পণ্য প্রসঙ্গে

নাসির উদ্দিন আহম্মদ

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০১৯, ১০:৩৯ পিএম

মার্কসীয় জ্ঞান পরিমণ্ডলে পণ্য এক অপার রহস্যে আবির্ভূত। সম্পদের পণ্য হয়ে ওঠার কারণগুলোর মধ্যে এ রহস্য লুকায়িত। মার্কস বলেছেন ‘তাহলে আমরা যদি পণ্যসমূহের ব্যবহার মূল্যটা না ধরি তো তাদের একটিই সাধারণ বৈশিষ্ট্য অবশিষ্ট থাকে, তা হলো এই যে সেগুলি সবই শ্রম থেকে উৎপন্ন।’ (সূত্র : পুঁজি খণ্ড-১ অংশ ১, পৃ-৬১)।

প্রথমত, ‘পণ্য হলো বাহ্যিক একটি জিনিস, যা তার গুণাবলি দ্বারা মানুষের কোনো না কোনো চাহিদা পূরণ করে। সেই চাহিদার প্রকৃতি কী, যেমন তা উদরের চাহিদা না কল্পনার চাহিদা, তাতে কিছুই যায় আসে না।’

শ্রম আত্মসাৎ করে সম্পদ পণ্য হয়ে ওঠে। সম্পদ জৈব-অজৈব, জড়-অজড় যা-ই হোক না কেন, শ্রমের সঙ্গে সম্পর্ক অবধারিতভাবে নির্ধারিত। প্রকৃতি এই শৃঙ্খলে মানুষকে বেঁধে রেখেছে। প্রকৃতি বিকশিত হতে চেয়েছে মানব শ্রমের ভেতর দিয়ে। মানুষ অর্থনৈতিক জীব হওয়ার কারণে পণ্যের আবির্ভাবের বিপরীতে তার অন্য কিছু হওয়ার বিকল্প নেই। আর তার অনিবার্য ফলাফল হলো পুঁজির দানবীয় অস্তিত্ব। পণ্য তার নিজ অস্তিত্বকে পুঁজিতে লীন করে দেয়। পণ্যের জন্য, পণ্যের প্রয়োজনে বাজারের আবির্ভাব। পণ্য বাজার বাহনে সওয়ার হয়ে ভোক্তার চোখে এমন এক বিভ্রম ছড়িয়ে দেয়, ভোক্তা তখন পণ্যের বাইরে অন্য কিছু দেখে না। ভোক্তার চোখে, তার চেতনায় একটি চেয়ার শুধু চেয়ার, কাঠ অথবা তারও মূলে যে একটি গাছ আছে তা চেয়ার পণ্যের বিভ্রমে ঢাকা পড়ে যায়। পণ্য নিজ সত্তার ভেতর দিয়ে প্রকাশ করে দাম, দামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুদ, খাজনা, মুনাফা। বস্তুত সব কিছু উদ্গত হয়েছে  শ্রম থেকে। পণ্য নিজের মূল্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ঐ মূল্য বিনিময়ের জন্য মুদ্রা বা অর্থ নামের আরেকটি পণ্যের অস্তিত্ব উপস্থিত করে। পণ্য অস্তিত্বের প্রতিরূপ যে পণ্য পুঁজিতে রূপ নেয় তা অর্থ ছাড়া আর কিছু নয়। অর্থের ক্ষমতা অপরিসীম। পণ্য-অর্থ-পুঁজির ভৃত্য হয়ে বাজার বাহন আবর্জনা বিষ বহন করে নিয়ে যায় ভোক্তার দ্বারে। এ ধরনের অবস্থায় মানুষ তার প্রজাতি সত্তা হারিয়ে হয়ে ওঠে পুঁজির সেবক। বিশ্বব্যাপী পণ্য মনস্কতা, পণ্য ধ্যান, পণ্য পূজা মানুষের দৈনন্দিন আচারে অনিবার্য হয়ে ওঠে। মানুষ তার প্রজাতি সত্তা হারানোর ফলে লৈঙ্গিক পার্থক্য তখন আর প্রাকৃতিক থাকে না বরং তা সংস্কৃতির উপাদান হয়ে কলুষিত বিষাক্ত সমাজের কোষ হয়ে ওঠে। এ ধরনের সমাজ ব্যবস্থা রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন তৈরি করে শ্রমজীবী নিষ্পেষণের হাতিয়ার হিসেবে।

