সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৯:২১ পিএম
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
’৬২ সালে শিক্ষানীতিবিরোধী যে আন্দোলন, সেটা ছিল চাপিয়ে দেয়া শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে; যেটি আমাদের সংস্কৃতির শিক্ষার বিরুদ্ধে ছিল বৈষম্যমূলক এবং চূড়ান্তভাবে ঔপনিবেশিক।
তখন একটা আদর্শবাদ ছিল ষাটের দশকজুড়ে- যেটি ছিল সমাজতন্ত্রী ও বামপন্থী। ষাটের দশকে মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন ছিল বিশ্বজুড়ে। যেমন- শান্তির পক্ষে মানুষ মিছিল করেছে প্যারিসের রাস্তায়। পৃথিবীজুড়ে মানুষের অধিকার আদায় ও সবার প্রতি বৈষম্যহীন এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সমাজের জন্য।
আমাদের দেশে ষাটের দশক ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের সময়। তখন অনেক আন্দোলন হয়েছে, যেমন- ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সর্বশেষ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ। শিক্ষার আন্দোলন ছিল তৃণমূল পর্যায়ের। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে কল্যাণমুখী চিন্তার মাধ্যমে সবার শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা।
শিক্ষার ওই আন্দোলনের মধ্যে রাজনৈতিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও ধর্মের নামে আন্দোলন ছিল। কারণ পাকিস্তান ধর্মকে ব্যবহার করে আমাদের শোষণ করতে চেয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তারা পরাজিত হয়। শ্রমিকের অধিকার, কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির আন্দোলন- এসবই ছিল শিক্ষা আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত।
আজকের দিনেও ষাটের দশকের মতো শিক্ষা আন্দোলন দরকার। ষাটের দশকে সে আন্দোলন ছিল পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের বিষয়টিও শেষ হয়ে যায়নি।
এখনও শ্রমিক তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক পায় না, কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত। ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক অধিকার আদায় ও মিডিয়া-পত্রিকা নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হয়েছে। এখনও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আছে, মিডিয়া-পত্রিকার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে।
ষাটের দশকে শিক্ষা আন্দোলন ছিল সর্বজনীন শিক্ষা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে; কিন্তু এখনও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তিন ধারায় বিভক্ত। দরিদ্র শ্রেণি মাদ্রাসায় পড়ছে, মধ্যবিত্ত বাংলা মিডিয়াম এবং তুলনামূলক উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চ শ্রেণির মানুষ তাদের সন্তানদের ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াচ্ছে।
এটি সমাজে বিভেদ তৈরি করছে। এ ছাড়া শিক্ষা হয়ে পড়েছে পরীক্ষা ও চাকরিকেন্দ্রিক। পড়াশোনায় অংশগ্রহণ ও ছাত্রছাত্রী বাড়ার হিসাবে শিক্ষায় উন্নতি হয়েছে; কিন্তু সর্বজনীন শিক্ষা এখনও হয়নি।
ফলে ষাটের দশকের আন্দোলন এখনও চলমান। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’; কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে মুক্তি আসেনি। শিক্ষায় সর্বজনীনতা আনার মাধ্যমে, আলোকিত মানুষ গড়ার মাধ্যমে সে মুক্তি আনতে হবে। নারীদের বিজ্ঞান শিক্ষায় পিছিয়ে রাখা হয়েছে।
গ্রাম-শহরে শিক্ষার বিভাজন রয়েছে। সবাই বর্তমানে সমান শিক্ষা পাচ্ছে না। যারা বড় অঙ্কের টিউশন ফি দিতে পারছে, তারা ভালো শিক্ষা পাচ্ছে। মোটা অঙ্কের টাকায় বাহারি নোট-গাউডে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে শিক্ষা। এর বিপরীতে শিক্ষাকে সহজলভ্য করতে হবে।
শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয়, বেতন ইত্যাদি থাকবে না। সেটা রাষ্ট্র বহন করবে, তবে শিক্ষা সরঞ্জামের ব্যয় নিজের। শিক্ষা আন্দোলনসহ ষাটের দশকের অন্যান্য আন্দোলনের উদ্দেশ্য নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
লেখক: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক।