করোনা প্রতিরোধই এখন প্রধানতম কাজ

সারা দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস। ধর্ম-বর্ণ, ধনী-গরিবসহ পাঁচ মহাদেশের প্রায় সব দেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ছে। কোয়ারেন্টিন-আইসোলেশন, লকডাউন-সাটডাউন, কারফিউ-ইমারজেন্সি, সোশ্যাল ডিসটেন্স- সেনিটাইজার-হ্যান্ডওয়াশ প্রভৃতি শব্দগুলো দেশনির্বিশেষে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। নিয়ম ভঙ্গ করলে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। হাসপাতাল, ডাক্তার, পরীক্ষার কিট প্রভৃতিসহ চিকিৎসা ব্যবস্থা ক্রমেই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য স্বল্প ও যথেষ্ট নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। মানুষের রুটিন ওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গরিব মানুষ ক্রমেই দুরবস্থার মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। মানুষ দিন গুনছে কবে এই  রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার হবে, মহামারি বন্ধ হবে?

এমন অনিশ্চিত-অস্থির ও হিমশিম-আলোড়িত অবস্থার মধ্যে সারাবিশ্বের মানুষ আগে আর কোনোদিন পড়েনি। প্লেগ, কলেরা, গুটিবসন্ত, যক্ষ্মা, স্প্যানিশ ফ্লু প্রভৃতি অতীতের মহামারির কথা আমরা জানি; কিন্তু তখন তো আর বিশ্বগ্রাম ছিল না। একই দেশের বা মহাদেশের ভেতরে পর্যন্ত যাতায়াত, লেনদেন ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তেমন ছিল না। তাই মহামারি এতটা ছড়িয়ে পড়ার ভয় যেমন ছিল না কিংবা মানুষ খবরই রাখতো না। মহামারি ছাড়াও ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, সুনামি কিংবা বিশ্বযুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি, দেশজয়, আঞ্চলিক যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও  মুক্তি সংগ্রাম ইতোপূর্বে বিশ্বকে নানাভাবে অনিশ্চিত-অস্থির ও আলোড়িত করেছে। সর্বোপরি পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত থাকায় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে একটা ভয় ও শঙ্কা মানুষের ছিল। তবুও একটা ভরসার জায়গা ছিল, বিশ্ব বহুকেন্দ্রিক হলেও শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রে পারস্পরিক ভারসাম্য আছে বিধায় যুদ্ধ লাগবে না।

কিন্তু এবারের বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রায় সারা পৃথিবীর মানুষ এই মহামারিতে জড়িত  ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। বিশ্ব রাজনীতি তথা আমেরিকা-চীন পারস্পরিক দোষারোপ ও পাল্টাপাল্টি সবটাকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। প্রসঙ্গত, ডিসেম্বর ’১৯-এর  শেষদিকে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে চীন এই বিষয়ে গুরুত্ব দেয়নি, গোপন করেছে। এমনকি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াং ভয়াবহতার খবর প্রকাশ করায়, তা গুজব হিসেবে আখ্যায়িত করে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ছেড়ে দেয়া হলেও ৭ ফেব্রুয়ারি তার এই ভাইরাসেই মৃত্যু হয়। চীন এসব ঠিক করেনি। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চীন সরকার এইসব বিষয়ে তাদের ‘দুর্বলতা’ ও ‘ঘাটতি’ স্বীকার করে।

এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই ভাইরাসের ভয়াবহতা প্রথম দিকে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি। জানুয়ারি শেষ সপ্তাহে এই সংস্থার সভায় এ ভাইরাস নিয়ে সতর্ক করলেও ১৬ জন বিশেষজ্ঞের মধ্যে অধিকাংশের মত অনুযায়ী, মহামারি আখ্যায়িত বা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার মতো অবস্থা এখনো হয়নি। এদিকে আমাদের মতো দেশগুলো তো নয়ই, ইউরোপ ও আমেরিকার  উন্নত দেশগুলোও তেমন গুরুত্ব দেয়নি; কিন্তু এখন প্রবল পরাক্রান্ত আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পর্যন্ত বেসামাল হয়ে পড়েছে। গুরুত্ব দিয়ে প্রাক প্রস্তুতি না নেয়াটা যে বিশ্ব সমাজের ভুল ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রকৃত বিচারে রোগের বিস্তৃতি ও ভয়াবহতার বিষয়টি গুরুত্ব না পেলেও প্রথম থেকেই পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমে করোনাভাইরাসকে ‘চীনা ভাইরাস’ বলে আখ্যায়িত করে। এমনটাও প্রচার করা হয়, এই ভাইরাস প্রকৃতি সৃষ্ট নয়, উহান শহরের পরীক্ষাগারে গোপন জীবাণু মারণাস্ত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে এই ভাইরাস বাইরে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রচারের বিরুদ্ধে চীন অবস্থান নিয়ে বলে যে, মার্কিন সেনারা উহান প্রদেশে এই ভাইরাস আমেরিকা থেকে নিয়ে আসতে পারে। প্রথম আমেরিকায় এই ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয় এবং ২০ হাজার মানুষ এতে মারা যায়। আমেরিকাকে ‘স্বচ্ছ হও’, ‘তথ্য জানাও’ বলে উপদেশ দেয়। এই পাল্টাপাল্টির মধ্যে নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নালের ১৭ জন সাংবাদিককে চীন বহিষ্কার করে। আমেরিকা চীনা রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এর প্রতিবাদ করে। এখনো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের প্রতি অভিযোগ উত্থাপন করেছে।

এদিকে চীন সরকার অবৈধ বন্য প্রাণীর বাজারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আবার চীনা সূত্রেই জানা যাচ্ছে, সামুদ্রিক মাছের বাজার থেকে প্রথমে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। প্রকৃতির  যথেচ্ছা ক্ষতি করায় প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে বলেও জোর প্রচার রয়েছে। এদিকে বৈজ্ঞানিকরা এমন মতও প্রকাশ করছে যে, সার্স ভাইরাস আর কোভিড-১৯ ভাইরাস একই গোত্রের।  তবে আগের সার্স ভাইরাসের সঙ্গে এই ভাইরাসের পার্থক্য আছে। ঘন ঘন জিন মিউটেশন করে নিজের চরিত্র পাল্টে ফেলছে এই ভাইরাস। ইতোমধ্যে ৩৮০ বার জিন পরিবর্তন করছে। এজন্যই প্রতিষেধক অবিষ্কার করা খুবই কঠিন। মরিয়া হয়ে পড়েছে বৈজ্ঞানিকরাও। আশার কথা, এ মহামারির প্রতিষেধক আবিষ্কার করার কাজ চলছে। প্রথম শোনা গিয়েছিল প্রতিষেধক পেতে এক-দুই বছর লাগবে, এখন তিন মাস বা এক মাস বলে প্রচার চলছে। রোগীর ওপর প্রয়োগও হয়েছে ও হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, চীন প্রথম দিকে বিষয়টি গোপন রাখতে চাইলেও এই মহামারি প্রতিরোধে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে; কিন্তু ইতালি, স্পেন কিংবা ইরান কেন যেন মনে হয় পারছে না। ইতালির প্রধানমন্ত্রী কন্তে সবশেষ বলেছেন, ‘আমরা মহামারির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে মারা গেছি। আর কী করতে হবে আমরা জানি না। পৃথিবীর সমস্ত সমাধান শেষ হয়ে গেছে। একমাত্র সমাধান আকাশের কাছে।’ এটা তো ঠিক, চীন সরকার আকাশের দিকে তাকায়নি। বৈজ্ঞানিকরাও আকাশের দিকে চেয়ে নয়, প্রতিষেধক তৈরিতে ল্যাবরেটরিতেই আছেন। প্রবাদ আছে, বিপদে পড়ার আগে বিপদ নিয়ে ভাব, বিপদ কীভাবে মোকাবেলা করবে, তা নিয়ে  চিন্তা কর; আর বিপদ এলে যথাচিত কাজটি কর। চীন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সেই কাজটি করে পৃথিবীকে দেখিয়েছে। প্রতিটি দেশেরই তা করে দেখাতে হবে।

চীনের উদাহরণ কাজে লাগানো আজ জরুরি প্রয়োজন। চীনও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। নিজেরা মুক্ত হতে পেরেছে বলেই এটা সম্ভব হচ্ছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে চীনের স্লোগান হচ্ছে এরকম : ‘দিন শেষে আমরা তো একই সাগরের ঢেউ।’ বাস্তবেও তাই; কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, যখন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রশ্ন আসে, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আধিপত্য তথা ভূরাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের বিষয়টা স্বার্থের সামনে আসে; তখন কেন যেন ব্যবস্থা নির্বিশেষে সব দেশের নীতিকথা পাল্টে যায়। তখন চলতে থাকে পাল্টাপাল্টি। তাতে মানুষ পড়ে শাখের করাতের মধ্যে। বিশ্বের অগণতি মানুষকে নিরন্ন, বাসস্থানহীন, চিকিৎসা বিপজ্জনক অবস্থায় রেখে সামরিক প্রস্তুতি এবং এমনকি পারমাণবিক বোমা, রাসায়নিক বা জীবাণু অস্ত্র বানানোর প্রতিযোগিতাও চলে। এখানেই হচ্ছে মানব জাতির সমস্যা। মানব জাতি আজ পড়েছে মহা বিপদে।

আমরাও আছি বিপদের মধ্যে। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় এবং মানুষের সচেতনতা-সতর্কতা কম হওয়ায় মহামারির আকারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রচুর। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে করোনার মতো মহামারি মোকাবেলার জন্য বেশ অপ্রতুল। অন্যান্য সব দেশের মতোই প্রাথমিক প্রস্তুতি আমরা তেমনভাবে নিতে সক্ষম হই নাই। অনেক গ্যাপ রয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, ডাক্তারদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য পোশাক পর্যন্ত নেই। স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যেও আতঙ্ক ও ক্ষোভ রয়েছে। এখন যেভাবে কিছু কিছু করে করোনা রোগী ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে যদি তা আরো বেড়ে মহামারির মতো অবস্থা হয়, তবে মহাবিপদের মধ্যে পড়ব আমরা!

ইতোমধ্যে সরকার করোনাভাইরাস রোগীদের জন্য আলাদা চিকিৎসার ব্যবস্থা, বিদেশ থেকে আসাদের কোয়ারেন্টিনে রাখা, সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য অফিস বন্ধসহ নানা ব্যবস্থা নিয়েছে। সরকার যখন এইসব ব্যবস্থা নিচ্ছিল, তখন তা না মানার কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ পর্যন্ত হয়েছে। প্রথম দিকে চীনের আক্রান্ত অঞ্চল থেকে প্রবাসী ছাত্রদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। শেষ পর্যন্ত আর্মিকে বিদেশিদের কোয়ারেন্টিনে নেয়ার কাজে নামানো হয়েছে। এখন ভাইরাস প্রতিরোধে আর্মিকে নামানো হয়েছে। সরকার ও জনগণ যদি এক সঙ্গে না নামে, তবে এই দুর্যোগ মোকবেলা অসম্ভব; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসকে ইস্যু করে নানাভাবে রাজনীতির পাল্টাপাল্টি বক্তব্য চলছে। একদিকে মন্ত্রীরা নানা হাস্যকর বেফাঁস ও অপ্রয়োজনীয় কথা যেমন বলছে, তেমনি প্রথম থেকেই নানাভাবে গুজব ও ভুয়াখবর ছড়ানো হচ্ছে। এসব পাল্টাপাল্টি বন্ধ করা  জরুরি। রাজনীতিকে প্রাধান্য না দিয়ে মানবতার স্বার্থে দল-মত নির্বিশেষে করোনা প্রতিরোধে সামাজিক উদ্যোগগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধে দাঁড়ানো এখন জাতীয় কর্তব্য।

করোনা মহামারি থেকে আমাদের দেশের মানুষ ও বিশ্ববাসী এক সময় নিঃসন্দেহে পরিত্রাণ পাবে; কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে সারাবিশ্বের যে ক্ষতি হলো, তা কীভাবে পূরণ করা হবে এবং এই ক্ষতির কতটা প্রভাব কিংবা বোঝা গরিব মানুষ বা অনুন্নত দেশগুলোর ওপর পড়বে, তা ভবিষ্যতই বলতে পারবে। বলাই বাহুল্য অর্থনৈতিক সংকটের পেছন পেছন আছে রাজনৈতিক সংকট। করোনা সংকট কাটিয়ে ওঠার পর এই দুই সংকট একত্রে জাতীয় ও বিশ্বব্যাপী কি রূপ নেবে, তা অনুমান করা কঠিন। তবে এইসব অনুমান ও জল্পনা-কল্পনা বাক্সবন্দি করে দলাদলি-পাল্টাপাল্টি না করে এখন মহামারি আটকে দেয়াটাই হচ্ছে একমাত্র কাজ।

শেখর দত্ত

কলাম লেখক, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //