আহমেদ শরীফ
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০১৯, ০৪:৫৯ পিএম | আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৯, ০৫:০১ পিএম
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদমির পুতিন।
অক্টোবরের মাঝামাঝি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদমির পুতিন মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে গেলেন। উত্তর সিরিয়াতে তুরস্কের সামরিক অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে পুতিনের মধ্যপ্রাচ্য সফরকে পশ্চিমা মিডিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছে। পুতিন মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরত গিয়ে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরয়োগানের সঙ্গেও দেখা করেন এবং সিরিয়ায় তুর্কি সামরিক অভিযানের ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছান। সিএনএন জানায়, মধ্যপ্রাচ্যে এটা ছিল পুতিনের ‘বিজয় যাত্রা’। অন্যদিকে, ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ জানায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্লেটে করে মধ্যপ্রাচ্যকে তুলে দিয়েছেন পুতিনের হাতে। গার্ডিয়ান অবশ্য সাবধান করে বলছে, যদিও পুতিনের আপাত বিজয় সিরিয়াতে তাকে আরও শক্তিশালী অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তথাপি যুক্তরাষ্ট্রের রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণের জন্যে রাশিয়ার সামনে অনেক বেশি দায়িত্ব হাজির হয়েছে, যা নেবার জন্যে রাশিয়া কতটুকু প্রস্তুত ছিল, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ডেপুটি ডিরেক্টর-জেনারেল কোরি শাকে বলেছেন, ‘সিরিয়াতে রুশদের অবতরণের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের জন্য বেশকিছু সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে, যা তারা কাজে লাগাতে চাইবে। রাশিয়া দেখিয়েছে, পশ্চিমা দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যে তেমন কোনো ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক না হলেও রাশিয়া ঝুঁকি নিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে থাকতে চায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘সৌদিরা এখন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য কোনো সহযোগী খুঁজছে। এক্ষেত্রে রাশিয়া এবং চীনের নামই সামনে আসছে।’
বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, ২০১১ সালের আরব বসন্তের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র মিসরের হোসনি মুবারকের বিপক্ষে গিয়েছিল। অন্যদিকে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের সবচেয়ে খারাপ সময়েও তার পাশে দাঁড়িয়েছে মস্কো। ২০১৫ সালে বারাক ওবামার সরকার ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তিতে সমর্থন দেয়, যা সৌদি আরবকে ভীষণভাবে বিচলিত করে। এটা সৌদিদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহ হারাচ্ছে। এরপর ২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার সৌদি আরবের সঙ্গে বিশাল অংকের ব্যবসার ঘোষণা দিলেও ২০১৮ সালের অক্টোবরে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার পর পশ্চিমা মিডিয়া এবং রাজনীতিকদের তোপের মুখে পড়ে সৌদি আরব। অথচ এসময় ভ্লাদমির পুতিন সৌদি নেতৃত্বকে কাছে টেনে নেন। সৌদি তেলখনিতে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে অনেক কথা বললেও বড় কিছু করা থেকে বিরত থেকেছে, যা সৌদি আরবকে আবারও দোটানায় ফেলেছে। বহু খরচে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা অস্ত্রশস্ত্রও তাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষা করতে পারেনি। এমতাবস্থায় সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে। ব্রিটেনে সৌদি রাষ্ট্রদূত প্রিন্স খালিদ বিন বন্দর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সিরিয়াতে তুর্কি সামরিক মিশন এবং সেখান থেকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সরে যাওয়াকে ‘দুর্যোগ’ বলে আখ্যা দেন। অন্যদিকে, সৌদি আরবের সঙ্গে রাশিয়ার সখ্যতা বৃদ্ধির ব্যাপারে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘রাশিয়া অনেকক্ষেত্রেই পূর্বকে পশ্চিমাদের চেয়ে ভালো বোঝে।’
১২ বছরের মাঝে প্রথম সৌদি আরব সফরে ভ্লাদমির পুতিন বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সফরকালে দুই দেশের মাঝে মোট ২০টি সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়, যেগুলির মূল্যমান প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের মতো। এর মাঝে রয়েছে তেলের মূল্য নির্ধারণের আলোচনা, মহাকাশ ও স্যাটেলাইট বিষয়ে সহযোগিতা, রাশিয়া থেকে সৌদি আরবে রফতানি বৃদ্ধির বিষয়ে সমঝোতা, কৃষি বিনিয়োগ বিষয়ক সমঝোতা, রুশ বিমান শিল্পকে চাঙ্গা করতে বিমান লিজিং ব্যবসায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার সৌদি বিনিয়োগের ব্যাপারে সমঝোতা, রুশ রেলওয়েতে সৌদি বিনিয়োগ, সৌদি আরবে রুশ বিমান শিল্পের ব্যাপারে সমঝোতা, তেলের খনিতে ব্যবহৃত পাম্প তৈরির কোম্পানি নভোমেটে সৌদি কোম্পানি আরামকোর বিনিয়োগের ব্যাপারে সমঝোতা, রাশিয়ার পূর্বে আমুর প্রদেশে মিথানল প্রকল্পে সৌদি বিনিয়োগের ব্যাপারে সমঝোতা। এ ছাড়াও রাশিয়ার দক্ষিণের মুসলিম-অধ্যুষিত দাগেস্তানের রাজধানী মাকাচকালা ও জেদ্দার মাঝে হজ মৌসুমে সরাসরি ফ্লাইটও চালু হতে যাচ্ছে শিগগিরই। প্রতিরক্ষা বিষয়ে, বিশেষত সৌদি আরবের কাছে রুশ ‘এস-৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রির ব্যাপারে অবশ্য কথা হয়নি। তবে এ সফরে তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় ছিল, তা সৌদি জ্বালানিমন্ত্রী আব্দুল আজিজ বিন সালমান মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘ওপেক প্লাসের নতুন সমঝোতা তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মাঝে সহযোগিতা বাড়াবে এবং তেলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা দেবে।’
সৌদি আরব থেকে ১৫ অক্টোবর পুতিন সংযুক্ত আরব আমিরাতে যান এবং সেখানকার যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রুশ শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী ডেনিস মানতুরভ বলেন, ‘আমিরাতের সঙ্গে এরোস্পেস শিল্পের বেশ কয়েকটা প্রকল্পে কাজ করতে চাইছে মস্কো। আমিরাতের আকাশ পরিবহন খাতে রুশ স্বল্প পাল্লার এসএসজে-১০০, মধ্যম পাল্লার এমসি-২১ এবং বিই-২০০ উভচর বিমান ব্যবহারের ব্যাপারে কথা চলছে বলে জানান তিনি। আমিরাতের বিমান শিল্পেও রাশিয়া প্রযুক্তি সহায়তা দিতে ইচ্ছুক।’
রাশিয়ার অর্থনীতি অনেকটাই তেল-গ্যাস রফতানির ওপর নির্ভরশীল। আর তেলের বাজারে অস্থিরতা রাশিয়ার সরকারি বাজেটকে সমস্যায় ফেলছে। আইএমএফ বলছে, ২০১৯ সালে রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১.১ শতাংশের বেশি হবে না। রাশিয়ার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে তেলের মূল্যের নিয়ন্ত্রণে সৌদিদের সমর্থন রাশিয়ার যেমন দরকার, তেমনি পেট্রোলিয়াম, এভিয়েশন, প্রতিরক্ষা, কৃষি, পর্যটন, এবং অন্যান্য সেক্টরে মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগ ছাড়া রাশিয়ার অর্থনীতিকে তেল-গ্যাস রপ্তানির উপর নির্ভরশীলতা থেকে বের করে আনা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, পুতিন চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃবৃন্দকে শক্তি যোগাতে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান নিতে রাশিয়া কতটুকু সক্ষম, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়া নীতির কারণে পুতিনের মধ্যপ্রাচ্য সফর যে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, তা অনস্বীকার্য। যুক্তরাষ্ট্র এখনো সৌদি আরবের গুরুত্বপূর্ণ টেবিলে সবচেয়ে দামি চেয়ারটা ধরে রেখেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে একা নয়, তার আশপাশে এখন অনেক অতিথিদেরই দেখা যাচ্ছে।