করোনার মাঝে রহমতের মাস রমজান

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে মহাদুর্যোগের মধ্যে মহান রাব্বুল আলামিনের রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের অমিয় বারতা নিয়ে শুভাগমন করেছে হিজরি ১৪৪১ সালের মাহে রমজানুল মোবারক। বনি আদমের প্রতি মহান আল্লাহর অশেষ রহমত বর্ষণের মাস রমজান। সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজের পরিশুদ্ধি অর্জন, মহান প্রভুর সান্নিধ্য ও সন্তোষ অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে আগমন করে এ মাস।

এ মাসের প্রধান ইবাদত সিয়াম বা রোজা। সিয়াম শব্দের আভিধানিক অর্থ নিবৃত্ত থাকা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে পানাহার ও কামাচার থেকে নিবৃত্ত থাকার নাম সিয়াম। রমজানের পুরো মাস সিয়াম পালন করা ইসলামের পাঁচটি মৌলিক বিষয়ের মধ্যে একটি।

বিশ্ব মানবতার ইহ, পারলৌকিক সার্বিক কল্যাণ ও সাফল্যের একমাত্র নিয়ামক ইসলামের আখেরি নবী রাহমাতুল্লিল আলামিন। তিনি মদিনায় হিজরত করে যাওয়ার পর দ্বিতীয় বছরে রমজানের সিয়াম পালনের বিধান নিয়ে নাজিল হয় কোরআন মজিদের সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতটি। ঘোষণা করা হয়, হে মুমিনরা, তোমাদের প্রতি সিয়াম পালন আবশ্যিক করা হলো, যেমন তা আবশ্যিক করা হয়েছিল তোমাদের আগে যারা ছিল তাদের প্রতি, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।

এ আয়াত নাজিল হওয়ার পর প্রথম রমজান আগমনের আগে হজরত মুহম্মদ (সা.) সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে এক নাতিদীর্ঘ ভাষণ দেন, যা বায়হাকি শরিফে সংকলিত হয়েছে। এতে তিনি রমজানের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও করণীয় সম্পর্কে উম্মতকে অবহিত করেন। হজরত সালমান ফারসি (রা.) বর্ণনা করেন, শাবান মাসের শেষে রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। বললেন, লোকেরা, তোমাদের ওপর এসে পড়েছে এক মহান মাস, বরকতময় মাস। এ মাসে একটি রাত রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তায়ালা এ মাসের সিয়াম ফরজ ও (ইবাদতের উদ্দেশ্যে) রাতে জেগে থাকা ঐচ্ছিক করেছেন। এতে যে ব্যক্তি কোনো নেক কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করবে, তার জন্য থাকবে অন্য মাসে একটি ফরজ আদায়ের সমান প্রতিদান। আর যে ব্যক্তি এতে একটি ফরজ আদায় করবে, তার জন্য থাকবে অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায়ের সমান প্রতিদান। যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার জন্য রয়েছে পাপ মোচন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং রোজাদারের মতোই তাকে প্রতিদান দেয়া হবে। কিন্তু রোজাদারের প্রতিদান কমানো হবে না। প্রশ্ন করা হলো- হে আল্লাহর রাসূল, রোজাদারকে ইফতার করানোর মতো সামর্থ্য আমাদের প্রত্যেকের নেই। তিনি বললেন, যে কেউ কোনো রোজাদারকে একটু দুধ, একটি খেজুর কিংবা একটু পানীয় দিয়ে ইফতার করাবে, তাকেই আল্লাহ তায়ালা এ প্রতিদান দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্ত করে আহার করাবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে হাউজে কাওছার থেকে পানি পান করাবেন। এ মাসের প্রথম ভাগে রহমত, মধ্যভাগে মাগফিরাত ও শেষভাগে রয়েছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি। এটা ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত। এটা সমবেদনার মাস। এ মাসে মুমিনের রিজিক বাড়িয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি তার অধীনের কাজের ভার লাঘব করবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন। তাছাড়া বুখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত আছে, নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ইমান ও ইহতিসাবের সঙ্গে যে ব্যক্তি সিয়াম আদায় করবে, তার এর আগেকার পাপগুলো মাফ করে দেয়া হবে।

তিরমিজি শরিফে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বরাতে বর্ণিত আছে, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, রমজানের প্রথম রাত এলে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শিকলবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর কোনো দরজা আর খোলা হয় না। জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। এরপর কোনো দরজা আর বন্ধ করা হয় না। আর একজন ঘোষক ঘোষণা করেন, হে কল্যাণপ্রার্থী, তুমি এগিয়ে এসো। আর হে অকল্যাণ প্রত্যাশী, তুমি নিবৃত্ত হও। আল্লাহ অনেককে মুক্তি দেবেন। প্রতিটি রাতে এভাবে ঘোষণা চলতে থাকে।

নেক কাজে উদ্যোগী হওয়া ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা সব সময়ই জরুরি; কিন্তু এ মাসে তাতে আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কেননা আল্লাহর অপার রহমত নাজিল হওয়ার মাসে নেক কাজ সম্পাদন ও অন্যায় কাজ বর্জনের মাধ্যমে নিজেকে ভাগ্যবানদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা বুদ্ধিমানের কাজ। বিশেষ করে তাকওয়া অর্জনের যে উদ্দেশ্য সিয়াম পালনের মধ্যে নিহিত, তা সফল হতে হলে রমজানের প্রথম মুহূর্ত থেকেই সযত্নে চেষ্টা চালানো প্রয়োজন। 

রমজান মুমিনের জীবন সাজানোর শ্রেষ্ঠ সময়। এই মাসকে কাজে লাগাতে হলে আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ জরুরি। পূর্ব প্রস্তুতি থাকলে রমজানের ফয়েজ ও বরকত ভালোভাবে অর্জন করা সম্ভব হয়। এজন্য প্রত্যেক মুমিনের উচিত রমজানকে কাজে লাগানোর জন্য আগে থেকে পরিকল্পনা গ্রহণ করা। 

প্রথমে প্রয়োজন সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু আত্মাকে নিষ্কলুষ করা। দীর্ঘ এগারো মাসের পাপাচারের কারণে অন্তরে যে কালিমা লেপন হয়েছে, তা দূর করতে হবে। কুপ্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরতে হবে। সামনের দিনগুলোতে উৎপাত যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাপাচার ত্যাগ করার মনোবৃত্তিই পাপকার্য থেকে বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বড় সহায়ক। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন. ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা, অগোচরে নিন্দা তথা পাপকার্য থেকে বিরত রইল না তার রোজা অর্থহীন উপবাস ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (বুখারি) 

রমজানে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি রাখতে হবে হালাল রিজিকের প্রতি। আর এর জন্য প্রয়োজন হালাল উপার্জন। অন্তত একটি মাসে হালাল রিজিকের প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত। মানুষের জীবনে ব্যস্ততার কোনো অন্ত নেই। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাদের কোনো না কোনো ব্যস্ততা থাকেই। এই ব্যস্ততার কারণে অনেকেই রমজানের পূর্ণাঙ্গ হক আদায় করতে পারেন না। তাদের জন্য উচিত হলো রমজানে সব ঝামেলামুক্ত হওয়া। অন্তত রমজানের এক মাস যেন কাজের চাপ কিছুটা কম থাকে সে ব্যবস্থা করা। রমজানের প্রধান শিক্ষা সংযম। সবকিছুতেই এই শিক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারলে রমজান আমাদের জীবনে সুফল বয়ে আনবে।


মাওলানা লিয়াকত আলী

ইসলামি চিন্তাবিদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //