মফস্বলে ডিসি চর্চা ও উপনিবেশিক আইন

১.

ভিখারীর মতো চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে ভেতরে রাস উৎসব দেখার মতো ডিসির বাংলো দেখি। ডিসিরা ছিলেন ব্রিটিশ শক্তির স্থানীয় প্রতিনিধি। 'উনিশ শতকের বাংলার মফস্বল'সহ এরকম নানান গ্রন্থ রচিত হয়েছে জি. গ্রাহামদের মতো ডিসিদের হাতেই। 

রাজা রামমোহন রায় যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন গুড লাকের মতো ডিসিও। ব্রিটিশ ক্ষমতা ব্যবহার করে সতীদাহ প্রথা যেমন বিলুপ্ত হয়েছে, তেমনি প্রজা নিপীড়ক গুডলাকদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন দেবী চৌধুরাণীর মতো গণ লড়াকুরা। ভবানী পাঠক-নূরল দীন-মজনু শাহদের পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল গণক্ষমতাতন্ত্র কায়েম। কিন্তু যে কানুনের জোরে ডিসিরা ডিসিগিরি করেন, তার বদল তো ঘটল না। বরং দিনকে দিন তা বেড়েছে। আদালতের পাশাপাশি তাদের হাতেও গিয়েছে বিচারিক ক্ষমতা। যার নাম ভ্রাম্যমাণ আদালত। কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীন যে আইনের অপব্যবহার করলেন, তার উৎসাহ পেয়েছেন এই কাঠামো থেকেই। এই কাঠামো থেকেই তিনি সবাইকে স্যার বলাতে বাধ্য করেছেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়েছেন জেলার প্রভু। ম্যাডাম বললে তার অধিনস্ত কর্মচারীরা বলতেন, স্যার বলুন।

সম্প্রতি জেলায় পুলিশ নিয়োগে স্বচ্ছতার নজির স্থাপিত হয়েছে। যেসব পুলিশ কর্তারা ঘুষ বাণিজ্য করেছিলেন তাদের স্ট্যান্ড রিলিজ ও ঘুষের টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করেছেন পুলিশ সুপার। কিন্তু উল্টো ডিসি নিয়ন্ত্রণাধীন সকল নিয়োগে ব্যাপক ঘুষের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি ডিসির বিদায়ের দিনেও কুড়িগ্রামে চাকুরি প্রার্থীরা মানববন্ধন করেছেন। সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদের কম্পিউটার অপারেটর পদে ৭৩ জনের নিয়োগ নিয়েও কথা উঠেছে। বাতাসে ছড়িয়েছে জন প্রতি ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন প্রতি প্রার্থী। এমনকি বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার নিয়োগগুলোতেও তাই ঘটেছে। এই কাজে তাকে যেমন সাহায্য করেছেন নাজিম উদ্দীনের মতো ম্যাজিস্ট্রেট, তেমনি স্থানীয় দালালচক্রও।

ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে ইটভাটা মালিকদের কাছেও ভাটা প্রতি ২ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। নাজিম উদ্দীনকে দিয়ে কুড়িগ্রাম বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এক দোকান থেকেও চাঁদা নেয়ার অভিযোগ পত্রিকায় এসেছে।

কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের অতিথি শিক্ষক ছিলেন ভাওয়াইয়া শিল্পী শফি। ৮ বছর আগে একজন শিল্পীর কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এক ডিসি তাকে চাকরিটি দেন। তিনি শিল্পী হওয়ায় ডিসির বাদ্যযন্ত্র ক্রয় কমিটিতে তিনি ছিলেনও। কেনা হয় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার হারমোনিয়াম-তবলা। এগুলো নিম্নমানের হওয়ায় তিনি ফেসবুকে লেখেন, এত নিম্নমানের বাদ্যযন্ত্র দিয়ে রাস্তায় হকাররাও ঔষধ বিক্রি করেন না। কাল হলো সেটাই। চাকুরিচ্যুত হলেন। ডিসির অনুগত অধ্যক্ষ কলেজে ফান্ড নেই দেখিয়ে চাকুরি নট করে দিলেন।

এর আগে জেলায় বহুতল মসজিদের জমির দরকার ছিল। রেল কর্তৃপক্ষের নিষেধ অমান্য করেই পুরাতন স্টেশন উচ্ছেদ পূর্বক বরাদ্দ দেন। ফলে গণকমিটির নেতৃত্বে ফুঁসে ওঠে স্থানীয় জনগণ। পরে রেলমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তিনি থামেন। নিজ জেলা পঞ্চগড়ে তার পিতার জমি দখলের বিরুদ্ধে আদালত রায় দিয়েছেন। সর্বশেষ সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের ঘটনায় ডিসি সুলতানার পর্ব সমাপ্ত হয়। কেন?

২.

ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জীবন-যাপন সাধারণের মতোই। সচিব পদটাও আর দশটি পদের মতোই। কিন্তু সেই সচিবই ভারতে এসে হতেন বড়লাট। হতেন অসীম ক্ষমতার মালিক। যাকে খুশি প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী বানাতেন। চার্চিল যে বলতেন, তারা পশুর ধর্ম নিয়ে পশুসদৃশ জাতি -এটাই ছিল ভিত্তি। ভারতীয়দের পশু জেনেই তারা যাবতীয় কানুন বানাতেন। সেই কানুনই আমরা সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদে যুক্ত করেছি। ব্যাখ্যা অংশে 'প্রচলিত আইন' এর নামে মেনে নিয়েছি। ফলে ডিসিরা জনগণকে পশু না জানুক, প্রজা অন্তত মনে করবেন, এটাই স্বাভাবিক। 

-বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সম্পর্কিত অনিয়ম অনাচার দুর্নীতি গাফিলতির খবর ছাপা হলে অনেকেই ভেবে বসেন যে, লেখাটা ওই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে গেছে, তারা বেশ জব্দ হয়েছেন। এটা একটা বিকৃত-তৃপ্তি, একের বিরুদ্ধে অন্যের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে মজা পাওয়া। গোটা সামাজিক পরিস্থিতি যখন দারুণ অসুস্থ,...তখন একটি সংবাদ হয়ে যায় বিরুদ্ধের ব্যাপার।...এর থেকে মুক্তি চাই (মোনাজাতউদ্দিন, নেপথ্য সংবাদ)। 

যে আইনি কাঠামো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীকে প্রভু বানায়, তার বদল নয় কি? নইলে সুলতানা পারভীনরা গুডলাক হবেন আর ফকির-সন্নাসীদের জায়গায় নামতে হবে গণকমিটির নেতৃত্বে জনগণকে।

লেখক: কবি ও কলামিস্ট।

[email protected]

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //