করোনাভাইরাস প্রতিরোধে চাই সমন্বিত পদক্ষেপ

ব্যক্তিগত আলাপ ও সংবাদমাধ্যমের প্রধান বিষয় এখন করোনাভাইরাস। গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল চীন আর বর্তমানে আলোচনায় রয়েছে সারা দুনিয়া।

করোনাভাইরাস শুধু একটি রোগ নয়, এর ফলে বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল-কলেজ, বিমান, স্থল ও নৌপরিবহন, রাস্তাঘাট সবকিছু। খেলার মাঠগুলো বন্ধ, সেখানে তৈরি হচ্ছে হাসপাতাল।

শুরুতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে কিছু রোগী অ্যাটিপিক্যাল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। ধারণা করা হয়, বন্যপ্রাণী থেকে এক ভাইরাস মানুষকে আক্রান্ত করে, যার নাম নভেল করোনাভাইরাস। ১১ ফেব্রুয়ারিতে এসে এই ভাইরাসের নতুন নামকরণ হয় কভিড-১৯।

তখন থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও আমাদের দেশে আইইডিসিআর নিত্যনতুন স্বাস্থ্য বয়ান দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ প্রস্তুত; কিন্তু ৮ মার্চ যখন এখানে কভিড-১৯ এর রোগী শনাক্ত হয় তখন থেকে খামতিটা ধরা পড়ে। দেখা গেল, আমাদের হাতে নেই পর্যাপ্ত টেস্ট কিট ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা পোশাক। আর এ দুটোই করোনাভাইরাস প্রতিরোধের আবশ্যক উপাদান। সারা দুনিয়ায় এর চাহিদা অনেক বেশি, টেস্ট কিট বা এন-৯৫ মাস্ক সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। এছাড়া রোগ প্রতিরোধে লকডাউন করার পূর্বশর্ত হলো খাদ্য সুরক্ষা, নেই তারও প্রস্তুতি। সেক্ষেত্রে আমাদের পরিকল্পনা করা দরকার। এছাড়া দেশেই আরটিপিসিআর কিট বা এন-৯৫ সমতুল্য মাস্ক তৈরি করা যায় কিনা, এর জন্য বিজ্ঞানী ও কারিগরদের দ্রুত দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন।

হাসপাতালগুলো নিয়ে পরিকল্পনা করা দরকার। জ্বর, হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট রোগীকে ভিন্ন কাউন্টারে দেখতে হবে। এটা বিএসএমএমইউতে শুরু হলেও, তা করা দরকার সর্বত্র। এই রোগীদের কেউ কভিড-১৯ আক্রান্ত হতে পারেন। তাই তাদের অন্য রোগীদের সাথে সংমিশ্রণ করা চলবে না। এ রোগীদের রোগের অন্য কারণও খুঁজতে হবে; কিন্তু না পাওয়া গেলে কভিড-১৯ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে; অর্থাৎ দরকার ক্লিনিক্যাল কেইস ডেফিনেশন। আর এটা হলে রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা করা সহজ হবে। অন্যথায় আমরা শুধু আরটিপিসিআর ফলাফলের দিকে তাকিয়ে থাকব। আমাদের মনে রাখা দরকার, সব রোগীরই চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে, হাসপাতাল কিংবা বাড়িতে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের রাখতে হবে ভিন্ন ওয়ার্ডে, তাদের কেউ কভিড-১৯ পজিটিভ হলে বিশেষায়িত হাসপাতালে প্রেরণ করতে হবে। রোগী চিকিৎসার ক্ষেত্রে এ রোগীদের রক্ত, প্রস্র্রাব বা বুকের এক্স-রে পরীক্ষা করা দরকার। বাড়িতে থাকা রোগীর সাথে চিকিৎসকের যোগাযোগ থাকবে। কোনোভাবেই এদের শ্বাসকষ্ট বা রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ ৮৭ শতাংশের নিচে নেমে গেলে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। আর তখনই চাই প্রচুর অক্সিজেন। তাই অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য প্রচুর অক্সিজেন সিলিন্ডার দেশেই তৈরি করার চেষ্টা চালানো উচিত। আমরা জানি, কভিড-১৯ এর কোনো সুষ্ঠু চিকিৎসা এখনো নেই; কিন্তু প্রচলিত হাইড্রোক্সি-ক্লোরোকুইনেরও বাজারে ঘাটতি আছে। এছাড়া প্যারাসিটামল, এন্টিহিসটামিন ও এজিথ্রোমাইসিনের উৎপাদন বাড়ানো দরকার।

আরেকটি কথা সামনে এসেছে বায়োসেফটি লেভেল। পাবলিক হেলথ ইন্সটিটিউটের পরীক্ষাগারটি সম্ভবত বায়োসেফটি লেভেল-৩ ল্যাব, এর বাইরে অল্প কয়েকটা ল্যাব আছে যেগুলো বায়োসেফটি লেভেল-২। দেশে প্রায় ২০টির মতো পরীক্ষাগারে করোনাভাইরাসের জন্য পিসিআর পরীক্ষা হচ্ছে। এর সবগুলোই বায়োসেফটি লেভেল-২ হলে ভালো হতো, না হলে যত দ্রুত সম্ভব এই পরীক্ষাগারগুলোর মানোন্নয়ন হওয়া দরকার। এটা না করা হলে এ সব পরীক্ষাগার থেকে নতুন নতুন মানুষ সংক্রমিত হবে, তাই প্রয়োজন দেশের পরীক্ষাগারগুলোর মান ২, ৩, ৪ বায়োসেফটি লেভেলে উন্নয়ন ঘটানো।

কারও কারও ধারণা, তাদের কভিড-১৯ সংক্রমণ ঘটেছে পরীক্ষাগার থেকে। তবে এ ধরনের কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। আবার আমাদের কারও মধ্যে এই প্রত্যয় জন্মেছিল যে, আমাদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেশে ঘটবে না; কিন্তু বাস্তবে এটা ভুল প্রমাণ করতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়নি। বরং দেশের প্রখর সূর্যতাপ ও বৃষ্টি আমাদের জন্য কিছুটা রক্ষাকবচ হলেও হতে পারে।

কভিড-১৯ মোকাবেলায় চিকিৎসাকর্মীদের পরেই রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংবাদকর্মীরা। তাদের সুরক্ষাও জরুরি। কারণ ত্রুটিপূর্ণ ও স্বল্প সুরক্ষার জন্য বহু চিকিৎসাকর্মী এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছেন পুলিশ ও সংবাদকর্মী। তাদের সুরক্ষা করা গেলে আইন-শৃঙ্খলা ও করোনাভাইরাস প্রতিরোধ দুটিরই অবনতি হবে। সেনাসদস্যদেরও কাজে লাগানো দরকার পরিকল্পিত উপায়ে। তাদের মাত্র একটা অংশকে কভিড মোকাবেলায় ব্যবহার করা প্রয়োজন এবং একটা অংশ রাখা দরকার কভিড কার্যক্রম থেকে একদম দূরে। এই দুই অংশের কোনোরকম সংমিশ্রণ করা যাবে না। এটা রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষার জন্য খুবই জরুরি।

ত্রাণ বিতরণে যদি সেনাদের ব্যবহার করা হয়, তাহলে স্থানীয় সরকার ও বেসামরিক প্রশাসনের যোগ্যতা ও স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হতেৃ বাধ্য। স্থানীয় সরকার ও বেসামরিক প্রশাসনের কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হলে তাদের অপসারণ ও বিচারের মুখোমুখি করা দরকার। ত্রাণ পরিচালনার দায়িত্বে দেয়া হয়েছে প্রতি জেলায় একজন করে সচিবকে। এটাও সেনা ব্যবহারের মতো একটা খোড়া যুক্তি।

চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষা পোশাক নিয়ে বহু কথা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে শুধু একটি কথাই বলতে চাই- যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকের মনোবল কমে গেলে ওই যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায় না। চিকিৎসকদের তাই শোকজ ও সাসপেনশন না করে তাদের উজ্জীবিত করুন। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য বাজেট বাড়াতে হবে ও অবিলম্বে স্বাস্থ্যসেবাকে জাতীয়করণ করতে হবে।

করোনা প্রতিরোধে ভারতের কেরালা রাজ্যের কথা অনেকেই উল্লেখ করে থাকেন। তাদের সফলতার কারণ হিসেবে অনেকেই শাসক দল ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দক্ষতার কথা বলে থাকেন। এটা বহুলাংশে সত্যি হলেও, এটা মনে রাখা দরকার- কেরালার মানুষ শতভাগ শিক্ষিত। তাদের পক্ষে এ রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে শেখা যত সহজ, কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষের পক্ষে এটা এতটা সহজ নয়।

ইদানীং আমাদের দেশের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাকালে নতুন সন্তান না নেয়ার জন্য। এটাও শিক্ষিত মানুষের পক্ষে সহজেই গ্রহণ করা সম্ভব। তাই এই ক্রান্তিকালে  শিক্ষাকে জাতীয়করণ ও শিক্ষা বাজেট বাড়াতে হবে।

করোনাভাইরাস-পরবর্তী সময়ে দেখা দিতে পারে খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ। তাই কৃষি বা কৃষককে অবহেলা করলে আমাদের সংকট আরো ঘনীভূত হবে। আজ কৃষক তার উৎপাদিত ফসল মাঠ থেকে তুলতে পারছে না, বিক্রি করতে পারছে না। খামারিরা বিক্রি করতে পারছে না দুধ, ডিম, হাঁস-মুরগি। তাই রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে কৃষকের ফসল তুলতে ও বিপণনে। অন্যথায় আগামী মৌসুমে কৃষক আর ফসল উৎপাদনে যাবে না। কৃষককে ঋণ দিতে হবে বিনা সুদে, ভূমিহীন ও ক্ষেতমজুরদের জুন মাস পর্যন্ত খাদ্য সুরক্ষা প্রদান করতে হবে কোনো খয়রাতি সাহায্যের মাধ্যমে।

তৈরি পোশাকের কারখানা গত ২৬ এপ্রিল থেকে খুলে দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এই পোশাককর্মীদের একবার ‘ঢাকা-বাড়ি-ঢাকা’ করা হয়েছে। আবার কাকতালীয়ভাবে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার বাইরে কভিড-১৯ এর সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়েছে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে। তাই এর সাথে পোশাক কারখানার কোনো সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। পোশাক কারখানার পরিবেশ খুব শ্রমঘন ও আমাদের দেশে কভিড-১৯ পরীক্ষার হার ও যথেষ্ট সন্তোষজনক নয়। তাই পোশাক কারখানা খুলে দেয়া আত্মঘাতী না হয়ে যায়!

ভাসমান শ্রমজীবী মানুষের খাদ্য সুরক্ষা প্রদান করতে হবে অন্যথায় লকডাউন অর্থবহ হবে না। ওষুধ ও সাবান কারখানা চালু রাখতে হবে। বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে রোহিঙ্গাদের ওপর। বন ধ্বংস বন্ধ করতে হবে। আগামী বাজেটে কৃষিকে আরো গুরুত্ব দিতে হবে।

আমাদের সবকিছুর মূল শর্ত হলো যোগ্য নেতৃত্ব ও সঠিক সমন্বয়। তাই আমরা আশাবাদী আগামী দিনের নেতৃত্ব হবে যোগ্য, সমন্বিত ও তরুণতর মানুষ- যারা সমাজের সবকিছুর দায়িত্বে আসবে। ভবিষ্যতে আমদের মূল নজর দিতে হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষির ওপর।

কেন্দ্রীভূত নগরায়ণের ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ প্রাণ-প্রকৃতি, বন ও নদী সংরক্ষণ ব্যতীত মানুষ তার ভবিষ্যৎ অস্তিত্বই রক্ষা করতে পারবে না।

লেখক : মেডিসিন বিশেষজ্ঞ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //