উন্নয়নের মহাসড়কে ক্ষুধার্ত শ্রমিকের লাশ

গত ১২ ডিসেম্বর স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ১৮তম স্প্যান বসানো হয়েছে। এর আগে গত ৮ ডিসেম্বর দেশি-বিদেশি তারকাদের উপস্থিতিতে জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদ্বোধন হলো বিপিএল। ঠিক একই সময়ে খুলনা, রাজশাহী, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকরা তাদের বকেয়া বেতন, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের পিএফ গ্রাচুইটির টাকা দেওয়াসহ ১১ দফা দাবিতে আমরণ অনশন করছেন। ৩ দিন কেটে গেলেও সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে কোনো রকম আশ্বাস আসেনি। একদিকে পদ্মা সেতুর স্প্যান বসছে আর তার মধ্যেই জানা গেল অনশনে অংশ নেওয়া প্রায় শতাধিক শ্রমিক টানা তিন দিনের অনাহারে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সবচেয়ে মর্মান্তিক খবরটা এলো দিনের শেষে। অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়া একজন পাটকল শ্রমিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন। ওদিকে ডঙ্কা বেজে চলেছে উন্নয়নের। ডঙ্কার তালে নেচে চলেছি আমরা।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোতে শ্রমিকদের ১০ থেকে ১২ সপ্তাহের বেতন বকেয়া রয়েছে। সাপ্তাহিক হিসেবে মজুরি পাওয়া এসব গরিব অসহায় শ্রমিকদের জন্য এটি কতটা কঠিন এই মৃত্যুর ঘটনার পর তা পরিষ্কার। এই সংকট এক দিনে তৈরি হয়নি। গত নভেম্বর মাস থেকেই পাটকল শ্রমিকরা তাদের দাবি দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে কথা বলেও সংকট সমাধান হয়নি। হয়তো সরকার মৃত্যুবরণ করা শ্রমিকের পরিবারকে পঞ্চাশ হাজার বা এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায়মুক্ত হবে। কিন্তু অসহায় শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে না। 

ধানের দাম না পেয়ে টাঙ্গাইলে কৃষক তার পাকা ধানে এবং ফরিদপুরে পাটচাষি পাটে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন, দুধের দাম না পেয়ে পাবনায় খামারিরা রাস্তায় দুধ ঢেলেছেন, ঋণের দায়ে কৃষক আত্মহত্যা করেছেন- এসব কোনোকিছুই রাষ্ট্রের বিবেককে স্পর্শ করেনি। বরং ধানে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনায় রাষ্ট্র খুঁজেছে ষড়যন্ত্রের গন্ধ। সে সময় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছিলেন, ‘ধানের জমিতে আগুন দেওয়া উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। আগুন লাগিয়ে দেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ সুতরাং কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুরদের এসব প্রতিবাদ ছুঁতে পারেনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের। অথচ ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ছয় বছরে দেশে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের আয় প্রায় ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। বিপরীতে একই সময় সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে ৫৯ শতাংশ। যে দেশে এক শ্রেণির মানুষ উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে, ঠিক একই সময়ে সেই উন্নয়নের চাপে পিষ্ট হচ্ছে আরেকটি শ্রেণি। 

সম্প্রতি পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির পর সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে যেসব মন্তব্য এসেছে, তা নিতান্ত রসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। কেজি প্রতি ১৫০ টাকা বিমান ভাড়া দিয়ে পেঁয়াজ আনার বিষয় নিয়ে গর্ব করতে দেখা গেছে বাণিজ্যমন্ত্রীকে। যদিও এসব কিছুর পরও দাম দশ পয়সাও কমানো সম্ভব হয়নি। আর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দাবি করেছেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মানুষের কোনো অসন্তোষ নেই।’ কারণ হিসেবে তিনি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। প্রায় ৮ গুণ বা কেজিপ্রতি দুশ’ টাকার উপরে বৃদ্ধি পাওয়া পেঁয়াজ বা কেজিপ্রতি ৬-৮ টাকা বৃদ্ধি পাওয়া চালের দাম নিয়ে মানুষের অসন্তোষ থাকবে না- এটা একজন মন্ত্রী কীভাবে ভাবতে পারেন তা আমাদের অজানা। সরকারি সংস্থা বিবিএস-এর তথ্যের দিকে তাকালে মাননীয় মন্ত্রী বুঝতে পারবেন দেশের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মাথাপিছু আয় বা ক্রয়ক্ষমতা বাড়লেও দরিদ্র শ্রেণির মানুষের আয় বা ক্রয়ক্ষমতা বরং হ্রাস পেয়েছে।

মেট্রোরেল, মহাসড়কগুলো দুই লেন থেকে চার লেন- চার লেন থেকে ছয় লেন, নদীর তলদেশে টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন ফ্লাইওভার, রেললাইন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রত্যেকটি উন্নয়ন প্রকল্প বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে প্রায় ৫-১০ গুণ বেশি খরচে নির্মিত হচ্ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণ যা গত সেপ্টেম্বরে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকায়। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর দেশ থেকে পাচার হচ্ছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা। বাড়ছে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত। এক শ্রেণির মানুষের পকেটে চলে যাচ্ছে উন্নয়নের ফসল। আর দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ যাদের ঘামে, পরিশ্রমে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি তারাই পাচ্ছে না উন্নয়নের সুফল। 

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী স্মরণীয় করে রাখতে ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপন উপলক্ষে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত নগরসজ্জা থেকে শুরু করে স্মারকগ্রন্থ, কর্মশালা-সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজনের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২০০ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী স্মরণীয় করে রাখতে দেশের সর্বস্তরের মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে পাটকল শ্রমিকদের ঘামের মূল্য, বকেয়া বেতন পরিশোধ না করে নিজের জন্মশতবার্ষিকী পালন করতেন না- একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। 

এ মাসের শুরুতে বেতন-ভাতা বাড়ানোসহ ১১ দফা দাবিতে সারাদেশে ধর্মঘট করে নৌযান শ্রমিকরা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে এখনো কোনো দাবিই মেনে নেওয়া হয়নি। হয়তো দাবি আদায়ের তাগিদে তারাও একসময় আমরণ অনশনের ডাক দেবেন। হয়তো কোনো আব্দুস সাত্তার জীবন দিবেন। কিন্তু তাতে টনক নড়বে না রাষ্ট্রযন্ত্রের উন্নয়নের মহাসড়কে এই ক্ষুধার্ত শ্রমিকের লাশের ভার কি বইতে পারব আমরা? তার আত্মত্যাগের বিনিময়েও যদি দেশের মেহনতি মানুষের অধিকার, ন্যায্য দাবি আদায় হয়- তাতে তার ত্যাগের প্রতি কিছুটা হলেও সম্মান জানানো হবে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //