মনে করেন অনেকে। দূষণে কাটানো শৈশব থেকে ওই শিশুদের বাঁচাবে কে? এর উত্তর জানা নেই কারও।
বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক আন্তর্জাতিক ভেসেল কনভেনশনে স্বাক্ষর করছে। কনভেনশনের শর্তানুযায়ী, ইলেকট্রনিক বর্জ্যবিষয়ক একটি নীতিমালা বাংলাদেশে তৈরির কথা। কিন্তু এখনো তা তৈরি হয়নি। ২০১১ সালে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। এর পর বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ (সংশোধন ২০১০)-তে ই-বর্জ্য অন্তর্ভুক্ত করে আইন সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় বিধিমালা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরিবেশ অধিদফতর আইনের বিধিমালা অন্তর্ভুক্ত ও সংশোধন করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ২০১২ সালে ইলেকট্রনিক বর্জ্য নিয়ে ‘ডিসপোজাল ম্যানেজমেন্ট রুল’ নামে একটি আইনের খসড়া পরিবেশ অধিদফতর থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর মতামতের জন্য পরিবেশ অধিদফতর থেকে তা পাঠানো হয় আইন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও অনারারি প্রফেসর ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘ই-বর্জ্য নিয়ে আমাদের সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। ক্রোমিয়াম, কপার এগুলো বেশি মাত্রায় থাকলে তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এ ছাড়া লিথিয়াম ব্যাটারি পরিবেশে খারাপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।’
তার মতে, ‘বেশি ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে বিদেশি যন্ত্র আমদানির কারণে। যদি দেশে তৈরি যন্ত্র ব্যবহার বেশি হতো, তাহলে তা নষ্ট হলে ঠিক করা যেত বা অন্য কোনো কাজে এর ব্যবহার সম্ভব হতো। কিন্তু বিদেশি পণ্য আমদানি সহজ। তাই যন্ত্র বেশি কেনা হয়। আবার নষ্ট হলে ফেলে দেওয়া হয়। আবার কেনা হয়। এ কারণেই ই-বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে।’ তিনি সাম্প্রতিক সময়ে বহু ব্যবহৃত সোলার প্যানেলের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন- ‘একটা সময় যখন এগুলো ব্যবহারের উপযোগী থাকবে না। তখন এর কী হবে?’
খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানীর মতে, ‘এক্ষেত্রে আইন প্রণয়ণের চেয়ে জরুরি সচেতনতা বৃদ্ধি। আইন এর মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া সম্ভব। কিন্তু জ্ঞানের মাধ্যমে পরিস্থিতির সমাধান সম্ভব। অথচ এ বিষটা নিয়ে সরকার যেমন নীরব, তেমনি যথাযথ ভূমিকা পালন করছে না এ নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোও।’
এখন সারাবিশ^ সবুজের দিকে ঝুঁকছে। অথচ জনস্বাথের্র সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এমন একটি বিষয় নিয়ে সরকারের নির্বিকার আচরণে সংশ্লিষ্ট নাগরিকরা হতাশ। যে আন্তর্জাতিক কনভেনশনে বাংলাদেশ রাষ্ট্র স্বাক্ষর করেছে, তা মান্য করা হচ্ছে না কিসের যুক্তিতে? এ প্রশ্নেরও উত্তর নেই। সঠিকভাবে ই বর্জ্যরে ব্যবহার দেশে একটি নতুন খাতের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে বলে মনে করেন এই খাত সংশ্লিষ্টরা।