সম্পদ যে শক্তিতে জৈব-অজৈব শ্রম কোষে কোষে জমিয়ে পণ্য হয়ে আবির্ভূত হয় তা কি প্রাকৃতিক কোনো ঘটনা? মানুষের শ্রম বিযুক্ত না হলে পুঁজির উদ্ভব হতো না। পুঁজিবাদী উৎপাদন অবস্থার প্রাক যুগে মানুষের আত্মিক শান্তি বিভিন্নভাবে বিভিন্ন উপায়ে তছনছ হয়েছে কিন্তু পুঁজি গঠনে শ্রমের বিযুক্তি অক্ষুন্ন থেকেছে, যা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মায়া ছড়িয়ে দিতে পারে। এবং তেমন হয়েছেও বটে। যেহেতু মানুষ তার শারীরিক প্রয়োজন পরিহার করতে পারে না, বাধ্য হয়ে কাজ করতেই হয়। রহস্য হলো এখানে কতিপয় মানুষ পুঁজির মালিক বনে যায়। এ রহস্য আকর্ষণীয় মোড়কে পণ্যের ভেতর দিয়ে পরম সত্তার বিধান নিয়ে হাজির হয়। দেশ ভাবনা তখন পরম সত্তার অভিপ্রকাশে মানুষের চিন্তাচর্চায় মরমের উপস্থিতি অনিবার্য কওে তোলে যা পুঁজির পরম সত্তা হয়ে ওঠার পক্ষে সব শর্ত বিনির্মাণে নিয়োজিত।

পণ্য অর্থ পুঁজি চক্রে পণ্যকে ঘিরে আবর্তিত বাজার-ঋণ-সুদ। বিরাজমান অবস্থায় এই চক্রের বাইরে মানুষের যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, তাই আমাদের সকল নীতিকথা কথন ছাড়া আর কিছুই না। আমাদের দেখার জগৎটা বিভ্রমের, সমাজ কোষে এই বিভ্রম ছড়িয়ে আছে সংস্কৃতিক পরিম-ল নিয়ে। শরীর থেকে শ্রম বিচ্ছিন্ন না হলে আজকের সমাজ বিকাশ আমাদের অভিজ্ঞতার সীমানায় পেতাম না। মানুষের জীবসত্তার কৌতুহল হলো তার থেকে উদগত যা তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারই সামনে সক্রিয় উপস্থিত থাকে। এভাবে মানুষ প্রকৃতি থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে মানুষ এই বিচ্ছিন্ন বোধ প্রকৃতি থেকে মেটাতে পারে না, যে কারণে এমন এক মনোজগৎ গড়ে ওঠে যা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষণের উপায় নির্দেশ করে। এভাবে এক অসুখী সমাজ গড়ে ওঠে। মানুষের অপ্রয়োজনীয় ভোগ মেটাতে বাজার বয়ে আনে এমন সব পণ্য যা প্রশান্তির বদলে ব্যাপক অসুখী করে তোলে মানুষকে। শরীর মন নীল জারক রসে জারিত হয়ে হিংস্রতা জাগিয়ে তোলে। তৈরি করে যুদ্ধের নৈতিক ভীত। বাজারের অস্তিত্ব ভোগ উসকে দেওয়ার সব পন্থা অবলম্বন করে। রকমারি পণ্য সমগ্র মানুষকে ঘিরে রাখে সারাক্ষণ। ঘুমের সময়টুকুও আর তার নিজের থাকে না, কেড়ে নেয় বিজ্ঞান প্রযুক্তি পণ্য। এ ধরনের দশাতে পুঁজির সুদ/মুনাফায় কিছু মুনাফাভোগী আয়েশে জীবনযাপন করতে পারে। কারণ মুষ্টিমেয়র হাতে পুঁজি ঘনীভূত হয় তখন তারা টাকার বিনিময়ে টাকা আয় করে। জুয়াড়ি অর্থনীতির উদ্ভব ঘটে, জুয়াড়ি অর্থনীতি পুঁজিই তৈরি করে। অর্থের দৌরাত্ম্য রোধ করা কারও পক্ষে সম্ভব হয় না। প্রণীত হয় এর পক্ষে আইন, রাজনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড।

লেখক: নাসির উদ্দিন আহম্মদ
এফসিএমএ

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh