কবি জীবনানন্দ দাশের পাঁচ কবিতা

কবি জীবনানন্দ দাশ ১৯৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কবি কুসুম কুমারী দাশ ও সত্যনানন্দ দাশের সন্তান। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী এই লেখক একাধারে কবি, অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, উপন্যাসিক, গীতিকার। স্কুল জীবনেই কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলা ও ইংরেজিতে লেখালেখি শুরু করেন।  

তার কবিতা বাংলার রূপ, প্রকৃতি, মানুষের জীবনধারা, মাটি, তাদের  কর্ম,দু:খ-কষ্ট, বৃটিশ শাসনবিরোধী, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা উঠে এসেছে। কবিতা নির্মিতিতে ভিন্ন আঙ্গিকে, ভাষাগতভাবে পূরাণকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন। রবীন্দ্রত্তোর কবিতায় তার মতো ভিন্নভাবে সৃষ্টিশীলতা আর কারো মধ্যে কাজ করেনি।  

জীবনানন্দ দাশের প্রথম কবিতার বই ‘ঝরা পালক’প্রকাশ পায় ১৯২৭ সালে। কলেজ জীবন থেকে তার লেখা নানা পত্রিকায় প্রকাশ পেতে থাকে। তার প্রকাশিত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে, ধূসর পান্ডুলিপি (১৯২৭),বনলতা সেন (১৯৪২), মহাপৃথিবী (১৯৪৪), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮), জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা ( ১৯৫৪), রুপসী বাংলা (১৯৫৭), বেলা অবেলা কালবেলার কবিতা (১৯৬১ ), সুদর্শনা (১৯৭৬), আলো পৃথিবী (১৯৮১), মনোবিহঙ্গম, প্রেম তোমার কথা ভেবে (১৯৯২)। গল্পগ্রন্থ ‘জীবনানন্দ দাশের গল্প (১৯৭২), চারজন (২০০৪), শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৭৩)। এ ছাড়া কবির একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রকাশ পায়।

সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য কবি রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার (১৯৫২ ), সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার ( ১৯৯৫)সহ অন্যান্য পুরস্কার লাভ করেন।

অসাধারণ মেধাবী এই বাঙালি কবি কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর মারা যান। আজ তার  ৬৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। 

কবির প্রয়াণ দিবসে পড়ুন  উল্লেখযোগ্য পাঁচ কবিতা: 


১. অদ্ভুত আঁধার এক

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি

এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়

মহত্‍‌ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা

শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।


২. আমি যদি হতাম

আমি যদি হতাম বনহংস,

বনহংসী হতে যদি তুমি;

কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে

ধানক্ষেতের কাছে

ছিপছিপে শরের ভিতর

এক নিরালা নীড়ে;


তাহলে আজ এই ফাল্পুনের রাতে

ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে

আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে

আকাশের রুপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-

তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-

নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,

শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে

সোনার ডিমের মতো

ফাল্গুনের চাঁদ।

হয়তো গুলির শব্দঃ

আমাদের তির্যক গতিস্রোত,

আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস,

আমাদের কন্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!


হয়তো গুলির শব্দ আবারঃ

আমাদের স্তব্ধতা,

আমাদের শান্তি।

আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না:

থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;

আমি যদি বনহংস হতাম,

বনহংসী হতে যদি তুমি;

কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে

ধানক্ষেতের কাছে।


৩. আকাশলীনা

সুরঞ্জনা, ঐখানে যেয়োনাকো তুমি,

বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;

ফিরে এসো সুরঞ্জনা:

নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;


ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;

ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;

দূর থেকে দূরে – আরও দূরে

যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।


কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!

আকাশের আড়ালে আকাশে

মৃত্তিকার মতো তুমি আজ:

তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।


সুরঞ্জনা,

তোমার হৃদয় আজ ঘাস :

বাতাসের ওপারে বাতাস -

আকাশের ওপারে আকাশ।


৪. স্বপ্ন

পান্ডুলিপি কাছে রেখে ধূসর দীপের কাছে আমি

নিস্তব্ধ ছিলাম ব'সে;

শিশির পড়িতেছিলো ধীরে-ধীরে খ'সে;

নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি


উড়ে গেলো কুয়াশায়, — কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো।

তাহারি পাখার হাওয়া প্রদীপ নিভায়ে গেলো বুঝি?

অন্ধকার হাৎড়ায়ে ধীরে-ধীরে দেশলাই খুঁজি;

যখন জ্বালিব আলো কার মুখ দেখা যাবে বলিতে কি পারো?


কার মুখ? —আমলকী শাখার পিছনে

শিঙের মত বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিলো তাহা;

এ-ধূসর পান্ডুলিপি একদিন দেখেছিলো, আহা,

সে-মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।


তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,

পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,

মানুষ র'বে না আর, র'বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখনঃ

সেই মুখ আর আমি র'বো সেই স্বপ্নের ভিতরে।


৫. লোকেন বোসের জর্নাল 

সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি —

এখনো কি ভালোবাসি?

সেটা অবসরে ভাববার কথা,

অবসর তবু নেই;

তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে

এখন শেলফে চার্বাক ফ্রয়েড প্লেটো পাভলভ ভাবে

সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না।


পুরোনো চিঠির ফাইল কিছু আছে:

সুজাতা লিখেছে আমার কাছে,

বারো তেরো কুড়ি বছর আগের সে-সব কথা;

ফাইল নাড়া কি যে মিহি কেরানীর কাজ;

নাড়বো না আমি

নেড়ে কার কি লাভ;

মনে হয় অমিতা সেনের সাথে সুবলের ভাব,

সুবলেরই শুধু? অবশ্য আমি তাকে

মানে এই — অমিতা বলছি যাকে —

কিন্তু কথাটা থাক;

কিন্তু তবুও —

আজকে হৃদয় পথিক নয়তো আর,

নারী যদি মৃগতৃষ্ণার মতো — তবে

এখন কি করে মন কারভান হবে।


প্রৌঢ় হৃদয়, তুমি

সেই সব মৃগতৃষ্ণিকাতলে ঈষৼ সিমুমে

হয়তো কখনো বৈতাল মরুভুমি,

হৃদয়, হৃদয় তুমি!

তারপর তুমি নিজের ভিতরে ফিরে এসে তব চুপে

মরীচিকা জয় করেছো বিনয়ী যে ভীষন নামরূপে

সেখানে বালির সৼ নিরবতা ধূ ধূ

প্রেম নয় তবু প্রমেরই মতন শুধু।

অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে?

অমিতা নিজে কি তাকে?

অবসর মতো কথা ভাবা যাবে,

ঢের অবসর চাই;

দূর ব্রহ্মাণ্ডকে তিলে টেনে এনে সমাহিত হওয়া চাই

এখনি টেনিসে যেতে হবে তবু,

ফিরে এসে রাতে ক্লাবে;

কখন সময় হবে।


হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোঁটে —

হৃদয় কেন যে কাঁপে,

'ভালোবাসতাম' — স্মৃতি — অঙ্গার — পাপে

তর্কিত কেন রয়েছে বর্তমান।

সে-ও কি আমায় — সুজাতা আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলো?

আজো ভালোবাসে নাকি?

ইলেকট্রনেরা নিজ দোষগুনে বলয়িত হয়ে রবে;

কোনো অন্তিম ক্ষালিত আকাশে

এর উত্তর হবে?

সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে;

অমিতা কি মিহিজামে?

বহুদিন থেকে ঠিকানা না জেনে ভালোই হয়েছে — সবই।

ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্তরাগে;

সময়ের এই স্থির এক দিক,

তবু স্থিরতর নয়;

প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //