বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা বাড়তে দেওয়া যাবে না

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৬:১১ পিএম

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্প্রতি বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সমস্যা ও অস্থিরতা লক্ষ করছি, তা সুনির্দিষ্ট কোনো কারণে ঘটেছে তা বলা যায় না। একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একেকটি কারণে বিদ্যমান সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, আমাদের এখানে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা নিয়োজিত আছেন, বিশ্ববিদ্যালয়প্রধান বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসে দূরত্ব তৈরি হওয়ার কারণে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়ে আসছে। এই সমস্যাটি অনেক দিন ধরেই লক্ষ করছি। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে যেটা করতে হবে—শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, চাওয়া বা দাবিগুলো শুনতে হবে এবং যত দূর সম্ভব যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের আস্থায় নিয়ে যদি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা যায়, তাহলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

এখানে একটি জরুরি বিষয় হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যে পরিধি, এখানে যে বড় পদগুলো আছে, সেগুলো কিন্তু অস্থায়ী দায়িত্বের পদ। সাময়িকভাবে তাঁরা পদে আসীন হন। কিন্তু শিক্ষকদের মূল কাজই হচ্ছে পাঠদান করা বা শিক্ষকতা করা। এটাই প্রধান ও জরুরি কাজ বলে আমি মনে করি। কাজেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানের দায়িত্ব পাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের কথা না ভেবে যখন ক্ষমতা প্রয়োগ করার বিষয় সামনে আসে, তখনই সমস্যা তৈরি হয়। এটাকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব বা বিদ্যমান সমস্যা তৈরি হয়েছে, এর পেছনে কাজ করছে পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়ার দূরত্ব। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোগাযোগের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সে কারণে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। আমি মনে করি, এখানে তৃতীয় পক্ষের অংশগ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। এ জন্য যেটা করা যেতে পারে—বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রশাসন মিলে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো সমস্যা নেই, যা সমাধান করা সম্ভব নয়। এখানে খুব বড় কোনো সমস্যা হয়েছে বলে মনে হয় না। যা ঘটেছে আন্তরিকভাবে চাইলে তা সমাধান করা সম্ভব।

আমাদের মনে রাখতে হবে, যোগাযোগ একটি বড় ধরনের সম্পদ, এটাকে কাজে লাগিয়ে সব ধরনের সমস্যার সমাধান করা যায়। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে গেলে নানা ধরনের সমস্যা আসতে পারে, সেসব কৌশলে ও সাবধানে বিবেচনায় নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য যেসব নতুন ছেলে-মেয়ে আসে, তাদের বুঝতে হবে। নতুন ছেলে-মেয়েদের আশা ও উদ্দীপনায় বাধা এলে তারা দুঃখ পায়, আহত হয়। হতাশ হয়। শিক্ষকের উচিত,

তাদের পাশে দাঁড়ানো। পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গায় ঘাটতি দেখা দিলে সমস্যা তৈরি হবেই। দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমনটাই ঘটেছে। যখন এমন ঘটনা ঘটে তখন সংকটটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউন্ডারি পার হয়ে পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ার মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব মেকানিজম ও কৌশল আছে। কোনো একটি ঘটনা যখন ঘটে, যেকোনো পক্ষ দোষী বা অপরাধী হলে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য যেটা দরকার, অপরাধ প্রমাণিত হতে হবে। কিন্তু কারো সম্মান নষ্ট করা যাবে না। চূড়ান্তভাবে অপরাধ প্রমাণিত হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়ার সুযোগ আছে, তবে কোনোভাবেই ভুল বিচার করা যাবে না। তদন্ত করে প্রকৃত সত্য বের করে আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা একটা প্রধান অংশ। তাদের তুচ্ছ কারণে ছোট করা, অপমান করা বা সম্মান নষ্ট করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। একইভাবে শিক্ষকদেরও সম্মান রক্ষা করা শিক্ষার্থীদের কর্তব্য।

আর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতির বিষয়টি অবশ্য সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। এখানে নানা ধরনের দুর্নীতি হতে পারে। যেমন—প্রশ্ন ফাঁস, ভুয়া ভর্তি বা ফলাফল প্রকাশে অনিয়ম—এসব ক্ষেত্রে তদন্ত করে দেখা এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এলে সেটারও সমাধান সম্ভব। প্রথমে অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেই এর সমাধান করতে পারে। যদি সমাধানে ব্যর্থ হয়, তাহলে সরকারের সহযোগিতা নিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সর্বোচ্চ ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটকে দেওয়া আছে সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য। কাজেই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করা ভালো। তা না পারলে সরকারের সাহায্য গ্রহণ করতে পারে।

কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো সমস্যা নেই, যা সমাধান করা যায় না। এ জন্য প্রচেষ্টা ও আন্তরিক ইচ্ছা থাকতে হবে। সমাধানের পথ সব সময় উন্মুক্ত রাখতে হয়। এটা সবার পক্ষেই ভালো ও নিরাপদ। একটা কথা মনে রাখতে হবে—শিক্ষকদের কাজই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া, ক্ষমতা দেখানো নয়। আরেকটি বিষয়, কোনো বিষয়ে কেউ যদি অপরাধী হয়, দোষী যে-ই হোক না কেন, তার অপরাধ প্রমাণিত হলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন : মাসউদ আহমাদ

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh