এক অচেনা গ্রহের অধিবাসী যেন আমরা!

যে দিকেই তাকাই মনে হয় সব জায়গায় বুঝি কভিড-১৯ নামক ভাইরাসটা লেগে আছে। এ ভাইরাসের চেয়ে ভাইরাল এখন আর কিছু নেই। অদেখা, আগন্তুক এক গণশত্রু এ ভাইরাস। মানুষ থেকে মানুষে সে বেঁচে ওঠে। মানুষ মরে যায়, মরণের হাত ধরে ভাইরাসটি অমর হয়ে ওঠে। 

এই পৃথিবী নামক গ্রহটিতে, অনন্ত বিথিকার নিচে আজ আর কেউ কাউকে স্পর্শ করে না, গভীর ভালোবাসা বুকে নিয়েও কেউ কারো কাছে আসে না। সবচেয়ে বড় মস্তিষ্কের প্রাণিটি মস্তিষ্কহীন এক ভাইরাসের ভয়ে, শঙ্কায়, দৌরাত্ম্যে, নিয়ত অসহায়, ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে থাকে। 

অফিস, আদালত, খেলার মাঠ, চেনা রাস্তা, হোটেল, রেস্তোরাঁ- সব কেমন বোবা ল্যাম্প পোস্টের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এমন পৃথিবী কেউ কখনো দেখিনি আগে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, উপাসনালয়, শপিং মল- সবই শূন্য পড়ে আছে। কেবল হাসপাতালগুলো মানুষের মৃতদেহের সাক্ষী হয়ে দিন রাত জেগে আছে।

দুঃসংবাদ আর ভাইরাসটি হাত ধরে ধরে চলে। ভেনিস, মিলান, এথেন্স, লন্ডন, আরস্টারডাম, নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, জাকার্তা, দিল্লি, ঢাকা- পৃথিবীর বিদগ্ধ নগরে আজ শবের মিছিল।

মানুষ তার মস্তিষ্কের অহংকারের আতিশয্যে তৈরি করেছে মিসাইল, যুদ্ধবোমা, যুদ্ধ জাহাজ। দেশে দেশে তৈরি হয়েছে কামান, মর্টার, মেশিনগান। সেই অস্ত্র মানুষ ব্যবহার করেছে শান্তির নামে, স্বাধীনতার নামে, ধর্মের নামে। মানুষ নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। কখনো নিজেদের তৈরি করেনি অন্য এক প্রতিপক্ষের জন্য। যে প্রকৃতিকে মানুষ নিরন্তর ধ্বংস করেছে নির্বিচারে স্বেচ্ছাচারিতার স্টিম রোলার চালিয়ে, একবারও ভাবেনি সেই প্রকৃতি একবার রুখে দাঁড়ালে কী হবে। ভাবেনি লোভের, বেসাতির, পুঁজির পুঁজ জমে জমে একদিন ক্ষয়ে যাবে সভ্যতার তাসের ঘর।

মৃতের মিছিল কে ঠেকাবে, কীভাবে ঠেকাবে আজ আর তা কারো জানা নেই। হাসপাতালে সবার জায়গা হবে না। এই পৃথিবীর বিষণ্ন রাস্তায়, মানুষের লাশ পচে গলে পরে থাকবে। মানুষের আর্ত চিৎকারে এই অচেনা পৃথিবী হয়ে উঠবে এক বিপন্ন মৃত্যুপুরী। 

গত বছরের ডিসেম্বরে উহান নামক নগরে যখন এই যমের অপর নাম ভাইরাসটির জন্ম হলো, তারপর থেকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি অনেক সময়ই পেয়েছিল। মিথ্যার বেসাতি, আর আড়ম্বরের নাগরদোলায় ভাসতে ভাসতে নিজের কর্তব্য ভুলে গিয়ে ভাইরাসকে সুস্বাগত জানিয়েছে দেশটি। আজও এমনকি চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য জোটেনি প্রোটেক্টিভ গিয়ার, পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ, কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্র। আজও মসজিদ, ভজনালয়,পুন্য স্নানে মানুষের স্রোত, মহাসড়কে হাজার হাজার মানুষের কাজে ফেরার ডাক।

রাজধানী ঢাকাকে কার্যত ‘লকডাউন’ করা হয়েছে; আস্তে আস্তে অন্য শহরগুলোও এর আওতায় এসেছে। মহাসড়কে সামাজিক আর দৈহিক দূরত্ব হয়তো কিছুটা দৃশ্যমান হয়েছে; কিন্তু শহরের বস্তিতে বস্তিতে, আনাচে-কানাচে, নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসে আবাসে মানুষ স্মরণকালের সবচেয়ে ঘিঞ্জি সম্মিলিত এক জীবনে প্রবেশ করেছে, যেখানে সামাজিক আর দৈহিক দূরত্ব বলে আর কিছুই নেই যেন। কিছু হাসপাতাল ছাড়া বাকি সব হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। দুরারোগ্য বয়োবৃদ্ধ নাগরিকরা বাড়িতে বসে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। 

মানুষ একটা স্বাভাবিক পৃথিবীতে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে আছে; কিন্তু সেই স্বাভাবিক পৃথিবী আমাদের অতি চেনা ‘স্বাভাবিক’ পৃথিবী আর কখনোই হয়ে উঠবে না বুঝি। যারা বেঁচে থাকবে এই বদলে যাওয়া গ্রহটিতে ‘নতুন স্বাভাবিক’ এক পৃথিবী হয়তো তারা দেখতে পাবে। এই বিশ্ব মহামারি সেই অচেনা এক পৃথিবীতে তাদের নিয়ে যাবে।

করোনাত্তোর পৃথিবী কেমন হবে সে বিষয়ে এখন বলা খুব মুশকিল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পাবলিক হেলথের এক গবেষণা বলেছে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই পৃথিবীর মানুষকে মাস্ক পরে থাকতে হবে এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি দুইয়ে নেমে যেতে পাড়ে। লাখ লাখ লোক বেকার হয়ে যেতে পারে। পরিবহন, ভ্রমণ, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ধস নামতে পাড়ে। বাল্যবিবাহ, পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা বেড়ে যেতে পারে। সারা পৃথিবী এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার দিকে চলে যেতে পারে, যেখানে মার্কিন আধিপত্য কমে গিয়ে মাল্টিপোলার এক বিশ্ব তৈরি হতে পারে। সব মিলিয়ে মানব সম্প্রদায়কে এক নতুন পৃথিবীর ভেতর প্রবেশ করতে হতে পারে, যে পৃথিবী আমাদের সবার প্রায় অচেনা। সেই নিউনরমাল পৃথিবীকে কোনো একক দেশ বা গোষ্ঠী সামাল দিতে পারবে না। আমাদের প্রয়োজন হবে সম্মিলিত উদ্যোগ আর সম্মিলিত প্রয়াস। আমাদের স্বপ্ন ও বাস্তবতা হবে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের পথচলাকে নিশ্চিত করা। ভূ-রাজনীতি ও যুদ্ধ-হানাহানিকে পেছনে ফেলে আমাদের সম্মিলিত মূল্যবোধ ও আশাবাদকে জাগ্রত করা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত করা, নতুন নতুন মহামারিকে মোকাবেলার জন্য বৈশ্বিক ও সম্মিলিত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা, বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে আরো শক্তিশালী ও বেগবান করা- সেই নতুন পৃথিবীর অঙ্গীকার হতে পারে। কভিড-১৯ আমাদের দেখিয়েছে ভেতরে ভেতরে কী এক নাজুক পৃথিবী আমরা তৈরি করেছি। নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনীতি, গোলকায়নের দেউলিয়াত্ব আমরা এখন ভীষণ নগ্নভাবে দেখতে পাচ্ছি। প্রকৃতির এই ভ্রুকুটি আমরা কীভাবে সহ্য করতে পারলাম। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের যে বড়াই, তা আজ ফানুসের মতো উড়ে গেছে। মস্তিষ্কের আর ক্ষমতার বেসাতি, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা আজ মানুষকে বিপন্ন আর অসহায় এক প্রাণিতে পরিণত করেছে। মানুষ হয়ে উঠেছে নিজের বৃত্তে নিজেই বন্দি এক প্রাণী। এই অবরুদ্ধ পৃথিবী থেকে মুক্তির পথ মানুষকেই খুঁজে বের করতে হবে। সেই অস্ট্রেলোপিথেকাস থেকে মানুষ যেভাবে নিয়ান্ডার্থাল হয়েছে, নিয়ান্ডার্থাল থেকে মানুষ যেভাবে হোমো সেপিয়েন্স হয়েছে, যেভাবে সংগ্রাম করে টিকে থেকেছে, সেভাবেই করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে মানুষকে তার মুক্তি, আলো, আর টিকে থাকার পথ খুঁজে বের করতে হবে। 

প্রাকৃতিক নির্বাচনের বন্ধুর পথ অতিক্রম করা মানুষের পক্ষে সেই পথ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হবে বলে মনে হয় না। প্রয়োজন হলো সব অহংকার আর স্বজাতিত্ববোধের গরিমা থেকে বের হয়ে এসে মানব জাতির জন্য বৃহত্তর এজেন্ডা নিয়ে কাজ করা। মানুষের জয় মানুষের আশার মতোই অনুবর্তী।


একেএম মাজহারুল ইসলাম

অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //