কভিড-১৯ ইস্যুতে কাশ্মীরিদের কণ্ঠরোধ করছে ভারত

যখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে কভিড-১৯ মহামারি, সেই সঙ্গে বন্ধ রয়েছে প্রায় সব বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড; তখন ভারত সরকার আরেক দফা দমন অভিযান চালাচ্ছে সেনানিয়ন্ত্রিত অবরুদ্ধ কাশ্মীরিদের ওপর। স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনরত যোদ্ধাদের হত্যা, গণগ্রেফতার, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়াসহ ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী ও নাগরিকসেবা কর্মীদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে।

‘ভারত করোনাভাইরাস সংক্রমণের ইস্যুকে কাশ্মীরিদের কণ্ঠরোধে ব্যবহার করছে। আমি কাশ্মীরি সহনাগরিকদের জন্য চিন্তিত। গত সপ্তাহে আমি দোকান থেকে খাবার ও ওষুধ নিয়ে অটোরিকশায় করে বাড়ি ফিরছিলাম। একটি চেকপোস্টে ভারতীয় বাহিনী আমায় আটকে জানিয়ে দিলো যে, ওই পথে আমি বাড়ি ফিরতে পারব না। আমি প্রতিবাদ করলে কালো মুখোশধারী বাহিনী আমার দিকে তেড়ে আসে। আমার মনে পড়ে গেল ১৬ বছর আগের কথা, তখন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার সময় ভারতীয় বাহিনী আমায় বেধড়ক মারধর করেছিল। অবস্থা এখনো একইরকম আছে। তাদের মার খাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমাকে পাঁচ মাইল ঘুরে বাড়ি ফিরতে হলো।’

তারিক মীর


জম্মু-কাশ্মীরে এখন প্রায় ছয় লাখ সেনা মোতায়েন করেছে ভারতীয় সরকার, প্রতি ১২ জন কাশ্মীরির জন্য একজন ভারতীয় সেনাসদস্য বরাদ্দ রয়েছে। যা কাশ্মীরকে বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকায়িত অঞ্চলে পরিণত করেছে। কাশ্মীরিদের মতে, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘উন্মুক্ত কারাগার’। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করার অধিকার দিত, ওই অনুচ্ছেদ রাজ্যটিকে নিজস্ব সংবিধান, আলাদা পতাকা এবং আইন তৈরি করার অনুমোদন দেয়। পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ বিষয়ক নিযন্ত্রণ থাকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। অন্তত কাগজ-কলমে জম্মু-কাশ্মীর নাগরিকত্ব, সম্পদের মালিকানা এবং মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত আইন নিজেরা তৈরি করার ক্ষমতা রাখত। ৩৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুসারে, কোনো অ-কাশ্মীরি ভারতীয় নাগরিক কাশ্মীরে বসবাস করতে পারতেন; কিন্তু সেখানে কোনো জায়গা-জমি, শিল্প বা ব্যবসার মালিক হতে পারতেন না। গত বছরের আগস্টে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদি সরকার। কাশ্মীরকে এমনকি রাজ্যের মর্যাদা থেকেও খারিজ করা হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ভেঙে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে, জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ। আশঙ্কা করা হচ্ছে- নিজ ভূখণ্ডে কাশ্মীরিরা আগামীতে সংখ্যালঘুও হয়ে পড়তে পারেন। ডেমোগ্রাফির এ পরিবর্তন মৌলিকভাবে আগামী দিনের ইতিহাস বদলে দিতে পারে। কাশ্মীরিরা গত আগস্ট থেকেই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করছিলেন। সব রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, এমনকি ভারতপন্থী ও বিজেপির শরিক সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিও বাদ যাননি।

লকডাউন মানে হলো- জনগণের চলাচল অবরুদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করা। গোটা বিশ্বের কাছে তা নতুন কিছু হতে পারে, তবে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের অধিবাসীদের নিয়ন্ত্রিত চলাচলে জীবন কাটাতে হয়। রাজধানী শ্রীনগরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগেও কাঁটাতারের ব্যারিকেড আর সুসজ্জিত ভারতীয় সেনাদের টহল ছিল নিয়মিত সাধারণ ঘটনা, এখনো সেরকমটাই আছে। দেখলে অনেকটা মনে হবে যেন, করোনাভাইরাস হিংস্র কোনো প্রাণী, যা মারতে এত সমরাস্ত্রের ঝনঝনানি। একবার তাকে ধরতে পারলে টর্চার সেলে ঢুকিয়ে দেয়া হবে, তারপর গুম করে দেয়া হবে; যেমনটা করা হয়েছে অনেক সাধারণ কাশ্মীরিদের ক্ষেত্রে। 

কাশ্মীরি সাংবাদিক তারিক মীর বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ফোন ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রেখে; ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে কথিত সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র ভারতে ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী সরকার কাশ্মীরে গণতন্ত্রের পাঠ শেখাচ্ছিল। তবে এখন মহামারিকালে ভয়, হতাশা এবং দমন এক নতুন স্তরে প্রবেশ করেছে।’

বর্তমানে উপত্যকার হাতেগোনা কয়েকজন কাশ্মীরি যাদের ল্যান্ডফোন, পোস্টপেইড বিএসএনএল সংযোগ ও ব্রডব্যান্ড সংযোগ রয়েছে, তারাই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছেন। ভারতজুড়ে স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা চলছে, অথচ কাশ্মীরে চিকিৎসা পাচ্ছেন না অসুস্থরা। এক ডাক্তার টুইট করে জানান, যারা জরুরি সার্জারির জন্য আসছেন, তাদের সবাইকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। ফোনলাইন বন্ধ থাকার কারণে তারা অপারেশন থিয়েটারের স্টাফদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। অনেক স্বাস্থ্যকর্মীকে মারধর করার অভিযোগও এসেছে। পেশায় সাংবাদিক আরেক ব্যক্তি জানান, তার বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত। তিনি বেশ কয়েকজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞকে ফোন করেছেন; কিন্তু কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি, কারণ তাদের কারোরই বিএসএনএল সংযোগ নেই। এরই মধ্যে কাশ্মীরে প্রায় এক হাজার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। 

গত আগস্টে নতুন করে দমনাভিযান শুরুর পর কথিত রাষ্ট্রদ্রোহ বা সরকারবিরোধী তৎপরতার অজুহাতে ভারত আড়াই হাজারেরও বেশি কাশ্মীরিকে গ্রেফতার করে। কভিড-১৯ সংক্রমণের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যখন যুদ্ধ বিরতি চলছে, তখন ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলছে! চলতি বছরের এপ্রিল থেকেই ওই তৎপরতা শুরু হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হালকা মাত্রায় গোলাগুলির সময়ে ভারতীয় বাহিনী সীমান্ত এলাকার জনগণকে না সরিয়ে তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। এর ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে অন্তত আট কাশ্মীরি নিহত হন। সেই সঙ্গে শুরু হয় সহিংস পন্থায় ভারতীয় বাহিনীর দমনাভিযান। গত ৬ মে সকালে বিদ্রোহী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের শীর্ষ কমান্ডার রিয়াজ নাইকুকে হত্যা করে ভারতীয় বাহিনী। ২০১৬ সালে আরেক হিজবুল কমান্ডার বুরহান ওয়ানি নিহতের পর সংগঠনটির হাল ধরেন রিয়াজ। হিজবুল কমান্ডার নিহতের পর থেকেই প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে কাশ্মীরি জনগণ। ভারতীয় বাহিনীর চালানো পেলেট ও গুলিতে এক নারী নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। 

কোনো সমালোচনা সহ্য করতেই রাজি নয় ভারত। স্বাভাবিকভাবেই কণ্ঠ রোধ করতে আক্রমণ আসে সাংবাদিকতার ওপর। তিন সাংবাদিক মাশরাত জাহরা, পিরজাদা আশিক এবং গওহর গিলানীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধারায় মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে দু’জনের নামে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দেয়া হয়েছে। অন্তত ১২ জন সাংবাদিককে আটক করা হয়েছে। 

তারিক মীর বলেন, ‘ভারত করোনাভাইরাস সংক্রমণের ইস্যুকে কাশ্মীরিদের কণ্ঠরোধে ব্যবহার করছে। আমি কাশ্মীরি সহনাগরিকদের জন্য চিন্তিত। গত সপ্তাহে আমি দোকান থেকে খাবার ও ওষুধ নিয়ে অটোরিকশায় করে বাড়ি ফিরছিলাম। একটি চেকপোস্টে ভারতীয় বাহিনী আমায় আটকে জানিয়ে দিলো যে, ওই পথে আমি বাড়ি ফিরতে পারব না। আমি প্রতিবাদ করলে কালো মুখোশধারী বাহিনী আমার দিকে তেড়ে আসে। আমার মনে পড়ে গেল ১৬ বছর আগের কথা, তখন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার সময় ভারতীয় বাহিনী আমায় বেধড়ক মারধর করেছিল। অবস্থা এখনো একইরকম আছে। তাদের মার খাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমাকে পাঁচ মাইল ঘুরে বাড়ি ফিরতে হলো।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //