কবি ফররুখ আহমদের পাঁচ কবিতা

কবি ফররুখ আহমদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে। তিনি ১৯৩৭ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৩৯ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। পরে স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হলেও পরীক্ষা না দিয়েই তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন।

তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রচনা হলো সাত সাগরের মাঝি, সিরাজুল মুনীর, নৌফেল ও হাতেম, মুহূর্তের কবিতা, পাখির বাসা, হাতেম তায়ী, নতুন লেখা, হরফের ছড়া, ছড়ার আসর ইত্যাদি। 

স্বনামধন্য এই কবি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। 

প্রখ্যাত কবি ফররুখ আহমদের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। 

তার মৃত্যবার্ষিকীতে পাঠকদের জন্য কয়েকটি কবিতা তুলে ধরা হলো: 

১. কাঁচড়াপাড়ায় রাত্রি

কাঁচড়াপাড়ায় রাত্রি। ডিপোতলে এঞ্জিল বিকল –

সুদীর্ঘ বিশ্রান্ত শ্বাস ফেলে জাগে ফাটা বয়লার,

- অবরুদ্ধ গতিবেগ। তারপর আসে মিস্ত্রিদল

গলানো ইস্পাত আনে, দৃঢ় অস্ত্র হানে বারবার।

জ্বলন্ত অগ্নির তাপে এইসব যন্ত্র জানোয়ার

দিন রাত্রি ঘোরেফেরে সুদুর্গম দেশে, সমতলে

সমান্তর, রেলে রেলে, সেতুপথে পার হয়ে আর

অভীষ্ট লক্ষ্যের পানে দার্জিলিঙে আসামে জঙ্গলে।

আহত সন্ধ্যায় তারা অবশেষে কাঁচড়াপাড়াতে।

দূরে নাগরিক আশা জ্বলে বালবে লাল-নীল-পীত;

উজ্জ্বীবিত কামনার অগ্নিমোহ-অশান্ত ক্ষুধাতে;

কাঁচড়াপাড়ার কলে মিস্ত্রিদের নারীর সঙ্গীত।

(হাতুড়িও লক্ষ্যভ্রষ্ট) ম্লান চাঁদ কৃষ্ণপক্ষ রাতে

কাঁচড়াপাড়ায় জাগে নারী আর স্বপ্নের ইঙ্গিত।।


২. বর্ষার বিষণ্ণ চাঁদ 

বর্ষার বিষণ্ণ চাঁদ এ রাতেও উঠেছে তেমনি 

যেমন সে উঠেছিল হাজার বছর আগেকার

বৃষ্টি-ধোয়া আসমানে। সে রাত্রির অস্ফুটে ব্যথার

মৃদু স্বর আছে এ আকাশে। সেই ক্ষীণ কণ্ঠধ্বনি

আমার মনের তারে বেজে ওঠে আপনা আপনি,

শ্রাবণ মেঘের মাঝে ডুবে যায় চাঁদ যতবার;

যতবার ভেসে ওঠে। দূরে এক অস্পষ্ট মাজার

শতাব্দীর স্মৃতি নিয়ে জাগায় ব্যথার আবেষ্টনী।

হাজার বছর পরে এই চাঁদ বিষণ্ণ বর্ষার 

ব’য়ে নিয়ে যাবে স্মৃতি জনপদে বেদনা-মন্থর;

অস্পষ্ট ছায়ার মত, যেখানে এ রাত্রির দুয়ারে,

খুলে দেবে অন্ধকারে জীবনের বিস্মৃত প্রহর;

বৃষ্টি ধোয়া আসমানে জাগাবে সে এই ক্লান্ত স্বর;

হাজার বছর পরে একবার শুধু একবার।।


৩. সিলেট ষ্টেশনে একটি শীতের প্রভাত

অন্ধকার আজদাহার বেষ্টনীতে প্রাণী ও প্রাণের

সাড়া নেই। এখানে জালালাবাদে দেখি এসে

হিম-সিক্ত কম্বলের মত রাত্রি ঢেকেছে নিঃশেষে

সমস্ত আলোকরশ্মি পৃথিবীর সকল পথের।

ইরানী ছুরির মত তীক্ষ্মধার হাওয়া উত্তরের

বিদ্ধ হয় অনাবৃত তরু শীর্ষে, নিমেষে নিমেষে

তারি স্পর্শ পাই শূন্য প্লাটফর্মে; মাঘ রাত্রি শেষে

সুপ্তিমগ্ন জনপ্রাণী এখন সিলেট শহরের।

বাতাসের দীর্ঘশ্বাস ঝিল্লিও নীরব, পাখীদের

বাসায় নিঃসাড় ঘুম (মৃত্যু নেমে আসে ছদ্মবেশে

পৌত্তলিক অন্ধকারে), সাড়া নাই মুক্ত জীবনের;

মৌন প্রতীক্ষায় ধরা মর্মরিয়া ওঠে তবু ক্লেশে।

তারপর কি আশ্চর্য দেখি চেয়ে প্রতীক্ষার শেষে

প্রশান্ত প্রভাত নামে স্নিগ্ধোজ্জ্বল হাসি দরবেশের।।


৪. পাঞ্জেরি 

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?

সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?

তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;

অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

দীঘল রাতের শ্রান্তসফর শেষে

কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে?

এ কী ঘন-সিয়া জিন্দেগানীর বা’ব

তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খা’ব

অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী।

তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;

সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি।

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

বন্দরে বসে যাত্রীরা দিন গোনে,

বুঝি মৌসুমী হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে,

বুঝি কুয়াশায়, জোছনা- মায়ায় জাহাজের পাল দেখে।

আহা, পেরেশান মুসাফির দল।

দরিয়া কিনারে জাগে তকদিরে 

নিরাশায় ছবি এঁকে!

পথহারা এই দরিয়া- সোঁতারা ঘুরে

চলেছি কোথায়? কোন সীমাহীন দূরে?

তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;

একাকী রাতের ম্লান জুলমাত হেরি!

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

শুধু গাফলতে শুধু খেয়ালের ভুলে,

দরিয়া- অথই ভ্রান্তি- নিয়াছি ভুলে,

আমাদেরি ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি

দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী।

মোদের খেলায় ধুলায় লুটায়ে পড়ি।

কেটেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী।

সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারি,

ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি।

ওকি বাতাসের হাহাকার,- ও কি

রোনাজারি ক্ষুধিতের!

ও কি দরিয়ার গর্জন,- ও কি বেদনা মজলুমের!

ও কি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী।

পাঞ্জেরি!

জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি,

জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি!

দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি!!


৫. ঝরোকা 

সকল রুদ্ধ ঝরোকা খুলে দাও

খুলে দাও সকল রুদ্ধ দরোজা।

আসুক সাত আকাশের মুক্ত আলো

আর উচ্ছল আনন্দের মত

বাগে এরেমের এক ঝাঁক মৌমাছি .. ..

যেন এই সব পাথরের ফুলের মাঝখান থেকে

আমি চিনে নিতে পারি

রক্তমনির চেয়েও লাল সুনভিত

একটি তাজা রক্ত গোলাপ;

আমার ব্যথিত আত্মা আর্তনাদ করে উঠলো

দাউদের পুত্র সোলায়মানের মতো

কেননা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের আকাশ আছে পৃথিবীতে

চিরন্তন শুধু সত্যের অন্বেষা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //