করোনা কী শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীবাসীকে

চলতি বছরের প্রথম দিকে প্রথম করোনাভাইরাস চীনের উহান প্রদেশে আঘাত হানে। তারপর ভাইরাসটি পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আঘাত হানতে শুরু করে। এ এমন এক ভাইরাস যার এখন পর্যন্ত নিরাময়ের কোনো ওষুধ বা টিকা আবিষ্কার করতে পারেনি চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা।

বর্তমানে প্রায় অধিকাংশ দেশ নিস্তব্ধ, নীরব অবস্থায় আছে। সবচেয়ে কোলাহলপূর্ণ কোনো শহরের চৌরাস্তায় মানুষের আনাগোনা আর আগের মতো চোখে পড়ছে না। বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, বাসস্টপেজসহ জনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো নীরবতা পালন করছে যেন!

এর আগেও বিভিন্ন সময়ে মরণঘাতী বিভিন্ন ভাইরাস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আঘাত করেছে। সেটা নির্দিষ্ট কিছু ভূখণ্ডের সমস্যা ছিল। ভারতবর্ষেও এক সময় বসন্ত, কলেরা রোগে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর উজার হয়েছে মানুষ, শবদেহে পরিণত হয়েছে; কিন্তু এবারের করোনাভাইরাসটি কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশে আঘাত করেনি। বর্তমানে এটি একটি বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে পৃথিবীবাসীকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। আরো কত দিন এ অবস্থায় দিনাতিপাত করবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। 

চলমান করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী চরম আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার মধ্যে এক অর্থে তার অধিবাসীকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। শেয়ার মার্কেট বড় পতনের সম্মুখীন হয়েছে, বিশ্বের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তলানিতে ঠেকেছে, তেলের দাম কমতে কমতে প্রায় দু’দশকের মধ্যে সবচেয়ে নিচুতে অবস্থান করছে। এমনকি পৃথিবীব্যাপী নিরন্তর যে প্রাণঘাতী যুদ্ধ চলছিল, তারও সাময়িক বিরতি হয়েছে। সৌদি আরব ও ইয়েমেন এ পরিস্থিতিতে শান্তিচুক্তি সই করেছে। যুদ্ধ বিপণন যেসব দেশের ব্যবসা, সেসব দেশেও একটু থমকে আছে।

করোনাভাইরাসের ব্যাপ্তি ও মারণ ক্ষমতার সাথে যদি এর অন্য জ্ঞাতিগুষ্টির তুলনা করা যায়, তাহলে বিশ্বব্যাপী আতঙ্কের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। সার্স ও মার্সের মারণ ক্ষমতা কভিড-১৯-এর চেয়ে বহুগুণ বেশি। আফ্রিকার গরিব দেশ থেকে যে অসুখ সিয়েরা লিওন, গিনি, লাইবেরিয়া, নাইজেরিয়া, মালি, সেনেগাল হয়ে খোদ ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র লন্ডন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে গিয়েছিল সেই ইবোলার মারণ ক্ষমতাও করোনার চেয়ে বহুগুণ বেশি। ইবোলা থেকে যত রোগী ভর্তি হয়েছে তার শতকরা ৫৬ জন মারা গেছেন। ইবোলা নিয়ে সব তথ্য পাওয়া না গেলেও আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলো যে এই সংক্রমণে অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও আমেরিকা ও ইউরোপের গায়ে আঁচ তেমন লাগেনি সে সময়। ইবোলার গড় মৃত্যুহার প্রায় ৩৬-৩৭ শতাংশ হলেও বিশ্বজোড়া গেল গেল রব তেমন শোনা যায়নি। কারণ ইবোলা মনে হয় সে অর্থে করোনার মতো স্পর্শময়ী বা ছোঁয়াছে ছিল না।

আর একটা বিষয় যে, করোনার সাম্যবাদী আক্রমণ। এ কোনো শ্রেণি, পেশা বুঝে আক্রমণ করছে না। করোনা নিয়ে যে আতঙ্ক ও ত্রাস তার দুটি দিক আছে। প্রথমত এই ভাইরাস ধনী ও দরিদ্রকে সমানভাবে আক্রমণ করছে। ইরানের প্রথম সারির এক ডজন ধর্মীয় ও প্রশাসনের কর্মকর্তা ইতোমধ্যে মৃতবরণ করেছেন। ব্রিটেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী প্রথম দিকেই আক্রান্ত হয়েছেন, তারপর একে একে এর শিকারের তালিকা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যুবরাজ চার্লস, প্রধানমন্ত্রী জনসন আক্রান্ত হয়েছেন। সৌদি আরবের রাজ পরিবারের একশ’র বেশি সদস্য আক্রান্ত হয়েছে। করোনার সম্ভাব্য আক্রমণের ছোবল থেকে যে কেউ মুক্ত নন, তাই পৃথিবীর নজর কেড়েছে। নইলে আফ্রিকার দরিদ্র নিপীড়িত কালো মানুষরা যখন আক্রমণে কাবু ছিলেন, তখন আন্তর্জাতিক সুশীল রাজনীতিবিদরা নিশ্চুপ ছিলেন।

করোনা যেমন একদিকে সারাবিশ্বের নজর কেড়েছে, তেমনি বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের কঙ্কালসার চেহারাটাও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থিত করেছে। অর্থাৎ বিশ্বের তাবৎ ধনবাদী রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থার নাজুক পরিস্থিতির স্বরূপ বিশ্ববাসীর কাছে উলঙ্গ করে দিয়েছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বনেদি রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থাও করোনার কাছে হার মেনেছে। বিশ্বে এক অক্ষের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে সম্পদের অসম বণ্টনের ব্যবস্থা করেছে তার সবচেয়ে ভয়াবহ ফল দেখা গেছে জনস্বাস্থ্যে সরকারি বার্ষিক বাজেটে। অস্ত্র ব্যবসার চেয়েও যে চিকিৎসা ব্যবস্থার বাজেট কত যে জরুরি, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখে দিচ্ছে। 

ইউরোপ-আমেরিকার ইন্স্যুরেন্সভিত্তিক চিকিৎসা পরিকাঠামোর ফলে জনসংখ্যার একটা বড় অংশের কাছেই স্বাস্থ্যব্যবস্থার সুফল ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে মার্কিনীসহ ইউরোপের অনেক দেশ যে, ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কিউবা থেকে চিকিৎসা পদ্ধতির শিক্ষা নেয়ার দরকার আছে, সেটিও এ পরিস্থিতি বিশ্ববাসীর কাছে আর একবার স্মরণ করে দিয়েছে।

কিউবা, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলার সংক্রমণ সংখ্যা ও মৃত্যুহার যে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে তড়িৎগতিতে এবং তাদের নিজস্ব ক্যাপাসিটির মাধ্যমে- তা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও প্রশংসা না করে পারেনি। সিঙ্গাপুর আরেকটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ। সেখানে সংক্রমণ বাড়লেও মৃত্যু বাড়েনি কিন্তু। এর বাইরে জাপান, হংকংসহ কয়েকটি দেশ তাৎক্ষণিক উদ্যোগ গ্রহণ করার কারণে পরিস্থিতি অনেক ভালো সেসব দেশে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কেরলা রাজ্যও প্রমাণ করেছে যে মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। অবরুদ্ধ মানুষের জন্য যথাযথ অর্থনৈতিক প্যাকেজ দিয়ে আপৎকালীন ব্যবস্থাও সম্ভব।

জনস্বাস্থ্য অবহেলিত থাকলে দেশ ও পৃথিবীর মানুষ সুস্থ থাকবে না- এটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এ পরিস্থিতি। দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য অভিন্ন, সুষম, আধুনিক ও একক মানের চিকিৎসা ব্যবস্থা যতদিন না দেয়া হবে ততদিন এক একটা মারণব্যাধি আসবে ও দেশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে। দেশের মানুষের সুস্থিতি ও নিরাপত্তার জন্য চাই সব সাম্প্রদায়িক নিয়মের বদলে অভিন্ন আইন, স্বাস্থ্যবাজেটের বৃদ্ধিসহ চিকিৎসা খাতের গবেষণার নজর দেয়া। 

যে দেশে গণতন্ত্র যত প্রসারিত সে দেশের মানুষ তত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় জনস্বাস্থ্য সুন্দরভাবে অনুসরণ করে। আইসল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে ইত্যাদি দেশের জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার দর্শন থেকে আমাদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। দেশের জন্য শুধু ছাপান্ন ইঞ্চির খাঁচা নয়, ছাপান্ন ইঞ্চির হৃদয় চাই।

এখন আলোচনাটাকে একটা স্থির বিন্দুতে নিয়ে আসতে চাই। এক সময় বা এক দিন পৃথিবী থেকে এ মারণ ভাইরাস বিদায় নেবে। কিন্তু আগামী পৃথিবীটাকে আমরা কীভাবে গড়ব, সে বিষয়ে এখনই আমাদের সিদ্ধান্তে আসার আগে এ থেকে শিক্ষা গ্রহণের একটা বিষয় বোধ হয় আছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক, মানসিক বা মনস্তাত্বিক ক্ষেত্রে নানা অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন আসবে। প্রথমে দেখা যাক আর্থিক অসাম্যের বিষয়টি। ধনী-দরিদ্র বিভাজন। শ্রেণি সংঘাতের সাবেকী তত্ত্বের প্রাসঙ্গিতার মূল্যায়ন নতুন করে করতে হবে বুঝি। করোনা আপাতভাবে ধনী-দরিদ্র দু’পক্ষকেই একইভাবে বিপদে ফেলে দিয়েছে। মনে হচ্ছে, আগামী দিনের পৃথিবীতে অন্তত কয়েক দশকের জন্য অর্থান্ধতা, ক্ষমতান্ধতাকে শিকেয় তুলে রাখতে হবে। 

বিশ্ব অর্থনীতির যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের আর্থিক বৃদ্ধির হার শতকরা এক ভাগের সামান্য বেশি হবে। আর ইতালির মতো সুসভ্যতার আলোকপ্রাপ্ত দেশের অর্থনীতির পরিসংখ্যান শূন্যের নিচে চলে যাবে। রেনেসাঁ তো সপ্তদশ শতাব্দীতে হয়েছিল সেখানে। সেখানে সেই দেশের অবস্থা এ রকম দাঁড়াবে।

এরপর আমাদের পরিবেশ, জলবায়ু, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, প্রকৃতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা, দূষণ প্রতিরোধে, স্বাস্থ্য গবেষণায় হয়তো নতুন করে ভাবতে হবে ।

আর সবেচেয়ে বড় যে প্রশ্ন, পরিবর্তন কি হবে আর্থিক অসাম্যভিত্তিক রাজনীতির? আমরা আমজনতা কি এবার বলব, ঢের হয়েছে এই লোক-ঠকানোর রাজনীতি? এবার জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে মানুষের মঙ্গল, মানুষের উন্নয়নের রাজনীতি হোক। পাঁচ দশকের ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ কাটিয়ে, বিশ্বযুদ্ধের কালো ছায়া পেরিয়ে আমরা অনেকটা এগিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আমাদের হিংগ্রতা, সাম্রাজ্যবাদী লোলুপতা ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ পরেও থামেনি। এবারও কি তা থামবে না?

জাপান বলেছে, চিন থেকে সমস্ত জাপানি ব্যবসা প্রত্যাহার করবে। যে লোকসান হবে বেসরকারি সংস্থার, রাষ্ট্র সেই লোকসানের খরচও বইবে। এবার কি চিনবিরোধী এক নতুন রাজনীতি তীব্র হয়ে উঠবে?

মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। একটা সময় অনেকে মনে করেছিল, সমাজতন্ত্র মৃত। মার্ক্সবাদ- লেনিনবাদ অসত্য। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রান্সিস ফুকোয়ামা ঘোষণা করেছিলেন, ইতিহাস মৃত। তবে রিচার্ড ডি উলফ, ‘রিথিঙ্কিং মার্ক্সসিজম’ নামের জার্নালের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, বলেছিলেন, ‘মার্ক্স অসত্য নন। পুঁজিবাদও সর্বরোগহরা বটিকা নয়।’

ভোগবিলাসে মত্ত এক শ্রেণির অভিজাত মানুষের জীবনের আকাক্ষা হলো- জীবনটা শুধু ভোগের জন্যই। পণ্য উৎপাদন করো, বিক্রি কর, লাভ করো ও ভোগ করো। পুঁজিবাদী সংস্কৃতির এ বৈশিষ্ট্য আমাদের নতুন এক মানবিক সংস্কৃতি নির্মাণের ইশারা যে দিয়ে যাচ্ছে করোনাকবলিত পৃথিবী।

এ করোনাকালে শরীরের মধ্যে প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য সুষম খাদ্য গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাহলে ফাস্ট ফুডের প্রয়োজন কী আদৌ আছে? রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে চীন, থাইসহ বিভিন্ন বিদেশি খাদ্য গ্রহণের অপ্রয়োজনীয়তার কথাই যেন বলে যাচ্ছে- করোনাভাইরাস। তাই স্বদেশি খাদ্যের প্রতি বিরূপতার কারণেই তো আমরা মেকি আভিজাত্যেও বদৌলতে এসব ফাস্ট ফুড সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়েছি। আমরা কী এ সময় নিরাপদ রাসায়নিক মুক্ত খাদ্যের কথা ভাববো না, আমাদের ভবিষ্যতের জন্য।

 বৈশ্বিক ক্ষেত্রে করোনা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে- চিকিৎসা ব্যবস্থার গবেষণার অপর্যাপ্ততার দিকে।

লেখক: সিনিয়র সাব-এডিটর, সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //