আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনা

আমাদের অনেকের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন কবি, ছোটগল্পকার ও শিল্পী হিসেবে পরিচিত। তিনি শিক্ষাবিজ্ঞানীও ছিলেন। তার শিক্ষা বিষয়ক ভাবনার দিকে আমরা যদি একটু দৃষ্টিপাত করি, তাহলে আমাদের সামনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন শিক্ষাতাত্বিক হিসেবে উদ্ভাসিত হবেন। 

তিনি তার নিজের জীবন দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি পরিলক্ষিত করেছেন। এ যেন জীবন থেকে শেখা। রবীন্দ্রনাথের বহু পূর্বে প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রে এক ধরনের শিক্ষাপদ্ধতির কথা বলেছেন। কিন্তু প্লেটের আদর্শ রাষ্ট্র কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর আমরা জানি শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে বারবিয়ানা স্কুল, পাওলো ফ্রেইরির শিক্ষাপদ্ধতি, কোবাইয়াশি সোসাকু ও সামারহিল প্রভৃতি শিক্ষাপদ্ধতির কথা।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনার আলোচনা করতে গিয়ে ও আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে উপরোক্ত শিক্ষা পদ্ধতির আলোচনা প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে।

ইতালির টাসকানি প্রদেশের পার্বত্য এলাকার বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন এক জনবসতি বারবিয়ানা। এই জনপদের অধিবাসীদের বেশিরভাগ কৃষি শ্রমিক। সেখানে ছিল একটি ছোট গির্জা। আর এই গির্জার পাদ্রী জন লরেনজো মিলানী। তিনি দেখতে পেলেন বারবিয়ানায় বিদ্যাশিক্ষা ব্যবস্থার পরিপূর্ণ অনুপস্থিতি। বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই পরীক্ষায় ফেল করে স্কুল ছেড়ে দেয়। স্কুলে শিক্ষাদান পদ্ধতির বিষয়ে তাদের তিক্ততার শেষ নেই। সে তিক্ততা তাদের নিরুৎসাহিত করেছে ও চিড় ধরিয়েছে আত্মবিশ্বাসে। এরপর মিলানী ১০/১২টি ছেলেকে জড়ো করলেন। পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হলো তাদের। বয়সে বড় যারা তারা ছোটদের পড়াবার জন্য সময় দিতে লাগলো। তাদের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব সমস্যাবলী নিয়ে অনুশীলন আর সেসব সমস্যার ভেতরে প্রবেশের চেষ্টায় অনেকটা সময় কাটতো। এই কাজের মধ্য দিয়ে এক বছর সময় ধরে বিশেষ একটা পরিকল্পনার রূপায়ন হিসেবে, এই অপ্রাতিষ্ঠানিক স্কুলের আটজন ছাত্র মিলে লিখেছে ‘আপনাকে বলছি স্যার’ বইটি। 

এক বছরের পরিশ্রমে যুক্তিসমৃদ্ধ এই বইটিতে সহজ সরল ভাষায় স্পষ্টভাবে ইতালীয় শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির বিভিন্ন দিক চিহ্নিত হয়েছে। তারা দেখিয়েছেন কিভাবে বিষয় নির্বাচন, শিক্ষণপদ্ধতির ব্যবহার- সবই শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ব্যবহৃত হয় বেশিরভাগ ছাত্র/ছাত্রীর জন্য নিপীড়নের হাতিয়ার রূপে। শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত, প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে তারা কিভাবে সফল হয়েছিল তাও তারা দেখিয়েছেন।

অন্যদিকে জাপানের তোমোএ গাকুয়েন স্কুলের শিশুরা হাঁটতে হাঁটতে, ঘুরতে ঘুরতে, সাঁতার কাটতে কাটতে,  ফুল- পাতা, প্রজাপতি দেখে দেখে শেখে প্রাণিবিদ্যা, ইতিহাস, শারীরবিদ্যা। নদী, পাহাড়, সমুদ্র ঘুরে ঘুরে শেখে জীবনের প্রয়োজনীয় শিক্ষা। আর সে তো এক মজার জায়গা। যেখানে শিশু শুধু শেখেই না জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুঃসাহসিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে। তত্ত্বচানের স্কুল তোমো এ গাকুয়েন। এই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল তত্ত্বচানের মতো চঞ্চল প্রকৃতিপ্রেমিক, তেমনি ছিল প্রতিবন্ধীসহ নানান ধরনের শিক্ষার্থীও। স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল- এদেরকে বিভিন্ন স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোবাইয়াশি সোসাকুর বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে শিশু উপযোগী শিক্ষাপদ্ধতির ফলে ঝড়ে পড়া শিশুরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে। 

‘জানালার ধারে তত্ত্বচান’ বইটিতে তত্ত্বচানের ছোটবেলার ঘটনার মধ্য দিয়ে কোবাইয়াশির পাঠদান পদ্ধতির বর্ণনা করা হয়েছে। যা আমাদের পাঠদান পদ্ধতির ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শৈশবে যখন শিক্ষার হাতে খড়ি হয়, তখন ভারত উপমহাদেশে উপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত। ইংরেজ শিক্ষাচিন্তা দ্বারা পরিব্যাপ্ত মেকলে শিক্ষাপদ্ধতি সুপ্রতিষ্ঠিত। মেকলে ভারতবিদ্যা বা ভারতীয়দের সম্পর্কে খুবই উন্নাসিক ছিলেন। তিনি ভারতীয়দের জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন- ‘সারা প্রাচ্যের জ্ঞান ইউরোপের একটি বইয়ের তাকের সমান।’ তিনি তখন তার বিখ্যাত ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’ ভারতবাসীর উপর চাপিয়ে দেন। 

তিনি বলেন, ভারতবর্ষের শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে এমন এক শ্রেণি তৈরি করা, যারা শুধু চামড়ায় হবে ভারতীয়, কিন্তু মন মানসিকতায় হবে ইউরোপীয়। আর শিক্ষার সুযোগ দেয়া হবে উচ্চ শ্রেণিকে। এ থেকে বোঝা যায় ইংরেজরা কতো সুদীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে ভারতীয়দের মন-মানসিকতা পরিবর্তনের কাজে হাত দিয়েছিলেন। তাই ইংরেজরা শারিরীকভাবে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে চলে গেলেও তাদের উপনিবেশিক চিন্তা আজও আমাদের মধ্যে প্রবলভাবেই প্রবাহমান।

রবীন্দ্রনাথ তাই শিক্ষার সূচনাকালে এই শিক্ষাব্যবস্থার ভয়ংকর রূপ নিজের জীবনাভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছিলেন। রবীন্দ্র শিক্ষা-চিন্তার প্রথম প্রকাশ আমরা দেখতে পাই ১৮৭৭ সালে যখন তার বয়স ১৬ বছর। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্যের’ একটি সমালোচনা লিখতে গিয়ে তিনি লেখেন,

“বঙ্গদেশে এখন এমনি সৃষ্টিছাড়া শিক্ষাপ্রণালী প্রচলিত হইয়াছে যে তাহাতে শিক্ষিতেরা বিজ্ঞান দর্শনের কতকগুলি বুলি এবং ইতিহাসের সাল ঘটনা ও রাজাদিগের নামাবলী মুখস্ত করিতে পারিয়াছেন বটে, কিন্তু তাহাতে তাঁহাদের রুচিরও উন্নতি পারেন তাই বা স্বাধীনভাবে চিন্তা করিতেও শিখেন নাই।”

এই ‘সৃষ্টিছাড়া শিক্ষাপ্রণালী’র সরাসরি রূপ তিনি শৈশবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন খুব মর্মান্তিকভাবে। তাই ১২ বছর বয়সে নর্মাল স্কুল থেকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হওয়া মাত্র তিনি স্কুল থেকে পালিয়েছিলেন অবলীলায়। এই শিক্ষাব্যবস্থা কী নির্মম, পাশবিক ও হৃদয়হীন হতে পারে তা তিনি শৈশবেই উপলব্ধি করেছিলেন। তার ‘জীবনস্মৃতি’ পাঠমাত্রই জানতে পারবেন- তার শৈশবের শিক্ষা কি নিদারুণ, প্রাণহীন, আনন্দহীন ও যান্ত্রিক। সে শিক্ষার বিড়ম্বনা তার আজীবন মনোযন্ত্রণার কারণ হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ যেমন শৈশবে শিক্ষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েছিলেন, তেমনি আমাদের দেশের শিশুরা এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। শিশুর সাথে জীবনের কোনো সংযোগ নেই। মানুষের জীবনের অনেকগুলো ধাপ থাকে। একটি শিশু শৈশব, যৌবন,  কৈশোর পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বে পদার্পণ করে। শিশুর বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা প্রদানও তাই একই রকম হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমাদের দেশের পরিবার ও স্কুলগুলোর দিকে তাকালেই এর ভয়াবহ রূপ পরিলক্ষিত হয়। কী নির্মম, নিদারুণ বোঝা চাপিয়ে দিয়ে শিশুদেরকে ‘মানুষ’ করার চেষ্টা চলছে। আসলে তারা তো ‘মানুষ’ হয় না। হয় শিক্ষার চাপে পিষ্ট একজন প্রাণিবৎ মানুষ। 

একটি শিশুর শিক্ষার প্রথম পর্যায় হওয়া উচিত ভাষার সাথে পরিচয় করে দেয়া। এই ভাষা শিক্ষাটা অবশ্যই আশে-পাশের পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষণ মারফত হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, শিশুর ভাষা শিক্ষার জন্য ওয়ার্ড বুক চাপিয়ে দেয়া হয়। এভাবে শুরু হয় মুখস্ত বিদ্যার কল বানানোর প্রথম পর্যায়। আর শিশুর শৈশবে ভাষা জ্ঞানটা হওয়া উচিত মাতৃভাষায়। তাহলে একটি শিশুর মধ্যে শিক্ষার সাথে জীবনের সামঞ্জস্য সাধন ঘটবে। 

তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমাদের বাল্যকালের শিক্ষায় আমরা ভাষার সহিত ভাব পাই না। আবার বয়স হইলে ঠিক তাহার বিপরীত ঘটে, যখন ভাব জুটিতে থাকে তখন ভাষা পাওয়া যায় না। এ কথাও পূর্বে উল্লেখ করিয়াছি যে, ভাষাশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ভাবশিক্ষা একত্রে অবিচ্ছেদ্যভাবে বৃদ্ধি পায় না বলিয়াই য়ুরোপীয় ভাবের যথার্থ নিকটসংসর্গ লাভ করি না এবং সেই জন্যই আজকাল আমাদের অনেক শিক্ষিত লোক য়ুরোপীয় ভাব সকলের প্রতি অনাদর প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। অন্যদিকেও তেমনি ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই আপনার মাতৃভাষাকে দৃঢ় সম্বন্ধ রূপে পান নাই বলিয়া মাতৃভাষা হইতে তাঁহারা দূরে পড়িয়া গেছেন এবং মাতৃভাষার প্রতি তাঁহাদের একটি অবজ্ঞা জন্মিয়া গেছে। বাংলা তাঁহারা জানেন না সে কথা স্পষ্টরূপে ¯স্বীকার না করিয়া তাঁহারা বলেন, ‘বাংলায় কি কোন ভাব প্রকাশ করা যায়? এ ভাষা আমাদের  মতো শিক্ষিত মনের উপযোগী নহে।’ প্রকৃত কথা আঙুর আয়ত্তের অতীত হইলে তাহাকে টক বলিয়া উপেক্ষা আমরা অনেক সময় অজ্ঞাত সারে করিয়া থাকি...।” (শিক্ষার হেরফের)

রবীন্দ্রনাথের উপরোল্লিখিত বক্তব্যটি আমাদের দেশে প্রচলিত ইংলিশ মিডিয়াম এবং ও-লেভেল, এ-লেভেল পর্যায়ের স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রতি দৃষ্টি দিলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। আমরা এক ধরনের পরগাছা শ্রেণির নাগরিক যেন তৈরি করছি। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য সর্বোপরি মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা এদের মধ্যে বিকাশ লাভ করে না। তারা অবস্থান করে এ দেশে কিন্তু তাদের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভবিষ্যত পরিকল্পনা তৈরি হয় ইউরোপ-আমেরিকার আদলে। তাই তারা নিজ দেশে থেকেও পরবাসী।

আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বড় ত্রুটি হলো মুখস্তবিদ্যায় ছাত্রদেরকে পারদর্শী করে তোলা। যে শিক্ষার সাথে কোনো আনন্দ নেই, সেই শিক্ষায় কেউ মননশীল, সৃষ্টিশীল মানুষ হতে পারে না। আর সৃষ্টিশীলতা ব্যতীত শিক্ষার কোনো মূল্যও নেই। 

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা-কিছু নিতান্ত আবশ্যক তাহাই কণ্ঠস্থ করিতেছি। তেমন করিয়া কোনোমতে কাজ চলে মাত্র, কিন্তু বিকাশ লাভ হয় না। হাওয়া খাইলে পেট ভরে না, আহার করিলে পেট ভরে; কিন্তু আহারটি রীতিমত হজম করিবার জন্য হাওয়া খাওয়ার দরকার। তেমনি একটা শিক্ষাপুস্তকে রীতিমত হজম করিতে অনেকগুলি পাঠ্যপুস্তকের সাহায্য আবশ্যক। আনন্দের সহিত পড়িতে পড়িতে পড়িবার শক্তি অলক্ষিতভাবে বৃদ্ধি পাইতে থাকে; গ্রহণশক্তি ধারণাশক্তি চিন্তাশক্তি বেশ সহজে এবং স্বাভাবিক নিয়মে বললাভ করে...।” (শিক্ষার হেরফের)

নিজের প্রতি, জীবন ও জগতের প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধের শিক্ষাটা কোনো শিশুই মাতৃগর্ভ থেকে শিখে আসে না। পরিবারে, স্কুলে তাকে শেখাতে হয়। পাঠ্যপুস্তকের ও সহপাঠ বইয়ের আশ্রয়ে ও শিক্ষা-ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে শিশুকে শেখাতে হয় কী করে দেশ, দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশকে আপন করে নেবে; কী করে দেশের মহৎ অর্জনগুলোকে ভালোবাসতে ও সম্মান করতে শিখবে, জাতি-ধর্ম-গোত্র-ধনী-দরিদ্র-সকল মানুষকে কী করে ভালোবাসতে, শ্রদ্ধা করতে, সম্মান করে শিখবে। 

এই শিক্ষাই সর্বাগ্রে জরুরি। শুধু কাগজ-কলমে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে শিশুর সুনাগরিক হয়ে ওঠার দক্ষতা পরিমাপ করা যায় না; পরিশীলিত মানুষ হয়ে ওঠার প্রবণতা যাচাই করা যায় না। এর জন্য দরকার নিবিড় পরিচর্যা। শিশুর সকল সম্ভাবনাকে বিবেচনায় রেখে গভীর মমতা ও স্নেহ দিয়ে তাদের শিক্ষিত করে তোলা দরকার। 

রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে বলেছেন, “ছেলে যদি মানুষ করিতে চাই তবে ছেলেবেলা হইতেই তাহাকে মানুষ করিতে আরম্ভ করিতে হইবে; নতুবা সে ছেলেই থাকিবে, মানুষ হইবে না। শিশুকাল হইতেই, কেবল স্মরণশক্তির উপর সমস্ত ভর না দিয়া, সঙ্গে সঙ্গে যথা পরিমাণে চিন্তা-শক্তি ও কল্পনাশক্তির স্বাধীন পরিচালনার অবসর দিতে হইবে। সকাল হইতে সন্ধ্যা কেবলই লাঙল দিয়া চাষ এবং মই দিয়া ঢেলা ভাঙ্গা, কেবলই ঠেঙালাঠি মুখস্থ এবং একজামিন আমাদের এই ‘মানব-জনম’- আবাদের পক্ষে, আমাদের এই দুর্লভ ক্ষেত্রে সোনা ফলাইবার পক্ষে যথেষ্ট নহে। এই শুষ্ক ধুলির সঙ্গে, এই অবিশ্রাম কর্ষণ পীড়নের সঙ্গে রস থাকা চাই।” (শিক্ষার হেরফের)

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আর একটা বড় গলদ হলো শিক্ষার দর্শন বিষয়ে। এ কথাটি পুরোপুরি মিলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ সনদ বিক্রির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাইতো দেখা যায় বাজারের পণ্যের চাহিদার মতো করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয়ের মূল্য নিরূপিত হচ্ছে। তাই দেখা যাচ্ছে, মানবিক বিষয়গুলোর চেয়ে বাণিজ্য বিষয়গুলো পড়তে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আগ্রহ প্রবল। আর যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.বি.এ., এম.বি.এ. বা কম্পিউটার সায়েন্স, চিকিৎসাবিদ্যা ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে অধ্যয়ন করে, তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই মানসিকতা বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিতে বেশি বেতনের চাকরি পাওয়ার। অর্থাৎ তাদের কাছে শিক্ষা মানবিকবোধ, চেতনা বিকাশের কোনো মাধ্যম নয়; এখন এটা শুধুমাত্র ব্যবসা ও মুনাফা লোটার মাধ্যম। 

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আর একটা বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অর্জিত শিক্ষার সাথে ব্যবহারিক জীবনের বিস্তর ফারাক। যেমন-তত্ত্বীয় বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেও খুব স্বাভাবিকভাবেই কু-সংস্কার, আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা ও সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা দ্বারা নিজেকে চালিত করা। আবার এও দেখা যায়, বিজ্ঞানের কোনো সূত্রের সাথে ধর্মীয় গ্রন্থের কোনো ঘটনা, শ্লোক বা আয়াত প্রমাণের চেষ্টা করা। ধর্ম হলো বিশ্বাসের বিষয়, আর বিজ্ঞান-দর্শন হলো যুক্তি ও পরীক্ষার বিষয়। এই বিষয়গুলো ঘটে সিলেবাসে শুধু বিষয়ের বিষয়ীকরণ করার কারণে। কারণ-যে শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, প্রকৌশল বা চিকিৎসা বিদ্যায় অধ্যয়ন করে, তারা শুধু ওই বিষয়ের উপরই পড়াশোনা করে। এসব বিষয়ের সিলেবাসে সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞানের ইতিহাস ও দর্শন, ইতিহাসের দর্শন প্রভূতি বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত থাকে না। তাই শিক্ষার্থীরা এক ধরনের একমুখী জ্ঞান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ অর্জন করে ও পরগাছা গোত্রের মানুষে রূপান্তরিত হয়। 

তাই রবীন্দ্রনাথ তার ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে বলেছেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় হইতেও আমরা সেই ডিগ্রীর টাকশালের ছাপ লওয়াকেই বিদ্যালাভ বলিয়া গণ্য করিয়াছি। ইহা আমাদের অভ্যাস হইয়া গেছে। আমরা বিদ্যা পাই বা না পাই বিদ্যালয়ের একটা ছাঁচ পাইয়াছি। আমাদের মুশকিল এই যে, আমরা চিরদিন ছাঁচের উপাসক। ছাঁচে-ঢালাই করা রীতিনীতি চাল-চলনকেই নানা আকারে পূজার অর্ঘ্য দিয়া এই ছাঁচ-দেবীর প্রতি অচলা ভক্তি আমাদের মজ্জাগত। সেই জন্য ছাঁচে ঢালা বিদ্যাটাকে আমরা দেবীর বরদান বলিয়া মাথায় করিয়া লই; ইহার চেয়ে বড়ো কিছু আছে এ কথা মনে করাও আমাদের পক্ষে শক্ত।”

আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে চিন্তাশক্তি বাড়ানোর ও সৃষ্টিশীল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই শিক্ষাপদ্ধতিতে ভালো শিক্ষার্থী নির্ধারণের মাপকাঠি হলো- পরীক্ষার খাতায় কে কতো ভালোভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, তার উপর নির্ভর করে ভালোত্ব নির্বাচন। কিন্তু চিন্তা যে নিরন্তর চর্চার বিষয় ও চর্চায় মাধ্যমেই শিক্ষার্থী  উন্নততর ও জটিল চিন্তায় ব্যাপৃত হতে পারে, এ বিষয়টি কখনো বিবেচনায় আনা হয় না। অধিকন্তু প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নোট মুখস্থ করার জোর প্রতিযোগিতা। আর এর মাধ্যমে ঘটে পরীক্ষার পাশের সনদ। মুখস্ত করার এই ভয়ংকর প্রবণতাকে রবীন্দ্রনাথ চৌর্যবৃত্তির সাথে তুলনা করেছেন। ‘শিক্ষা’ নামক গ্রন্থের ‘শিক্ষার বাহন’,  এবং ‘শিক্ষার সাঙ্গীকরণ’ নামক প্রবন্ধে পরীক্ষা পাসের জন্য শিক্ষার্থীদের মুখস্তনির্ভরতার প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। 

তিনি তার ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “কেননা মুখস্থ করিয়া পাশ করাই তো চৌর্যবৃত্তি। যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লাইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায়, সেই বা কম কী করিল? সভ্যতার নিয়ম অনুসারে মানুষের স্মরণশক্তির মহলটা ছাপাখানায় অধিকার করিয়াছে। অতএব, যারা বই মুখস্ত করিয়া পাশ করে তারা অসভ্যরকমে চুরি করে, অথচ সভ্যতার যুগে পুরষ্কার পাইবে তারাই?”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু ঔপনিবেশিক শিক্ষাদর্শনের বিরোধিতাই করেননি, পাশাপাশি এ শিক্ষাদর্শনের বিপরীতে নতুন শিক্ষা পদ্ধতি বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছেন। যা আজও কালের সাক্ষী হয়ে চারদিকে সুবাতাস ছড়াচ্ছে।

তবে একটি কথা না বললেই নয় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির যে সব ত্রুটির কথা বলেছেন, সেসব কিভাবে সমাধান হতে পারে তা তিনি মূল সমস্যার জায়গা থেকে উপলব্ধি করতে পারেননি। অর্থাৎ একটি দেশের রাষ্ট্র পরিচালনাকারী গোষ্ঠী যেভাবে জনগণকে রাষ্ট্রের অনুগত রাখতে চান, তারা সেভাবেই রাজনৈতিক পলিসির পাশাপাশি রাষ্ট্র কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়সহ শিক্ষাপদ্ধতিও তাদের মতো করে ঢেলে সাজাবেন, এটাই স্বাভাবিক বিষয়। 

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়ে শুধু পাঠপদ্ধতি ও সিলেবাস এর যথার্থ ত্রুটি নির্দেশ করেছেন। পরিশেষে বলা যায়, রবীন্দ্র শিক্ষাদর্শনের আলোকে ও বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত ঔপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মাধ্যমেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিগুলোকে শনাক্ত ও সমাধানের রূপরেখাই শিক্ষাব্যবস্থাকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //